somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সূতির খালের হাওয়া ৪৪ঃ রবার্ট ব্রুসের মাকড়সা বনাম গ্রিন মডেল টাউনের মাছি

২০ শে মে, ২০২২ সকাল ১০:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মনে করে, সেমিস্টার শেষে পরীক্ষা - অ্যাসাইনমেন্টের চাপে তারা একাই পাগল থাকে। ব্যাপারটা এমন নয়। সময়টা আমাদের, শিক্ষকদের জন্যও একইরকম কষ্ট, এবং চাপের। তাদের কাজ পরীক্ষা দিয়েই খালাস। তারপর আমাদের কাজ শুরু। আনুপুঙ্খিকভাবে প্রতিটা স্টুডেন্টকে অ্যাসেস করা।
.
সারাদিন ধরে আজ পাগলের মতো স্ক্রিপ্ট চেক করতে করতে মাথা যখন ভনভন করছে, স্ত্রী মহাশয় সদাশয় হয়ে এক কাপ চা এনে দিলেন। ডেকোর হরলিক্স বিস্কিটে একটা কামড়, আর চায়ের কাপে একটা চুমুক, খাটের পাশে রাখা সোফায় বসে এই করতে করতে খেয়াল করলাম - একটা ডাঁশা মাছি আমার বারান্দার থাই গ্লাসের সঙ্গে যে নেট দেয়া, সে নেট বেয়ে বেয়ে ক্রমাগত উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। এবং, বেয়ে ওঠার জন্যে তার পা তৈরি নয় যেহেতু, হয়তো সে কারনেই বারবার পড়েও যাচ্ছে নীচে। তারপর আবার উপরে ওঠার অধ্যাবসায়।
.
২।
স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, এই হালকা অবসরকে উৎযাপনের জন্যে আমরা কি গান শুনতে পারি। পরে উভয়ের সম্মতিক্রমে (আসলে আমার ১০ % আর ওর ৯০ % সম্মতিক্রমে) লিন্‌কিন পার্কের ইন দি এন্ড গানটির স্লো ভার্শন ছাড়া হল। শুনতে শুনতে মনে হল, এই যে লোকটি, লিন্‌কিন পার্কের আগের ভোকাল, চেষ্টার বেনিংটন, কি অতুলনীয় খ্যাতিমান ছিলেন। মানুষের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেয়েছেন। বলা হতো - হি ক্যান সিং লাইক অ্যান এঞ্জেল, অ্যান্ড স্ক্রিম লাইকে ডিমন, যে ফেরেশতার মতো সুরেলা গলায় গাইতে পারতো, আর শয়তানের মতো রক্তহীম করা কণ্ঠে চিৎকার করতে পারতো (এটাও প্রশংসা, যারা রক - মেটাল ভোকালিস্টদের ব্যাপারে ধারণা রাখেন না, তাদের জন্যে জানিয়ে রাখা)। এই চেষ্টারকেও আত্মহননের পথ বেছে নিতে হোল দিন শেষে। ক্লিনিক্যালি ডিপ্রেসড ছিলেন। মনের মধ্যে কোন অন্ধকার চোরাবালি জন্ম নিয়েছিল তার দিন কে দিন? আমরা কি জানি তা?
.
৩।
মানুষ কি কখনো স্পনটানিয়াসলি এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে সে আসলে কি চায়? কিসে তার তুষ্টি?
.
ছাত্রাবস্থার পাঁচটি বছর শুধুমাত্র ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের মাষ্টার হওয়া ছাড়া আর কোন স্বপ্ন দেখি নি। রাত্রে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখতাম, কলাভবনের এক্সাম হলে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে, আমার পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেছে, মনজুর স্যার ঝাড়ি দিচ্ছেন প্রচণ্ড। বা কলমের কালি শেষ। কেউ কলম ধার দিতে চাচ্ছে না। কেন এতো প্রচণ্ড মানসিক চাপ তৈরি করে নিয়েছিলাম নিজের জন্যে, এখন হয়তো তার কিছুটা বুঝি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া আমি সামনে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে যাদের পেয়েছি, তাদের রঙেই রঙ্গিন হয়েছে আমার মন। সামনে ফকরুল স্যার ছিলেন, মনজুর স্যার ছিলেন, খোন্দকার আশরাফ স্যার ছিলেন। তাদের অনুকরন করতে চেয়েছি। তাদের মতো হতে চেয়েছি। এই জন্যে নিজেকে দোষ দিই কীভাবে?
.
কিন্তু মনে পড়ে, আমাদের ডিপার্টমেন্টের ক্লাসে বসেই কতজন শিক্ষক আফসোস করেছেন, বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, ঢাবির ইংরেজি বিভাগের এই চাকরী নিয়ে। আমাদের এক শিক্ষক, শেক্সপিয়রের কোর্স নিতেন যিনি অষ্টম সেমিস্টারে, পড়ানোর বদলে প্রায়ই ক্লাসে সেদিনকার ডেইলি স্টারে প্রকাশিত তার ইংরেজি আর্টিকেল নিয়ে আসতেন, আর লম্বা সময় ধরে রিডিং পড়ে শোনাতেন সেটা। ম্যাডাম এখন অবসরে। কিন্তু মনে পড়ে, তার আর্টিকেল পড়ে শোনানোর ফাঁকে ছেলেপেলেরা উসখুস করতে থাকলে উনি প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে বলতেন - আমাদের আফসোস হওয়া উচিৎ, আমরা তার মূল্যায়ন করতে পারলাম না। ওনার এদেশে থাকারই কথা না। ওনার অ্যামেরিকা - অস্ট্রেলিয়া - ইংল্যান্ডের কোন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টারি করার কথা ছিল। হল না বলেই এই মরার দেশের ছাইপাঁশ স্টুডেন্টের মাঝে ফেঁসে গেলেন ।
.
আজ দুপুরে ডেকো হরলিক্স বিস্কিটে কামড়, আর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঐ ম্যাডামের কথাও মনে পড়ে গেলো। যে চাকরী, যে ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনার স্বপ্ন আমাকে অন্তত ছ'টা বছর ঠিকমতো ঘুমুতে দেয় নি রাতে - ম্যাডাম সেই পজিশনকে এতো তুচ্ছ করে দেখতেন!
.
মানুষ আসলে কি চায়, সে নিজে কি তা জানে? বা এ নিয়ে কখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে চূড়ান্তভাবে?
.
৪।
একটু পর আসরের আজান দিলে নামাজ পড়তে যাবো। এলাকায় নতুন মসজিদ হয়েছে। মুসুল্লি বেশী হয় না। একজন বুড়ো চাচা নামাজ শেষ হলে প্রতিদিনের মতো আজও ক্ষীণকণ্ঠে ঘোষণা দেবেন - 'তালিম হবে ভাই, বসেন যে যে পারেন' । তারপর ফাজায়েলে আমালের কিতাব খুলে বসে একটা - দুটো হাদিস শোনাবেন। তারপর সবাইকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত দোয়া করবেন। তারপর হেঁটে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াবেন মসজিদের বারান্দায়। বারান্দা থেকে সামনে গ্রিন মডেল টাউনের বিস্তীর্ণ খালি জমি, গাছপালা, এবং গাছপালা ভেদ করে নীল আকাশ স্পষ্ট দেখা যায়। চাচা প্রায়ই তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে। বাতাসের তোড়ে তার শুভ্র দাঁড়ি অল্প অল্প নড়ে। তিনি কি চেয়েছিলেন তার জীবনে? সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে এই যে নিভৃতচারী মুসুল্লির জীবন, পরকালের প্রস্তুতি - আজ হতে চল্লিশ বছর পিছিয়ে দেয়া যেত যদি তার জীবনঘড়িকে, তিনি কি জীবনের এই পরিসমাপ্তিটিই আশা করতেন? বদলাতে চাইতেন কিছু?
.
৫।
ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিই। প্রচুর খাতা দেখা বাকি। আবারো বসতে হবে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে। আমার ল্যাপটপটা এখন দিনে প্রায় ১২ - ১৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এই পড়াশোনা, ক্লাস নেয়া - খাতা দেখার কাজে। এর মাথাও হ্যাং করবে শীঘ্রই।
.
উঠে দাঁড়ানোর পর আমার স্ত্রীর চোখে পড়ে, স্কটল্যান্ডের সম্রাট রবার্ট ব্রুসের মতো ক্রমাগত লড়ে যাওয়া মাছিটির দিকে। সে এখনও আশায় আছে, যেকোনোভাবেই হোক, বারান্দার নেটের উপরে সে উঠেই ছাড়বে। আমার স্ত্রী তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিতে আগ্রহী হয়ে আমার হাতে মশা মারার চাইনিজ ব্যাটটি তুলে দিয়ে বলে - খতম করো ওকে।
.
আমি ব্যাটটি নিয়ে ওর সামনে দাঁড়াই। মাছিটাকে ঘোরে পেয়েছে কিছু একটা। আমাকে তোয়াক্কাই করছে না। পড়ে যাচ্ছে নীচে, আবারো বেয়ে বেয়ে উপরে উঠছে। উঠতে উঠতে আমার নাক বরাবর এলো যখন, আমি ব্যাটের পাওয়ার অন করলাম। খুব সহজেই এখন ওকে ব্যাটের এক আঘাতে কারেন্টের শকে অক্কা পাওয়ানো সম্ভব।
.
কিন্তু কি একটা মনে করে আমার ওকে মারার ইচ্ছা চলে যায়। আমি বরং নেটটা খুলে দিই। ও ভোঁ করে আমার মাথার চারিদিকে এক চক্কর লাগিয়ে উড়ে বাইরে চলে যায়।
.
জীবনের কাছ থেকে, আমরা যারা ঘোরগ্রস্থ, প্যাশনেট মানুষ - তারা দুরকম আচরণ প্রত্যাশা করতে পারি। এক, নির্মমতা। যেমনটা পেয়েছেন ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ, ফ্রাঞ্জ কাফকা, বা জীবনানন্দ দাস। অথবা, সদয় আচরণ। (এর উদাহরণ আমি দিতে পারবো না)
.
আমি ঘোরগ্রস্থ মাছিটির সঙ্গে আজ সদয় আচরণ করলাম, জীবন আমাকে দয়া পরবশ হয়ে ট্রিট করবে কোন বিপদাপন্ন মুহূর্তে, এই আশায়ই হয়তো।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০২২ সকাল ১০:০৭
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

"জাতীয় ঐক্য" বলতে ড: ইউনুস সাধারণ মানুষের ঐক্যের কথা বলছেন না।

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ভোর ৪:১৬



"জাতীয় ঐক্য" বলতে ড: ইউনুস সাধারণ মানুষের ঐক্যের কথা বলছেন না; ইহার দ্বারা তিনি মুলত: আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলো থেকে "জাতীয় সরকার" গড়ে তোলার কথা বলছেন; তিনি সেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

একুশ বছর

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ভোর ৪:৩৬



একুশ বছর—
সাত হাজার ছয়শত পঁয়ষট্টি রাত
আমি নির্ঘুম— চোখের নিচে কালো দাগ সাক্ষী।
আজও ভেসে ওঠে তোমার প্রিয় হাসিমুখ
আর কাজল কালো এণাক্ষী।

প্রথম যেদিন আমি, তোমার পানে চেয়েছি
তোমার দুচোখে আমি, আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী".....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২২

"বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী".....

ভারতীয় উপমহাদেশ প্রায় ২০০ বছর বৃটিশদের অধীনে ছিলো। দীর্ঘ বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসান হলে আমরা পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেলাম। আবার দুই যুগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশী হিন্দুরা কেন শক্তভাবে কথা বলতে পারছেনা?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:২১


বাংলাদেশের হিন্দুরা বলতে গেলে ৯৫ পার্সেন্ট আম্লিগকে ভোটি দেয় ইহা ধ্রুবসত্য। অনেকেই হয়তো দ্বিমত পোষণ করতে পারে সেটা তার নিতান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। তারা সবসময়ই ভাবে আম্লিগ তাদের রক্ষাকর্তা কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্বে ভুয়া তথ্য ছড়ানোয় শীর্ষে ভারত

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৪




বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়ানো দেশের তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারত। মাইক্রোসফটের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর ছড়ায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×