নীলবৃষ্টি
বর্ষাকাল।ভোর রাত থেকে বৃষ্টি নেমেছে।একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডাও লাগছে।কাঁথাটা পায়ের কাছে থেকে টেনে নিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে পড়ে আছে নয়ন।হঠাৎ বোন অর্পিতার ডাকে ঘুম ভেঙে যায় নয়নের।অর্পিতা নয়নের থেকে তিন বছরের বড়।পরিপূর্ণ যুবতী।নয়নের কতই বা বয়স হবে সতের।কিন্তু এই বয়সেই অনেক কাজ করতে হয় তাকে।বলতে গেলে বাবা,মা আর বোনের এই সংসারটা তাকেই দেখতে হয়।বাবা পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে বছর দুয়েক হলো।সেই থেকেই তো সংসার দেখার দায়িত্বটা কাঁধে এসে পড়েছে।খুলনা জজ কোর্টের পেছনে দুই রুমের একটা বাসা নিয়ে থাকে ওরা।কত স্ব্প্ন ছিলো নয়নের বুয়েটে পড়বে।কিন্তু সে পড়াশুনার পাঠ তাকে চুকিয়ে ফেলতে হয়েছে অনেক আগেই।এখন সে খুলনা শহরের পরিচিত এক হকার।মানুষের বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করাই তার কাজ।যদিও এটাই তার একমাত্র কাজ নয়।
নয়ন কোনরকমে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে দেখে মা রেডি হয়ে গেছে দোলখোলা যাওয়ার জন্য।ওর মা ওখানে একটা মেসেতে বুয়ার কাজ করে।সারা পথ হেটেই যেতে হবে তাই একটু আগেই রওনা দিয়েছে।বৃষ্টি কমছে না বলে সেই পুরাতন ছাতাটা আর গামছাটা সাথে করে নিয়েছে।অর্পিতা সাইকেলটা আর বড় একটা পলিথিন নিয়ে এসেছে নয়নের জন্য।পলিথিনটা খবরের কাগজগুলোকে রক্ষা করবে বৃষ্টির হাত থেকে।বৃষ্টির কমতি নেই, বিজলীও চমকাচ্ছে কিন্তু কোন উপায় নেই নয়নকে এখনই রওনা দিতে হবে।সকাল নয়টার আগে সবার বাসায় খবরের কাগজ বিলি করা চাই নইলে খুলনা শহরে তো আর হকারের অভাব নেই!নয়ন নয়টার আগে সবখানে বিলি করতে পারে না এজন্য গালিও শুনতে হয়।কি আর করা ওদের তো গালি শোনার জন্যই জন্ম হয়েছে।নয়ন তবে এক এলাকা এক দিন সবার আগে বিলি করে তো অন্য এলাকা পরের দিন সবার আগে বিলি করে।এভাবে উলটে পাল্টে এলাকাগুলো ভাগ করে নেয়েছে।ফলে গালি শুনতে হয় কম।
অর্পিতা বয়রা কলেজে পড়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে।বাসা থেকে রিক্সা করেই কলেজে যায় সে।রিক্সায় ভাড়া অনেক কিন্তু উপায় কি যেতেই হয়।এজন্য বয়রা কলেজে ভর্তি হতে চায় নি সে।তার মা বাবাও রাজি ছিলো না এতে।কিন্তু নয়নের খুব ইচ্ছে তার বোন ভালো কলেজে পড়বে। কলেজ শেষে ডাক্তারি পড়বে।তাই বয়রা কলেজে ভর্তি করানো হয়েছে তাকে।অর্পিতা ছাত্রী হিসেবে খুবই ভালো।দেখতেও অনেক সুন্দর।মেয়েদের দেখতে ভালো হওয়ারও একটা সমস্যা আছে।বয়রা কলেজের মোড়ে মাস্তানদের আড্ডা।ওদের কাছে থেকে অনেক অশালীন কথা শুনতে হয় তাকে মাঝে মাঝে।কিন্তু বলার কিছুই নেই।নির্বাক শ্রোতা হয়ে শুনতে হয় সব।
সব বাসায় কাগজ দেয়া শেষ হলে সে বয়রা কলেজে চলে যায়।অপেক্ষা করে তার বোনের জন্য।অর্পিতার ক্লাস শেষ হলে নয়নের সাইকেলের পেছনে বসে চলে আসে বাড়ি।দুপুর বেলা দু’টো খেতে পারলে আবার বেরিয়ে পড়ে নয়ন।পাশের সদর হাসপাতালের একটা ডেসপেনশারিতে কাজ করে সে।দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ করতে হয় সেখানে।রাতে ফিরে এসে খেতে পারলেই ঘুম।এভাবেই কেটে যায় নয়নের এক একটা দিন।পরদিন সকাল হয় আবার সেই একই কাজ,একই কাজের পরম্পরা।
আজকের দিনটা অবশ্য ভিন্ন।আজ সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কাগজ বিলি করেছে সারা সকাল।সাত রাস্তার মোড়ে বসে চা খাচ্ছিল এমন সময় শুনেছে বয়রা কলেজের মোড়ে একটা মেয়েকে ধর্ষন করেছে কিছু ছেলে।নয়ন মোড়ের সেই ছেলেগুলোকে চেনে।ওদের নাম আতিক,মিরাজ,পলাশ এমন আরো চার পাঁচ জন।এদের সাথে ওর পরিচয়টা হয়েছিলো একটু অন্যভাবে।অর্পিতাকে প্রতিদিন সেই নিয়ে আসত সেটা খেয়াল করত ওরা।একদিন যখন সে কাগজ বিলি শেষে কলেজের সামনে যেয়ে বসেছিলো তখন ওরা এসে ধরেছিলো তাকে।মেয়েটি তার কি হয়?তার বন্ধু কিনা ইত্যাদি জানতে চেয়েছিলো তারা।নয়ন তাদের পুরো বিষয়টা খুলে বলেছিলো।নয়ন জানত এরা কত খারাপ,কত কি এরা করতে পারে।প্রায় প্রতি বছরই একটা দুইটা মেয়ে এদের হাতে সম্ভ্রম হারায় একথা অজানা নয় কারোর।আতিকের নাম শুনলেই তো বয়রা কাঁপে।কে জানে সবাই কাঁপে বলেই হয়ত পুলিশ ডিপার্মেন্টও কাঁপে।তারা তো আর সবার বাইরে নয়!এজন্য আতিকদের কখনো কিছু হয় না।স্বভাবতই নিজের বোনকে নিয়ে ভয় হয়েছিলো নয়নের।তাই নিজের গরজেই আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব ঠিক নয় মেলামেশা শুরু করে ওদের সাথে।যেন ওদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজের বোনটাকে অন্তত বাঁচাতে পারে সে।
এইতো মাস চারেক আগে একদিন অর্পিতারই এক বান্ধবী ফিরোজাকে ধর্ষন করেছিলো ওরা।এরপর দিন পনেরো লুকিয়ে ছিলো।কিছুই হয় নি ওদের।আজ আবার আর এক জন।নয়ন ঠিক বুঝতে পারে না কি করবে সে।সে কি আজ ওখানে যাবে নাকি বাসায় ফিরে যাবে।ওদের কথা বলা যায় না।ও তো এই বছরখানেক ওখানে যেটুকু সময় থাকে তার পুরোটাই থাকে ওদের সাথে।আবার পুলিশের কথাও বলা যায় না।তারা ওদের তো ধরবে না দেখা যাবে নয়নকে ধরে নিয়েই চলে গেছে।বাংলাদেশে পুলিশ তো আর কোনকালে আসল অপরাধীকে ধরে না।আবার বোনটাকে তো আনতে হবে।সাথে করে ফিরবার টাকা নিয়ে গেছে কিনা কে জানে।হয়ত নেয় নি।এসব ভেবে কলেজের দিকেই রওনা দেয় সে।
একটু দূর থেকে নয়ন দেখতে পেলো ঠিক মোড়ের কাছেই যেখানে আতিকরা বসত সেখানে অনেক মানুষের ভিড়।নয়ন বুঝল আজ বৃষ্টি হচ্ছে ভোর থেকে রাস্তায় লোকজন বেশি ছিলো না।ওখানে ফেলেই মেয়েটাকে ধর্ষন করেছে ওরা।আরো কাছে যেতেই নয়ন দেখে আতিকদের সাথের একজন এখনো দাঁড়িয়ে আছে।ওকে দেখেই একটু মুচকি হেসে চলে যায় সে।অবাক হয় নয়ন হাসির কারনটা ধরতে না পেরে।আরো অবাক হয়ে দেখে এখনো পুলিশ এসে পৌঁছায়নি।সারা শহর জেনে গেছে কিন্তু পুলিশ এখনো জানে নি।অন্যায়ের খবরগুলো পুলিশের কাছে দেরিতে যায়!পুলিশ আসে নি বলেই মানুষগুলো মেয়েটাকে এখনো হাসপাতালে নিয়ে যায় নি।শুধু চারিদিক ঘিরে সেই অর্ধনগ্ন মেয়েটাকে দেখছে।মেয়েটার অর্ধনগ্নতার মজা নিচ্ছে!এমন আহম্মক জনগোষ্ঠী এদেশেই শুধু থাকতে পারে।সাইকেলটা পাশে রেখে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় নয়ন।দেখে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে মেয়েটি।কিন্তু তাকে চিনতে এতটুকু দেরি হয় না তার।এই সেই মেয়ে যার সাথে ছোটবেলা থেকে কত হরেক রকমের খেলা খেলেছে সে।কতদিন খেলার ছলে মেরেছে তাকে।আর মেয়েটি তাকে না মেরে মায়ের কাছে যেয়ে নালিশ করেছে।কষ্টে বুক ফেটে যায় নয়নের।চোখ দু’টো বানের পানিতে ভেসে যেতে চায় তার।আস্তে আস্তে এগিয়ে মেয়েটার মাথাটাকে কোলের উপর তুলে নেয় সে।আশ পাশ থেকে শব্দ ভেসে আসছে,এই ছেলে তুমি কি করছো?পুলিস আসছে উঠে আসো।নয়ন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।সে শুধু দেখছে।দেখছে তার দিদির চোখ দু’টো দিয়ে বৃষ্টি নামছে টিপ টিপ করে।সে বৃষ্টি যেন একটু অন্যরকম।সে বৃষ্টির রঙ নীল।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




