'পারসোনা' বিউটি সেলুন, নারীদের নির্ভরতা আর আস্থার এক অদ্বিতীয় নাম। আর এর কর্ণধার কানিজ আলমাস খান, যিনি সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধার পাত্র, তার প্রতিষ্ঠান যখন 'সৌন্দর্য্য' কে নারীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বলে ফলাও করে প্রচার করেন, তখন আসলে কোন আশায় থাকে না এই সমাজের কাছে। এখনো নারীকে বিচার করার মূল মাপকাঠি যে কেবলই তার বাহ্যিক সৌন্দর্য্য, সেটা সত্যিটাই পুনরায় প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়।
যে নারী নানা প্রতিকূলতা পার করে সন্তান লালন করে, যে নারী তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পৃথিবী জয় করে, যে নারী তার সাহসিকতার জোরে দূ্র্গম পাহাড় জয় করে, শত্রুর মোকাবেলা করে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যে নারী কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত সময় পার করে এসেও দিনশেষে সুনিপুন হাতে ঘরসংসার সামলায়, যে নারী নিজের উদ্যোগে ব্যবসা দাঁড় করায়, তার প্রধান সম্পদ তার মেধা না, তার নিষ্ঠা, সাহসিকতা বা একাগ্রতাও নয়, তার মূল সম্পদ কি না তার 'সৌন্দর্য্য'?? এও সম্ভব??!!!
এই কথার মানে এটাই দাঁড়ায় যে তার সৌন্দর্য্য নেই, সে সম্পদহীন। মিডিয়া কাঁপিয়ে বেঁড়ানো সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষগুলো যা বছরের ৩৬৫ দিন নারী স্বাধীনতা বা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলে, তারায় যখন এমন হীন কথার মাধ্যমে নিজেদের নিচু মনমানসিকতার পরিচয় দেয়, তখন আমজনতা মানসিকতা বদলানোর কথা আমরা কি করে আশা করতে পারি?
অসুন্দর গড়ন বা কথাকথিত কালো চেহারা বা বেটে বা মোটা গড়নের যে সহস্র মেয়েরা প্রতি মুহুর্ত সমাজের একচোখা বিশ্বাস আর ধারণার কাছে নিপীড়িত ও অবহেলিত হচ্ছে, তাদের মুখে 'পারসোনা' আরোও একবার সপাটে সজোরে চড় লাগালো। বুঝিয়ে দিল সমাজের তথাকথিত মাপকাঠির বিবেচনায় সৌন্দর্য্যহীন মেয়েগুলো প্রকৃতই সম্পদহীন, সোজা কথায় 'বাতিল'
সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো এই যে, নারীর সৌন্দর্য্য কে পুঁজি করে ব্যবসা করে খাওয়া মানুষগুলোয় নারীর মূল্যায়ন নিয়ে মিডিয়াতে সবচেয়ে জ্বালাময়ী কথাগুলো বলে। এরা নারীর ক্ষমতায়নেরও কেবল একটাই পন্থা জানে, তা হলো 'সৌন্দর্য্য'। দিনমান খেটে খাওয়া পরিশ্রমী নারী শ্রমিকদের হাত দিয়ে আসা নারীর ক্ষমতায়ন তারা নির্ভাবনায় এড়িয়ে যান, অথচ দেহ আর বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের বিচারে তারা লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার অথবা মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতা দিয়ে তার নারী ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে আমাজনতাকে বিশ্বাস করাতে চান।
একজন নারী- যে ঘর সামলাতে পারে, সে স্বামী মাসিক বেতনের টাকায় গুছিয়ে সংসারও চালাতে পারে, সেই একই নারী ইটের ভাটায় কাজ করে, রাস্তায় পিচ ঢালে, খোয়া ভাঙ্গে, আকাশে প্লেন উড়ায়, জাহাজ চালায়, সেনাবহিনীতে পুরুষ সহকর্মীদের সাথে পাল্লা দিয়ে কমিশনড হয়, গার্মেন্টস এর সেলাই মেশিন চালায়, ডাক্তার হয়ে রোগীর সেবা করে, এভারেস্ট জয় করে, সাংবাদিক হয়ে সারবিশ্বে যুদ্ধক্ষেত্রের নির্মমতার খবর পৌঁছে দেয়, সেই নারীই আবার কবিতা লেখে, সন্তান কে লালন পালন করে, আবার প্রিয়জনকেও ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়। যে নারীর এতরূপ, সেই নারীর সব সম্পদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যখন বলা হয় সৌন্দর্য্যই তার প্রধান সম্পদ, তখন সমাজের হতদরিদ্র কালো রূপটা সত্যিই আর ঢেকে রাখা যায় না। আলোর ঝলকানিতে বাস করা, জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় ঠাঁই করে নেয়া এবং অবশ্যই নারীর ক্ষমতায়নের আইডল হিসাবে যারা সোসাইটিতে নারীসমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা যখন আদিম ধারনার খোলস এবং বিশ্বাস ছেড়ে বের হয়ে আসতে পারেন না, তখন হতাশ হওয়া ছাড়া সত্যি আর কোন পথ খোলা থাকে না।
মিথিলার মতো মেয়ে, যে প্রচলিত অর্থে কেবল বাহ্যিক ভাবেই সুন্দর নন, পাশাপাশি তার মেধা এবং কর্ম পরিধিও যথেষ্ট প্রশংসনীয়, যে কিনা একটি দেশের আন্তর্জাতিক সুনাম সম্পন্ন প্রধান একটি এনজিও এর হয়ে শিশুদের নিয়ে কাজ করে, নারীদের নিয়ে কাজ করে, সে কি করে এমন নিচু ধারনার একটি প্রচারনার অংশ হতে পারে, সেটাও কিন্তু সমানভাবে বিস্ময়কর!
শিক্ষা, আধুনিকতা কোনকিছুই নারীদের বিষয়ে আমাদের প্রাগঐতিহাসিক ধারনামুক্ত করতে আসলে পারেনি। নারী নারী নারী করে আস্ফালন করে মিডিয়া দাঁপিয়ে বেড়ানো মানুষগুলো সাধারণ পরিশ্রমী নারীদের যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করার জন্য আসলে কিছুই করেন না, যা কিছু করেন তার সবটাই নিজেদের স্বার্থে। নিজেদের প্রচার আর প্রসার বাড়ানোর জন্যই করেন। নারীর ক্ষমতায়নেও তারা ততটুকুই আগ্রহী যতটুকু তাদের ব্যবসার প্রসারের জন্য প্রয়োজন। এই সত্যিটাই আরো একবার প্রমাণিত হলো।
আমার জীবনের প্রথম বিমান যাত্রায় মাইক্রোফোনে একজন নারীর কন্ঠ ভেসে এসেছিল 'দিস ইজ ক্যাপ্টেন তাসনিম', বাংলাদেশের মাটি থেকে বোয়িং বিমানে করে যে আমাদের ৩০০ জনকে নিয়ে ব্যাংকক উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ভীষন গর্ব হয়েছিল সেদিন। সৌন্দর্য্যই যদি নারীর প্রধান সম্পদ হয়, তাহলে ক্যাপ্টেন তাসনিম বা পৃথুলা রশিদ? তাদের প্রধান সম্পদ কি??
লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক, এমনকি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে কাজ করা গৃহকর্মী অথবা মোড়ের দোকানের মহিলা চায়ের দোকানদার, অথবা পরিশ্রান্ত দুপুরে মলিন আঁচলে সন্তানকে বুকে জড়িয়ে থাকা মা, তার প্রধান সম্পদ কি?
প্রিয় পারসোনা, প্রিয় কানিজ আলমাস, প্রিয় মিথালা.....আপনাদের কাছে প্রশ্ন থাকলো??
এদেশের কোটি কোটি খেটে খাওয়া নানান পেশা, নানান বর্ণ ও নানান বাহ্যিক গঠনের নারীরা, যারা আপনাদের মাপকাঠিতে সুন্দর নন এবং সৌন্দর্য্যের মত মহা মূল্যবান সম্পদ যাদের নেই, কিন্তু যারা দেশের অর্থনীতির চাকাকে দ্বিগুন গতিতে ঘুরিয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, যাদের হাত ধরে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তাদের প্রধান সম্পদ কি হতে পারে, বলবেন প্লিজ!