somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই রিভিউঃ দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট - অ্যালেক্স মাইকেলিডিস

১৬ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেলেন বিখ্যাত ফ্যাশন ফটোগ্রাফার গ্যাব্রিয়েল বেরেনসন। খুনি - গ্যাব্রিয়েলের স্ত্রী স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী অ্যালিসিয়া বেরেনসন।



থিও ফেবার - একজন মনঃচিকিৎসক যার জীবনের একটা লক্ষ্য হয়ে উঠেছে খুনের পর থেকে নিস্তব্ধতার মাঝে সব অনুভূতিকে কবর দেয়া অ্যালিসিয়ার মনের বদ্ধ দরজা আবার খুলে ধরা। সোজা কথায় বলতে গেলে, এটাই অ্যালেক্স মাইকেলিডিসের লেখা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ঘরানার উপন্যাস "দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট" এর মূল কাহিনী।

এলাম, দেখলাম, জয় করলাম - একদম এভাবেই নিজের প্রথম উপন্যাস দিয়ে পাঠক-সমালোচক নির্বিশেষে সকলের মন জয় করে নিয়েছেন মাইকেলিডিস। পেজ টার্নিং ম্যাটেরিয়াল নিয়ে এই বই লেখা হয় নি, পাতায় পাতায় টান টান উত্তেজনা নেই। নেই কোনো পড়তে পড়তে থমকে দেয়ার মতন একের পর এক টুইস্ট, যা আছে তা সীমিত পরিমাণে ও উপযুক্ত প্রয়োগের কারণেই মন কেড়ে নেবে পাঠকের। এই বই আসলে এক গোলকধাঁধা। একজন সর্বজন-স্বীকৃত খুনির যে নিজের স্বামীকে ঠাণ্ডা মাথায় নির্মম ভাবে হত্যা করেছে আর একজন মনঃচিকিৎসকের যে সেই খুনির চিন্তাধারা অনুধাবনে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে বদ্ধপরিকর- এই দুইজনের মনের গোলকধাঁধায় এই বই যেনো এক ভ্রমণ কাহিনী। প্রতিবার পাতা উল্টানোর সাথে সাথে প্রতিটা চরিত্রের ব্যাপ্তি আর গভীরতা বেড়ে চলে, তাদের নিজেদের বিকাশ পরিপূর্ণতা পায় উপন্যাসের সমাপ্তিতে এসে। থিও যেভাবে অ্যালিসিয়ার মনের গভীরে আমাদের নিয়ে গিয়েছে ঠিক সেভাবে মাইকেলিডিসও পাঠককে তার প্রতিটি চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করতে বাধ্য করেছেন। অপরাধ নয়, অপরাধীর মনন-চিন্তাধারা আর মস্তিষ্কের অনাবিষ্কৃত অংশে আমাদের নিয়ে যায় এই বই। পড়ে ফেলে রাখার মতন বই নয়, পড়তে পড়তে ভাবার ও পড়া শেষে সংগ্রহে রাখার মতন বই "দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট"।

সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ঘরানার আর দশটা বইয়ের চাইতে "দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট" অনেকাংশেই ভিন্ন। যেটা আগেও বললাম, টুইস্টের পর টুইস্ট, পাতা উল্টানোর একটা তাগিদ, নাটকীয়ভাবে ঘটনার উপস্থাপন - এই বিষয়গুলো এই বইতে নেই। এই বইয়ে আছে মাইকেলিডিসের দারুণ সম্মোহনী লেখনীর কারুকার্য যা পাঠককে বইয়ের ভেতরে ঢুকতে বাধ্য করে। পাঠক বুঝতে পারে যে সামনে একটা বিশাল টুইস্ট তার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু সেই টুইস্ট পর্যন্ত পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার কাজটা অনায়াস-ভাবে করেছেন লেখক। শুধু তাই না, একটা একটা করে পর্দা সরিয়েছেন মূল চরিত্রের অতীত থেকে, তার লুকিয়ে রাখা অপ্রকাশিত সত্যতা থেকে। পাঠককে প্রতিশ্রুতি মত গল্পের টুইস্টে নিয়ে যান তিনি এবং পাঠকও সেই টুইস্ট পড়ে যে নিঃসন্দেহে বিমোহিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই টুইস্ট পর্যন্ত পাঠককে যেই অপেক্ষায় রাখেন লেখক, বইয়ের ২৭২ পাতা জুড়ে যেই যাত্রায় লেখক পাঠকের সঙ্গী হয়ে সাথে থাকেন - সেটাই আসলে এই বইকে বছরের সেরা বই করে তুলেছে। (যার কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বাঘা বাঘা সব প্রকাশনী এই বইয়ের অনুবাদ বের করতে বাধ্য হয়েছে!!!)

যেরকম সুখী জীবনের প্রত্যাশা আমি, আপনি - সকলেই করে থাকি; সেরকম একটা সুন্দর জীবন, সাজানো সংসার ছিলো অ্যালিসিয়া বেরেনসনের। একদিন নিজের হাতেই সেই সংসার ধ্বংস করে অ্যালিসিয়া, খুন করে নিজের স্বামীকে। আর এরপরই চেষ্টা করে আত্মহত্যার। কোনক্রমে বেঁচে ফিরে আসার পর থেকে মৌনতাকে নিজের সঙ্গী করে নেয় সে। কেটে যায় বছরে পর বছর, কিন্তু নিশ্চুপ-নির্বাক হয়ে যায় অ্যালিসিয়া। অ্যালিসিয়ার জীবনের এই দুঃখজনক পট পরিবর্তন পাঠককে আগ্রহী করে তোলে এই চরিত্রের কাছে যাওয়ার, তাকে বুঝতে চাওয়ার। কিন্তু, নিজের নিস্তব্ধতা দিয়ে পাঠককেও যেনো দূরে ঠেলে দিতে চায় অ্যালিসিয়া, ঘনিয়ে ওঠে রহস্যের ধোঁয়াশা। অ্যালিসিয়া এমন একটা চরিত্র যার উপস্থিতি এই বইয়ের পাতায় পাতায় রয়েছে, আবার একই সাথে রহস্যের চাদরে মোড়ানো এমন এক চরিত্র যে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। অ্যালিসিয়ার অতীত, তার আঁকা ছবি, বর্তমানে তার বিবরণ, চলা-ফেরা-আচার-আচরণ আর সবশেষে তার বলা কথাগুলো পাঠককে বাধ্য করে অ্যালিসিয়ার একটা ছবি নিজের মতো করে নিজের মনে এঁকে নিতে।

অ্যালিসিয়াকে কেন্দ্র করে বইয়ের কাহিনী বিস্তৃত হলেও, বইয়ের পাতায় পাতায় পাঠককে ভ্রমণ করায় থিও ফেবার। বইয়ের শুরু থেকেই থিও আমাদের সঙ্গী। অ্যালিসিয়ার মতন আকর্ষণীয় একজন মানসিক রোগীকে নিরাময় করার পেছনে তার যে দৃঢ় ইচ্ছা ও চেষ্টা পাঠক বইয়ের শুরু থেকেই তা স্পষ্ট দেখতে পান এবং থিওর সাথে একরকম আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায় পাঠকের - অবশ্য বইয়ের প্রধান দুই চরিত্রের একজন নির্বাক আরেকজন বর্ণনাকারী হলে এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। নতুন কর্মস্থলে এসে সেখানের সাথে মানিয়ে নেয়ার সাথে সাথে থিও চেষ্টা করতে থাকে অ্যালিসিয়ার মনের ভেতর প্রবেশ করতে। আস্তে আস্তে অ্যালিসিয়ার রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে কিন্তু সেই রহস্য উন্মোচনকারী থিও নিজেই থেকে যায় রহস্য মানব হিসেবে। থিও অ্যালিসিয়ার মুখ থেকে কথা বের করতে সক্ষম হলেও, অ্যালিসিয়াকে পাঠকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হলেও থিওর ব্যক্তিগত জীবনে সহজে প্রবেশাধিকার পায় না পাঠক। মাইকেলিডিস এখানেও পাঠককে এক অসহ্য অপেক্ষায় রাখেন ও অপেক্ষার শেষ প্রহরে এসে নিঃসন্দেহে আধুনিক থ্রিলারের অন্যতম সেরা চমকের সামনে এনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন।

খুব সহজবোধ্য একটা কাহিনী লিখেছেন মাইকেলিডিস, একই সাথে ভীষণ জটিলও বটে। একাধিক সময়ে আমরা ফিরে ফিরে যাই, একই ঘটনার নানান ব্যাখ্যা আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়, ব্যক্তিজীবন, সাংস্কৃতিক দিকগুলো থেকে শুরু করে চিকিৎসা প্রণালী সব কিছুকেই মাইকেলিডিস তার জাদুকরী কলমে তুলে এনেছেন নিজের লেখা প্রথম বইতে। সবচেয়ে বড় কথা, কেউ যদি এই বইয়ের শেষ অংশটুকু অনুমানও করে ফেলে তাও এই বই পড়তে তার একদমই বিরক্ত লাগার কথা না, অবশ্য যদি সেই পাঠক মোমবাতির মতন ধীর-স্থির ভাবে পুড়তে থাকা রহস্যের আগুনের আঁচ নিতে চায়। বইয়ের আরও অনেক কিছু নিয়েই কথা বলা যায় - মিথোলজির সাথে মিলিয়ে অ্যালিসিয়ার জীবনের আখ্যান তুলে ধরা, লেখকের কল্পনাশক্তির অসামান্য প্রয়োগ তবে এসব কিছু নিয়ে কথা না বলে এক কথায় শেষ করা যায় - নিঃসন্দেহে "দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট" নিখুঁত কাহিনী বিন্যাসের কারণে ও দারুণ সব চরিত্রের সমাহারে এই দশকের সেরা থ্রিলারের ছোট্ট তালিকায় নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। হ্যাপি রিডিং।

বইঃ দ্য সাইলেন্ট পেশেন্ট
লেখকঃ অ্যালেক্স মাইকেলিডিস
অনুবাদকঃ শোভন নবী
প্রথম প্রকাশঃ জুলাই ২০২০
প্রকাশনীঃ ভূমিপ্রকাশ
প্রচ্ছদঃ সজল চৌধুরী
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২৭২
মূল্যঃ তিনশত নব্বই টাকা মাত্র
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:৫৫
১৫টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×