somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

২০২৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কোরিয়ান লেখক হান ক্যাং - এর মনন ও সৃজনশীলতার জগত

১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৪:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার সময়ই নোবেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে হান ক্যাং নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন গভীর কাব্যিক গদ্যের মধ্য দিয়ে মানব জীবনের ভঙ্গুরতা ও স্মৃতির গহীনে বয়ে বেড়ানো বিবিধ ঐতিহাসিক ভীতির চিত্রায়নে। তবে যখন আমরা জানতে পারি যে হান ক্যাং-এর বয়স মাত্র ৫৩, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার খ্যাতি ২০১৬ সালে থেকে, তার অনূদিত উপন্যাস দা ভেজিটেরিয়ানের বুকার পুরস্কার জয়ের সূত্র ধরে, তখন নড়েচড়ে বসতে হয়। নোবেল - আন্তর্জাতিক সাহিত্যাঙ্গনে সবচে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। সারাজীবন ধরে নিষ্ঠার সাথে সাহিত্যচর্চা করে, পৃথিবী কাঁপানো সাহিত্যকর্মের জন্ম দিয়েও লিও তলস্তয়, ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েস, রবার্ট ফ্রস্ট, মিলান কুন্দেরা থেকে নিয়ে হালের হারুকি মুরাকামির মতো কবি - কথাসাহিত্যিকেরা নোবেল পুরস্কারের জয়তিলক কপালে সাঁটাতে পারেন নি। তাহলে হান ক্যাং তার তুলনামূলক হ্রস্ব এ সাহিত্যিক ক্যারিয়ারে ঠিক কি নিয়ে লিখলেন, বা মানবজীবনের কোন জটিল, গভীর প্রশ্ন তুলে ধরলেন নিজ লেখায় যে তাকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব হল না নোবেল কমিটির পক্ষে? এ ব্যাপারগুলো আমাদের ভাবায়।

হান ক্যাং এর তৈরি সাহিত্যমানস সম্পর্কে ধারনা নিতে এ তথ্যটুকু জানা থাকা প্রয়োজন যে, হান ক্যাং এর বাবা হান সিয়ুং ওন নিজেও কোরিয়ায় একজন সমাদৃত কথাসাহিত্যিক, যিনি এখনো জীবিত। বুকার প্রাইজ বিজয়ের পর দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কন্যা হান এ কথা উল্লেখ করেছেন যে, সাহিত্য রচনার শিক্ষামূলক কোন সেশন তিনি তার বাবার কাছে সেভাবে কখনো পান নি, কিন্তু বাবার যে বিশাল লাইব্রেরীতে বইয়ে পরিবেষ্টিত থেকে তিনি তার শৈশব - কৈশোর কাটিয়েছেন, হানের লেখক হয়ে ওঠার পেছনে সে লাইব্রেরীর ভূমিকা আছে। হান ১৪ বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি লিখবেন। নিশ্চয়ই ততোদিনে হান আবিস্কার করেছিলেন যে, তার বাবার বেশিরভাগ সাহিত্যকর্ম বাবার জন্ম এবং বেড়ে ওঠার শহর 'জেংঘাং' কে ঘিরে। নিজের চোখে দেখা, নিজ কানে শোনা, ব্যক্তিঅভিজ্ঞতাপ্রসূত উপলব্ধির সূত্রে যে শিল্প বা সাহিত্যের জন্ম, তা-ই মহৎ ও সত্য, সম্ভবত নিজের সাহিত্যিক বাবার ফুটপ্রিন্ট অনুসরণ করে শৈশবে বা কৈশোরেই সেটা হানের অবচেতনে গেঁথে গিয়েছিল।

১৯৯৩ সালে, স্থানীয় সাহিত্যপত্রিকার পাতায় ২৩ বছর বয়সে প্রথম পাঁচটি কবিতা, পরবর্তী বছর একটি গল্প, এবং তারপরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাসে জীবনের ছোটখাট অভিঘাতগুলো সঞ্চারিত হলেও হান ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছিলেন তার ব্যক্তিজীবনে মুখোমুখি হওয়া সবচে বড় ট্রমাকে সৃজনশীল উপায়ে মোকাবেলা করার জন্য।

হানের জন্ম ও শৈশব কাটে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে হান সপরিবারে সে শহর ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে থিতু হন। তার ঠিক চার মাসের মধ্যে হানের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত শহর গোয়াংজুতে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনতা আন্দোলন শুরু করে। হানের ভাষ্যে, সে লড়াই ছিল - "কনফ্রন্টেশন অফ টু এক্সট্রিমিস্ট" বা দুই চরমপন্থি দলের লড়াই। ক্ষমতার লড়াই যার যার মধ্যেই সংঘটিত হোক না কেন, তাতে আদতে প্রাণ যায় সাধারণ মানুষের। সরকারী নথিতে ২০০, আর বেসরকারি হিসাবে হাজারেরও বেশী মানুষ প্রাণ হারায় ১৯৮০ সালের সে লড়াইয়ে। তাদের কেউ কেউ ছিলেন হানের পরিচিত। এ বিষয় উপজীব্য করে লেখা হানের তীব্র মানবিক ও আবেগি অভিঘাতসম্পন্ন উপন্যাসটির নাম "হিউম্যান অ্যাক্টস"। মানুষ কি? ব্যক্তিমানুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া কি? দুঃখ কেন মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ? - এরকম যে প্রশ্নগুলো, হানের নিজের ভাষ্যে, তাকে তাড়িয়ে ফিরেছে শৈশব থেকে, একদম খোলামেলাভাবে, নিজেকে উজাড় করে দিয়ে এসকল জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেন তিনি নিজেকে, এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত এক উপন্যাসে। হান কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন তার উপন্যাসিক বাবার কথা, যিনি হানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, কষ্ট করে হলেও হান যেন তার এই শৈশবের ভীতির মুখোমুখি হন, উপন্যাসটি লিখে শেষ করেন।

হানের মূল খ্যাতি অবশ্য তার পূর্বের উপন্যাস দা ভেজিটেরিয়ানের জন্য। কোরিয়ান আধুনিক কবি ই স্যাং এর লেখা এবং দর্শন হানকে প্রভাবিত করেছিল তার প্রস্তুতির দিনগুলি থেকে। ই স্যাং, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপান কর্তৃক যে ঔপনিবেশিক অত্যাচার কোরিয়া সহ্য করেছে, তারই অভিঘাতে নিজের এক কবিতায় লিখেছিলেন - 'আমি বিশ্বাস করি, মানুষের উচিৎ ধীরে ধীরে বৃক্ষে পরিণত হওয়া।' হান ক্যাং এর বুকার পুরস্কার জয়ী উপন্যাস দা ভেজিটেরিয়ানে এই দর্শনের ছায়া অনুভব করা যায়। সহিংসতাপ্রসূত মানসিক ট্রমার শিকার এক নারীর খাবার টেবিলে মাংস খেতে অস্বীকৃতি জানানোর মধ্য দিয়ে যার শুরু, যে নারী এক পানি বাদে সবরকমের কঠিন খাবার খাওয়াই বন্ধ করে দেন পরবর্তীতে। মানুষের নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে এক নারীর নিজের খাদ্যাভ্যাসে এরকম অস্বাভাবিক পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্তে তার পুরো পরিবারে ভাঙ্গন ধরে। হান নিপুণ দক্ষতায় কোরিয়ান পারিবারিক জীবনের ভঙ্গুরতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন এ উপন্যাসে।

ভালোবাসা মানুষের জীবনের মুখ্য চালিকাশক্তি, নির্মম - রসকসহীন পৃথিবীতে আরও একটি দিন শুরু করবার রসদ। হান দাবী করেন, তিনি বেশ পরিণত বয়সে এসে ভালোবাসার মানে খুঁজে পেয়েছেন। কথাটা শুনতে খেলো লাগে, কিন্তু এটাই সত্যি। তার উপন্যাস 'দা গ্রিক লেসনস' এ দুজন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের খোঁজ মেলে, যাদের একজন কথা বলতে পারে না, অপরজন ক্রমশ নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছে। গ্রীক ভাষা শিখবার মাধ্যমে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তারা একত্রে একে অপরের যাপিত জীবনের ভীতিপ্রদ সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়, মোকাবেলা করে।

হান বলেন, তার গদ্য কাব্যে আক্রান্ত। এবং এই কাব্যিকতা সচেতন নয়, বরং অবচেতনে অনুপ্রবেশ করে, দখল করে নেয় তার গদ্যের পৃথিবী। কবিতা লিখেই সাহিত্যের জগতে তার প্রথম পদার্পণ। কবিতা তিনি সচেতন প্রয়াসে লিখতেন না, বরং - তা তার অবচেতনের ফসল। স্বপ্নে কুড়িয়ে পাওয়ার মতো করে একেকটা বাক্য এসে ধরা দিতো তার লেখার খাতায়। এখনো, তার জটিল গল্পের বুনোটের মাঝে ভাষার কাব্যিকতা ঠিক সেভাবেই দখলদারের মতো ঢুকে পড়ে।

হান ক্যাং এর সাহিত্য এখনো খুব বেশী পরিমাণে অনূদিত হয়ে বাংলা ভাষার পাঠকদের হাতে পৌঁছায় নি। বাদবাকি নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকদের তুলনায় তিনি এখনো বেশ তরুণ। আয়ু থাকলে লিখবেন আরও অনেক নিশ্চয়ই। তবে ঔপনিবেশিক স্মৃতি, সহিংসতা, নারীঅভিজ্ঞতার জগত - ইত্যাদি বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে ইতোমধ্যেই তিনি যে সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন, তার বিষয়বস্তু ও বুনন খুব অসাধারণ, অভূতপূর্ব কিছু নয়। খুঁজলে বিশ্বসাহিত্যে তো বটেই, আমাদের সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যেও হান ক্যাং এর সমমান ও বিষয়বস্তুর সাহিত্য হয়তো পাওয়া যাবে। কোরিয়ান গান, সিনেমা, টিভি সিরিজ বর্তমান বিশ্বে হটকেকের মতো বিকোচ্ছে। কোরিয়ান সংস্কৃতির এ রমরমা যুগে কোরিয়ান সাহিত্যকে বিশ্বে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, এমন একজন নারী উপন্যাসিককে তুলে আনাও নোবেল কমিটির লক্ষ্য হয়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে হানের পুরস্কার লাভের যৌক্তিকতা বিচার আমাদেরকে সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। একজন নোবেল পুরস্কার বিজেতা আসলেই তার দাবীদার ছিল কিনা, তা বুঝতে মোটামুটি বেশ কয়েক দশক অপেক্ষা করা লাগে। যদি সে পরীক্ষণকাল পেরিয়ে হানের সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যের বোঝাপড়ায় অবশ্যপাঠ্য সাহিত্যের তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে, তবেই তার নোবেল পুরস্কার বিজয়ের যৌক্তিকতা অনুধাবন করা সম্ভব হবে।

আমরা বরং আপাতত সামনের বছর, অর্থাৎ ২০২৫ এর জানুয়ারিতে তার সর্বশেষ (২০২১) রচিত উপন্যাস "উই ডু নট পার্ট" এর ইংরেজি অনুবাদ বাজারে আসার অপেক্ষায় থাকতে পারি।




সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৪:২৯
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভারত অনেক চেষ্টা করেও দ্বিমুখী আক্রমণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:০৮



সামু ব্লগে ৪ জন ভারতীয় একটিভ ব্লগার আছেন; এরা সামু থেকে সম্ভাব্য আক্রমণের কথা নিশ্চয় ভারত সরকারকে জানাচ্ছে। সামুতে যেই পরিমাণ জেনারেল আছেন ও যেই পরিমাণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৩




বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দাবি করে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের (বিজেপি) নেতা দিলীপ ঘোষ। এছাড়া বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তিনি। শুক্রবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩



বাংলাদেশে হামলার চেষ্টা করতে পারে সন্ত্রাসীরা— এমন আশঙ্কা থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের সতর্ক করেছে যুক্তরাজ্য।

কোথায় সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে নির্দিষ্টভাবে তা বলা না হলেও রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানে ভ্রমণ থেকে বিরত... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে প্রেমে অশ্রু ঝড়ে

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৪৫


মিষ্ট কথার স্মৃতিতে মন যার ভরে না
সুখ স্বপনের স্মরণে হৃদয় যার ঝরে না
যাদের চোখে অকারণ অশ্রুর ধারা বয়
রাতের বাতাসে জাগে না যার হদয় ।

পল্লী সমিতির বিদ্যুতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা মিলে আমাদের একটি বড় রাষ্ট্র ছিল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:০৭



ইংরেজ হানাদারের আগে আমাদের বাংলা বিহার ও উড়িষ্যা মিলে একটি বড় রাষ্ট্র ছিল। সেই রাষ্ট্র হারানোর পিছনে অনেকে মীর জাফরকে অনেকাংশে দায়ী করেন। একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×