somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিস্তল...

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাবাকে বললাম, পিস্তল কিনব।
উনি ধমকের স্বরে বললেন, কী?

আমি সাহস হারিয়ে ফেললাম। জানতাম রাত দিন কাঁদলেও উনি আমাকে পিস্তল কিনে দেবেন না। গত দুই বছর ধরে এ আবদারের এমনই জবাব দিতেন তিনি। আমি আশাহত হয়ে ভাবতাম, আর একটু বড় হই। তাহলে হয়ত আর না করতে পারবেন না। ওয়ান, টু পেরিয়ে ক্লাস থ্রিতে পড়ছি। অথচ বাবার ধমকের কোন পরিবর্তন নেই।

বাবার বাম হাতের আঙুল ধরে প্রায় আধাঘণ্টা ধরে দোকানে দোকানে ঘুরলাম। ঘুরে ঘুরে অনেক কিছু কিনে দিলেন। ইয়া লম্বা লেজওয়ালা কদুর মত বেলুন, প্লাস্টিকের বাঁশি, বাঁশের বাঁশি, বেলুনওয়ালা বাঁশি, কাঁচের রকেট, সবুজ রঙের টেনিস বল, প্লাস্টিকের বাস, কাগজের চশমা, কাগজের ফ্যান আরও কত কি! বাবা একটা খেলনার দোকানের পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে আরও কিছু কিনতে গেলেন। আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। ব্যাগে রাখা খেলনায় চোখ বুলিয়েও শান্তি পাচ্ছিলাম না। সবকিছু ছাপিয়ে আমি কেবল পিস্তলের কথাই ভাবছিলাম। হঠাৎ বাম পাশের দোকানটায় চোখ গেল। আমার বয়সী একটা ছেলের হাতে টিনের সাদা পিস্তল। বিকেলের রোদে ওটা যেন ঝলমল করে উঠছে। গুলি করার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।

আমি ওর কাছে গেলাম। বললাম, আমাকে দাও, দেখিয়ে দিই। ছেলেটা পিস্তল আমার হাতে দিল। স্প্রিং এর হিটার বরাবর বারুদ রেখে ট্রিগারে চাপ দিলাম। ফট করে আওয়াজ হল। বারুদের গন্ধ নাকে এসে ভাললাগা খেলা করল মনের ভেতর। কত মজা! আমি ফায়ার করতে পারি!

দোকানের সামনে লোক সমাগম বাড়তে লাগল। ভীড় ঠেলে আগের জায়গায় এসে দেখি আমার খেলনার ব্যাগটা নাই! আমি তো হতভম্ব! হায়! আমার এতগুলো খেলনা। কোন চোরে নিল? কি করব কিছুই বুঝলাম না। বাবা এলে নিশ্চিত ইচ্ছেমত বকবে। কোথায় ফেলেছি ব্যাগ মনে করতে পারলাম না। বাম পাশের দোকানের সামনে গেলাম, পেলাম না। বুকের ভেতরে শত শত রাউন্ডের ফায়ারের শব্দ আতঙ্কগ্রস্ত করে ফেলল আমাকে। বাবা ফিরে আসার আগেই যে করে হোক ব্যাগ খুঁজে পেতেই হবে। অনেক খুঁজেও পেলাম না। এত মানুষের ভীড়ে কোথায় খুঁজব আমি?

স্রোতের মত মানুষ যাওয়া আসা করছে। কাকে জিজ্ঞেস করব আমি? ভাবলাম বাবা দেরি করে আসুক। এর মধ্যে যদি পাওয়া যায়। একই জায়গার মধ্যেই ঘোরপাক খেলাম, তবুও কিছু মিলল না। খেলনা হারানোর কষ্টে মেলাটা আমার কাছে শোক দিবসে পরিণত হল। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন আমার কাধে মৃদু টোকা দিল। পেছনে ঘুরে দেখি বাবা! আমি হতভম্ব। এতগুলো খেলনা হারিয়েছি নিশ্চয় খুব বকবেন। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার বাবা বকলেন না।
ধমকের সুরে বললেন, ব্যাগ ফেলে কোথায় যাও তুমি? মন কোথায় থাকে?

একি! বাবার হাতে ব্যাগ এল কি করে? আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। উনার হাতে থাকা আরেকটি পলিথিনের ব্যাগ থেকে জিলাপি বের করে আমাকে খেতে বললেন। এর মাঝে আর কোন কথা হল না।

বাবার সাথে বাড়ি ফিরছি। তখনো মাগরিবের আযান দেয়নি। মেলাও শেষ হয়নি। আরও থাকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বাবার গম্ভীর মুখের দিকে চেয়ে নিজের ইচ্ছেটা অপ্রকাশিতই রয়ে গেল। রাস্তা ধরে হাঁটছি আর মাথার মধ্যে চকচকে পিস্তল, বারুদের গন্ধ আর ফায়ারিং এর ঠাস ঠাস শব্দ খেলা করছে। বাবাকে আস্তে করে ডাকলাম, আব্বা।

উনি শুনলেন নাকি না শোনার ভান করলেন বুঝলাম না। আবার ডাকলাম, এবারও একই অবস্থা। বুঝলাম মাঝপথে কোন আবদার তিনি শুনতে চান না হয়ত। কথা বলার সুযোগ না পেয়ে নিরবে হাটতে লাগলাম। আমার হাতে কত খেলনা। অথচ এর সবকিছুই কেমন যেন অর্থহীন মনে হচ্ছে। শুধু একটা পিস্তল কিনে দিলেই এত খেলনার চেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম। মানুষ মাঝে মাঝেই এমন হয়, সব কিছু থাকলেও নির্দিষ্ট একটা কিছুর জন্যই বেশি আকুল হয়ে পড়ে।

সেটা ছাড়া মূল্যহীন হয় সব আকাঙ্ক্ষা। আহারে এই মেলায়ও আমার পিস্তল কেনা হল না। এর চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই। বাম পকেটে আছে দুটা দুই টাকার নোট, একটা এক টাকার কয়েন। পিস্তল কিনতে আরও পনেরো টাকা লাগবে। বিশ টাকার এক পয়সাও কম নয় যে। গত মেলায় শামীম বিশ টাকা দিয়েই কিনেছিল। আমার ভেতরে যে কতটা খারাপ লাগা ছেয়ে যাচ্ছে বাবা তা কখনোই টের পাচ্ছেন না।
কোথাও ভ্যান ট্যান কিচ্ছু পেলাম না। বাধ্য হয়ে পুরো রাস্তাই হেটে আসতে হল। বাড়িতে এসে দেখি মা উদগ্রীব হয়ে আছেন আমার জন্য। ব্যাগ থেকে বের করে দেখতে লাগল কি কি খেলনা কিনেছি। খুব আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগল। আমার মধ্যে কোন আনন্দই কাজ করল না। মা এটা খেয়াল করল। বলল, কিরে, তোর মন খারাপ?
- না মা।
- এত খেলনা নিলি তাও মন খারাপ?
আমি হালকা হাসিমুখ করে তাকিয়ে আছি মার দিকে। মা আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, কি হইছে, ক ত?
- কিছুনা মা।

মা এবার তার আঁচলের গিট খুলে মুড়ে যাওয়া পাঁচ টাকার পাঁচটা নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এক দৌড়ে যাবি, পিস্তল কিনেই এক দৌড়ে চলে আসবি। কোন দেরি করবি না কিন্তু। যা।

আমি আর কোন দিক না তাকিয়ে, মার গালে একটা চুমু দিয়ে সোজা দৌড় দিলাম ঘাট তিলকপুরের মেলার পানে। আহা কি মজা। আজ আমার পিস্তল কেনা হবে। মনে মনে বললাম, মা তুমিই আমার একমাত্র প্রশ্রয়দাতা, আমার শেষ আশ্রয়। ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৩৪
৮টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×