১।
সমস্যাটা তখন শুরু হয়েছে, যখন আমরা বাঙ্গালিয়ানাকে সুনির্দিষ্ট চিহ্নের মাধ্যমে চেনা, এবং সীমাবদ্ধ করা শুরু করেছি।
.
উদাহরণত – টিপ পড়লে বাঙালি, শাড়ি পড়লে বাঙালি, শাঁখা সিঁদুর আলতা মানে বাঙালি, কিন্তু লম্বা ঘোমটা, বা হিজাব, অথবা বোরখা পড়লে, বা ইসলামিক সেন্টিমেন্টের সঙ্গে যায়, এমন যেকোনো পোশাক বা চিহ্ন ধারন করলেই তা আর বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারন করে না, আমদানিকৃত আরব কালচারকে প্রোমট করা হয়ে যায়।
.
যখন এরকম বিভাজনমূলক নীতি প্রয়োগ করা হবে, যখন বাংলা – বাঙালির কিছু অপরিবর্তনীয় সংজ্ঞা / চিহ্ন তৈরি করা হবে, যখন আমাদের সংস্কৃতি নির্ধারক বিবিধ চিহ্ন, আকাশে উড়বার ডানা হয়ে ওঠার বদলে হয়ে উঠবে পায়ের ভারী শেকল – তখন সংস্কৃতির সেই সংজ্ঞা, প্রচার, প্রয়োগ হয়ে উঠবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়ানোর মাধ্যম। আর এই সাম্প্রদায়িকতা হবে সর্বাধিক সর্বনেশে, কারন সেটা অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জনরোষ থেকে জন্ম নেয়া বা তৈরি মোটাদাগের সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং শিক্ষিত চতুর জনগোষ্ঠীর পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িকতার অংশ।
.
২।
একদা চারুকলায় শিক্ষকতা খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করবার সুবাদে বাইরের মানুষ হিসেবে চারুকলার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ হয়েছিল আমার।
.
২০১৭, বা ১৮ সনে, এখন ঠিক মনে পড়ছে না, চারুকলা ভর্তি পরীক্ষার ডিউটি দিচ্ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায়। ফিগার ড্রয়িং পরীক্ষা। আমার সঙ্গে সহ পরীক্ষক ছিলেন তরুণ এক স্টার আর্টিস্ট কাম চারুকলার শিক্ষক। তার কাছ থেকে জানা গেলো, তিনি মাস্টার্স করেছেন বিশ্ব ভারতী থেকে, সুলতানের কাজের ওপর তার চূড়ান্ত থিসিস। সে বিষয়ক কিছু আলাপ শেষে তাকে যখন প্রশ্ন করলাম, চারুকলার প্রাক্তন ছাত্র, এবং বর্তমান শিক্ষক হিসেবে চারুকলার শিক্ষাদীক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে তিনি কি চিন্তাভাবনা করছেন, তখন তিনি চারুকলায় ভর্তি পরীক্ষা দিতে সামনে বসা বোরখা / হিজাব পরিহিত কয়েকজন শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে সরাসরিই আমাকে বললেন, চারুকলায় এই ধরনের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন কে দিন বাড়ছে, যাদের কাছে আর্টিস্ট হওয়া বা আর্ট শেখাটা আর গুরুত্বপূর্ণ না, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্যেই তারা চারুকলায় ভর্তি হয়।
.
এই শিক্ষক, হিজাব/ বোরখাধারী যে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেছিলেন, তাতে আমি কোন কূটাভাস খুঁজে পাই নি সেদিন। বরং অনুভব করেছিলাম, দীর্ঘদিন ধরে ভেতরে বয়ে বেড়ানো স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাসের জায়গা থেকে তিনি বলেছিলেন কথাগুলি।
.
এটা, চারুকলার শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একাংশের এক বিভাজনমূলক, এবং সাম্প্রদায়িক মাইন্ডসেটের বহিঃপ্রকাশ।
.
৩।
.
আমাদের এটা বোঝা জরুরী যে, একজন মুসলিম শিক্ষার্থী কেন ছবি আঁকে, কেন গান গায়, তার ধর্মে এ নিয়ে কি বলা আছে - একজন অমুসলিম হিসেবে এসব প্রশ্ন, উগ্রভাবে (এমনকি ভদ্রভাবেও) করা - ভদ্রতার সীমালঙ্ঘন। অনুচিত। সনাতন ধর্মাবলম্বী কাউকে - 'কিরে, তুই গরু খাস না কেন?' - এই প্রশ্নটা করা, অথবা, খ্রিস্টানকে, 'কিরে তুই শুকরের মাংশ কেন খাস?' - যেমন অনুচিত, সীমালঙ্ঘন করা, ভদ্রতার পরিসীমা অতিক্রম করা, ঠিক একই ভাবে একজন মুসলিমকেও, সে ইসলামকে কিভাবে ডিল করছে নিজের মতো করে, সেটা নিয়ে বাইরে থেকে প্রশ্ন তোলা অশালীন।
.
সমস্যা হচ্ছে, ললিতকলা, বা আর্ট চর্চাকারী মুসলিম স্টুডেন্টদের মধ্যে যারা ইসলাম প্র্যাকটিস করে, বা ইসলামের চিহ্নবহন করে, তাদের হরহামেশা এ ধরনের হ্যারাসমেন্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কেউ ইসলামিক চিন্তাভাবনা শেয়ার করলেও এই কুৎসিত প্রশ্ন করা হয় – তুই চারুকলায় কি করিস?
.
চারুকলায় যেভাবে হিন্দুধর্মের অনুবর্তী সংস্কৃতির আত্মিকরণ হয়েছে, অন্য কোন ধর্মের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা হয় নি। উদাহরনত – হোলি খেলার কাছাকাছি সময়েই, চারুকলায় হোলি খেলার আদলে রঙ খেলা।
.
৪।
কথা হচ্ছে, একটা সভ্য, অগ্রসরায়মান সমাজ ব্যবস্থার অধীনে থেকে ৮০র দশকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া একটা শোভাযাত্রাকে যখন ‘হাজার বছরের আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি’র ধারক বাহক চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়, তাও কর্পোরেটের পয়সায়, তাকে প্রশ্ন করা যাবে না কেন?
.
মঙ্গল শোভাযাত্রার এই যে বড় বড় মুখোশ বা মোটিফগুলো বানানো হয়, কার পয়সায়? বিভিন্ন রঙ কোম্পানির। এই কর্পোরেট সংস্কৃতিও আবহমান বাংলার প্রতিচ্ছবি? যদি এই শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত মোটিফে আমি আমার মা খালা, বাবা চাচাদের মধ্যে বাঙালি, এবং মুসলিম সংস্কৃতির মিশ্রণে যে বাঙ্গালিয়ানার চর্চা দেখেছি, আমার ব্যক্তিজীবনের প্র্যাকটিসে যে বাঙালিয়ানা আছে – এর কোনটার রিপ্রেজেন্টেশন দেখতে না পাই, আমি প্রশ্ন করতে পারবো না এই অনুষ্ঠানটা নিয়ে?
.
বন্ধ করার বা ভণ্ডুল করার জন্যে নয়, বরং এর মডিফিকেশনের জন্যে?
.
ব্লগিয় 'মুক্তমনা' গোষ্ঠী কি প্রশ্ন করা থেকে আমার খোদাকেও নিষ্কৃতি দিয়েছে কখনো?
.
৫।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে যারাই আছেন, সন্দেহাতীতভাবে নিদারুণ মনঃকষ্টের ভেতর দিয়ে তাদের যাওয়া লাগে। পৃথিবীর সব জায়গায়ই সংখ্যালঘুর এই এক অবস্থা। যদি আমার কোন হিন্দু বোন আজ মাটির সরার ওপর ভগবান শিবের প্রতিকৃতি তৈরি করেন, অথবা কেষ্ট ঠাকুর বাঁশি বাজিয়ে ধেনু চরাতে বেরিয়েছেন, লক্ষ্মীর সরায় এমন প্রতিকৃতি নির্মাণ করেন – আমার পুরো সমর্থন এবং ভালোবাসা তার প্রতি থাকবে।
.
কিন্তু যে মুসলমানের ছেলে বা মেয়ে সারাদিন রোজা রেখে ইফতার করে, মাথায় টুপি বা ঘোমটা দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্যে দিনরাত এক করে কাজ করলো – সেও যেন শিল্পী হিসেবে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে পারে, এবং তার যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু পায়, কোন সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের স্বীকার না হয়, এটাও আমার কামনা।