গল্প বাঙ্গালীর জীবন যাপনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। ছোট বেলায় মা খালাদের কাছ থেকে শোনা রূপকথার গল্প দিয়ে যার শুরু। পারিবারিক আড্ডায়, কাজের অবসরে, বন্ধুদের আড্ডায় সবখানেই আছে গল্প। বাংলা সাহিত্যেও বিশাল জায়গা দখল করে আছে ছোট গল্প। তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি এবং সহজলভ্যতার কল্যাণে মুদ্রিত সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি অন্তর্জালে সাহিত্যচর্চা ইদানিং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সামহোয়্যার ইন ব্লগে প্রতি মাসে প্রায় কয়েকশ ছোট গল্প প্রকাশিত হয়। যার অধিকাংশ গল্পই উঁচু মানের। ব্যস্ততার কারণে অনেকগুলো ভালো লেখা পড়া হয়ে উঠেনি। যে কয়েকটা গল্প পড়েছি তার মধ্য থেকে আমার ভালো লাগা ছয়টি গল্প সম্পর্কে লেখার চেষ্টা করছি এই পোস্টে।
এ মাসে প্রকাশিত গল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগা গল্পের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে, হাসান মাহবুব ভাইয়ের "পেপার কাপ" । এটাকে শুধু গল্প বলাটা মনে হয় অন্যায় হবে। একজন দক্ষ শব্দ কারিগরের হাতে নিখুঁত ভাবে বোনা শব্দের নকশী কাঁথা। যার প্রতিটি ফোঁড়নে শৃঙ্খলিত হয়েছে ঘোরলাগা কিছু শব্দমালা। শুধু শব্দকেই নয় গল্পে শৃঙ্খলিত করেছেন পাঠককেও শব্দের শৈল্পিক কারুকার্যে। গল্পে উঠে এসেছে একজন শব্দ শিকারির শব্দ শিকারের আত্মকথন। মহাবিশ্বের চারিপাশে ঘুরতে থাকা শব্দগুলোকে শৃঙ্খলে বেঁধে কখনো তুলেছেন নূপুরের রিনিঝিনি ছন্দ আবার কখনো বিচ্ছেদের করুণ সুর। কাগজের পেয়ালায় ধারণ করেছেন ঐশ্বরিক আলোর দ্যুতি ছড়ানো মাতাল শব্দমালা। কিন্তু জাগতিক চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ করে অপার্থিব শব্দমালার স্বপ্নিল জগত ছেড়ে একসময় লেখককে ছুটতে হয় কঠিন বাস্তবতার পিছে। একসময় মায়াময় শব্দগুলোর জায়গায় স্থান করে নেয় পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার কর্কশ শব্দের দল। যে চোখ মুগ্ধ হয়ে দেখেছে ঝরনার নির্মল বারিধারা , সে চোখ কি বদ্ধ ডোবার নোংরা পানি দেখে সন্তুষ্ট হতে পারে। তাই লেখককে আবার ফিরে যেতে হয় স্বপ্নিল শব্দের জগতে। জাগতিক জগতকে পেছনে ফেলে স্বপ্নময় জগতের হাতছানিতে লিখে ফেলেন রাতের সেরা কাব্য - "আমি আর চাকুরী করবো না। আমি শব্দ পরিভ্রমনে বের হবো পৃথিবীর চারিপাশে। আমি শব্দের শৃঙ্খলে নিজেকে আবদ্ধ করে পান করবো চিরমুক্তির অমীয় পানীয়। তারপর আমি হারিয়ে যাবো। হারিয়ে যাওয়াটাই আমার নিয়তি"। লেখাগুলো কখনো পৌছায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আবার কখনো হারিয়ে যায় শত সহস্র শব্দের ভিড়ে।
এই মাসের ছোট গল্পগুলোর মধ্যে আমার পড়া সেরা গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্লগার মামুন রশিদ ভাইয়ের লেখা গল্পঃ জীবনের সপ্তসুর। মামুন ভাইয়ের চমৎকার লেখনীতে গল্পটিতে জীবনের সপ্তসুর বেজেছে সুললিত সুরে। গল্পটি মূলত বাবা এবং মেয়ের ভালোবাসার বন্ধনের। যে ভালোবাসায় প্রয়োজন নেই রক্তের বন্ধন। যে ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি কোন জাত কিংবা ধর্মের বেড়াজাল। গল্পের প্রধান দুটি চরিত্র আলোই এবং তার বাবা জইল্যা। এই দুটি চরিত্রের পাশে আবর্তিত অন্যান্য চরিত্রগুলোও উজ্জ্বল ছিল লেখকের বর্ণনায়। গল্পটি লেখা হয়েছে গল্প বলার ঢঙে। লেখক এখানে গল্প বলার ভূমিকায় অবতীর্ণ। গল্পের প্রথমেই উঠে এসেছে দুরন্ত কৈশোর জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রথমেই গ্রামের চিত্র, মূল চরিত্র আলোই, আলোই আর মন্নার দস্যিপনার বর্ণনা এতটাই ডিটেইল ছিল যে গল্পটি পড়ার সময় সেই চিত্রগুলো যেন চোখের সামনেই ভেসে উঠেছে। গল্পটা যতই এগিয়েছে ভালো লাগার রঙ ছড়িয়েছে চক্রবৃদ্ধি হারে। গল্পের ষষ্ঠ প্যারাতে আসে গল্পের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র জইল্যা। জইল্যা ডাকাত যিনি হাওড় পাড়ের মানুষগুলোর কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। জইল্যা ডাকাতের আগমনের পর থেকেই গল্পটি মোড় নেয় অন্য দিকে। এই অধ্যায়ে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধে হাওড় পাড়ের মানুষগুলোর জীবনের করুণ চিত্র। হানাদার বাহিনী কর্তৃক নৃশংস গনহত্যা, রাজাকার বাহিনীর লুটতরাজ। জইল্যা ডাকাতের রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের হাতছানিকে উপেক্ষা। লুটের উদ্দেশ্য নিয়ে মাকালকান্দি গ্রামে পৌছলেও , হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা দেখে বদলে যায় জইল্যা ডাকাত। মৃত মায়ের লাশের পাশে কান্নারত আলোই কে নিয়ে আসেন নিজের সঙ্গে করে। জইল্যা ডাকাত থেকে হয়ে উঠেন একজন পিতা। এমনি করে সময় চলতে থাকে, আলোই বড় হয়। একসময় বিয়ে হয়। বিয়ের পর আলোই ফিরে আসে আলো রানী দাশ হয়ে। কিন্তু পিতা আর কন্যার ভালবাসা থাকে অটুট। গল্পের শেষে আলোই তার বাবার কাছ থেকে তার মায়ের শেষ স্মৃতি হারমোনিয়ামটা চায় আলোই। উত্তরে জইল্যা ডাকাত বলেন, "এইটা খালি তোর মায়ের স্মৃতি না, এইটা আমার মায়েরও একমাত্র স্মৃতি" । এই একটি লাইনই যেন গল্পের প্রাণ। এই একটি লাইনই যথেষ্ট পুরো গল্পটাকে ফুটিয়ে তুলতে।
জুন মাসের প্রকাশিত ভালো লাগা গল্পের অন্যতম ব্লগার বৃতির ।। তুমি কি কেবলই ছবি?। মহান চিত্রশিল্পীর রং তুলির আঁচরে রাঙ্গানো চিত্রকর্ম কখনো কখনো কথা বলে। কিন্তু শব্দ কারিগরের বোনা শব্দেও যে চিত্রকর্ম কথা বলে এ কথা জানতে অবশ্যই ব্লগার বৃতির গল্পটা পড়ে দেখতে হবে আপনাকে। অনন্য শব্দচয়ন আর তার উপযুক্ত প্রয়োগে তিনি তার গল্পের বাক্যগুলোকে করে তুলেছেন একেবারে জীবন্ত। যেমন ---- তোমার মুগ্ধচোখ দেখলাম তখন- জানালা বেয়ে পিছলে আসা সোডিয়াম লাইটের আলো জোৎস্না বলে ভ্রম হয়, নিমগ্ন চন্দ্রমায় গালে আঙুল ছুঁয়ে বললে, "তুমি সুন্দর।" কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই, হঠাৎ করেই সেমুহুর্তে, তোমাকে অনুমতি দিয়ে দিলাম আমার মনের উপর দখলদারিত্বের।
আতঙ্কিত আমি তখুনি, হৃদয়ের সবক'টি দুয়ার বন্ধ করে দেই- চারপাশে সূক্ষ্মভাবে সেলাই করি, রেশমি পোকার কাজের মত। আমার শরীর নিখুঁত ছিল! আমার অনুভূতিগুলোর মত- কোমল, স্পর্শকাতর!
একজন শিল্পীর সৃষ্টি একটি ছবি - ছবিটির জীবন্ত হয়ে ওঠা - তারপর নিজের স্রষ্টার প্রেমে পড়ে যাওয়া - একসময় আবিষ্কার করা যে শিল্পী যে মেয়েকে ভালোবাসতো তার আদলে তাকে তৈরি করেছে - তখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে হতাশা। শিল্পী ভাস্কর্যটিকে তৈরি করেছেন তার হৃদয়ে অংকিত অন্য এক নারীর কথা মনে করে। এবং সেটা যখন ভাস্কর্য/ছবিটি জেনে ফেললো; সে এক গভীর মর্মবেদনায় আক্রান্ত হলো। গল্পকার যেমন বলছেন তার গল্পে, ভাষাহীন আমি ব্যাস্ট শুধু পাথরমানবী হয়ে থাকি। তোমার ছায়া হয়ে তোমাকেই ছায়া দিয়ে রাখি। এলোমেলো রাত। কিছু রঙ। অনন্ত প্রতীক্ষা এক। সবশেষে বলতে হয় নিশ্চিতভাবে গল্পটি আপনাকে মুগ্ধতার আবেশে আটকে রাখবে।
জুন মাসে প্রকাশিত গল্পের মধ্যে অন্যতম ব্লগার শুঁটকি মাছ এর গল্পঃ উৎসবের শহরে দুমড়ানো নারীদেহ । লেখক গল্পের ভিতর তুলে এনেছেন আলোক উজ্জ্বল ঝলমলে আলোর ভিতর লুকিয়ে থাকা অন্ধকারের করুণ দিককে। বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের এক কিশোরীর জীবনের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণ লেখনীতে। গল্পটি মূলত তের বছরের এক কিশোরী পতিতার জীবনের গল্প। তের বছরের কিশোরী আমান্ডা যাকে বিশ্বকাপের বিলিয়ন ডলারের বানিজ্য কিংবা ফুটবল উন্মাদনা কোন কিছুই স্পর্শ করে না। যার কাছে বিশ্বকাপ মানে আলোক উজ্জ্বল শহরে শত সহস্র পর্যটকদের ভিড়ে গ্রাহক খুঁজে ফেরা। পুরো গল্পটাই হৃদয় স্পর্শ করার মত। আমান্ডার প্রথমবার পতিতা হবার কাহিনী, গর্ভপাত, ফুটবল নিয়ে আমান্ডার ভাবনার চমৎকার বর্ণনায় প্রাণবন্ত হয়েছে গল্পটা। উৎসব আসে উৎসব যায়, আলোক ঝলমল সময়গুলোকে সবাই মনে রাখে কিন্তু কালের অতল বিস্তৃতিতে হারিয়ে যায় আমান্ডারা। তাদের কথা কোথাও লেখা থাকে না। গল্পটিকে কমপ্লিমেন্ট দিতে হলে বলতে হয় - , ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়: পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি॥
জুন মাসে প্রকাশিত গল্পের মধ্যে ভালো লাগা আর একটি গল্প ব্লগার ডি মুন এর আত্মহননের আগে। গল্পটি মূলত জীবনের দৌড় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া এক যুবকের আত্মকথা। লেখক এখানে সমাজের সাফল্যের মানদণ্ডে পরাজিত যুবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শুনিয়েছেন তার জীবনের উত্থান পতনের করুণ কাহিনী। যার কাছ থেকে এক এক করে দূরে চলে যেতে থাকে আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব। প্রিয়জনেরা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করে , তুমি একজন অসফল। প্রতিযোগিতার এই সমাজে তুমি মূল্যহীন। সমাজ থেকে প্রত্যাক্ষিত হয়ে এক সময় হতাশায় ডুবে আত্মহননের চিন্তা করতে থাকে সে। আত্মহত্যার পথে পা বাড়ানোর পর থেকেই গল্পটি মোড় নেয় অন্যদিকে। সমাজের মানদণ্ডে অসফল যুবকটি এবারো অসফল হয়। তবে এবার সে অসফল হয় ভালবাসার জন্য, দায়িত্বের জন্য। যদিও এ সমাজে ভালবাসা , দায়িত্বের গুরুত্ব মূল্যহীন। গল্পে লেখকের শব্দ ব্যবহারের মুন্সিয়ানায় ঘোর লাগা সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। গল্পের শেষটা আশা জাগানিয়া।
এ মাসের আমার ভালো লাগা আর একটি গল্প ব্লগার নক্ষত্রচারীর স্বপ্নতত্ত্ব । টুইস্ট এ ভরপুর এই গল্পটিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে টান টান উত্তেজনা। গল্পের শুরুতেই গল্পের প্রধান চরিত্রকে দেখা যায় দুঃস্বপ্ন থেকে রক্ষা পেতে সাইকিয়াট্রিস্ট এর শরণাপন্ন হতে। সাইকিয়াট্রিস্ট এর পরামর্শমত ওষুধ সেবনেও দুঃস্বপ্ন পিছু ছাড়ে না তার। দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইফতেখারকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা চলতেই থাকে। অবশেষে স্বপ্নকে শুধুমাত্র স্বপ্ন না ভেবে ভবিতব্য কোন বিপদের আশংকায় বন্ধুকে সাবধান করার প্রয়াসে ছুটে যায় বন্ধুর কাছে। বন্ধুকে না পেয়ে বন্ধু পত্নীকে জানায় স্বপ্ন এবং আশংকার কথা। গল্প এগিয়ে চলে উত্তেজনা নিয়ে। গল্পে প্রথম টুইস্ট আসে আবার সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে আসার পরে। ডাক্তারের ঠিকানায় এসে জানতে পারে এখানে এই নামের কোন সাইকিয়াট্রিস্ট নেই। স্বপ্ন আর বাস্তবিকতার মাঝে বিভ্রম সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই। স্বপ্নটাই শেষে এসে বাস্তব রুপ নেয়, বন্ধু ইফতেখার এর গলা কাঁটা লাশ পাওয়া যায় শীতলক্ষ্যায়। বন্ধু হত্যার অভিযোগে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। গল্প শেষ হয় আর একটা টুইস্ট দিয়ে------- এই টুইস্টটা না হয় নাই বলা হোক। গল্পটি পড়ে দেখুন আশাহত হবেন না এইটুকু বলতে পারি।
সামহোয়্যার ইন ব্লগে প্রতিদিন এত ভালো ভালো লেখা প্রকাশিত হয় , একজন পাঠকের পক্ষে সবগুলো লেখা পড়ে তার সম্পর্কে মতামত তুলে ধরা সম্ভবপর নয়। আমার পড়া গল্পগুলো থেকে ভালো লাগা ছয়টি গল্প সম্পর্কে এখানে লেখার চেষ্টা করেছি। আশাকরি আপনারা আপনাদের ভালো লাগা গল্প নিয়ে মন্তব্য করে পোস্টটিকে সমৃদ্ধ করবেন।
উৎসর্গঃ মামুন রশিদ ভাই এবং মাহমুদ ভাই। যাদের প্রেরণা এবং উৎসাহে মূলত এই পোস্টটির জন্ম।
কৃতজ্ঞতাঃ কাল্পনিক_ভালোবাসা , ডি মুন , মাহমুদ০০৭ যাদের পরামর্শ, উপদেশ এবং সহযোগিতা পোস্টটিকে সম্পূর্ণ করেছে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ২:৫৯