পেশাগত কারণে মাঝে মাঝে বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হতো । একদিন উপজেলা পর্যায়ের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির একজন সদস্যসহ আমার অফিসে পরিচালনা কমিটির সভা করতে এলেন । কথায় কথায় প্রধান শিক্ষককে প্রশ্ন করলাম আপনার বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর কতজন শিক্ষার্থী ভালোভাবে ইংরেজি পড়তে পারে । মনে হলো প্রধা্ন শিক্ষক বিপদে পড়ে গেলেন । অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তিনি বললেন ৩৩ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এ ধরণের প্রশ্ন এর আগে কেউ আমাকে করেনি । এরপর তিনি অনুমান করে বললেন শতকরা ১০ জন শিক্ষার্থী ভালোভাবে ইংরেজি পড়তে পারে । ঐ বছর বিদ্যালয়টির দশম শ্রেণীতে ৭৭ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ছিল যারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা । আমার মাথায় এ ধরণের প্রশ্ন আসার পেছনে ছোট্ট একটি কারণ ছিল । কিছুদিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে গিয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক না হয়েও প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে আমাকে নবম-দশম শ্রেণীর ইংরেজি পড়াতে হতো । দশম শ্রেণীতে পড়াতে গিয়ে শিক্ষা্র্থীদের ইংরেজির জ্ঞান দেখে যারপরনাই অবাক হই । আমি লক্ষ্য করলাম ১০০জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৮/১০ জন ভালোভাবে ইংরেজি পড়তে পারে । অন্যদের অবস্থা তথৈবচ । এরা শিক্ষাজীবনের ১০টি বছর কীভাবে পার হয়ে এলো ভেবে কুল পাই না । শিক্ষার্থীদের এত বড় দুর্বলতা শিক্ষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলইবা কী করে । যে শিক্ষার্থী ইংরেজি পড়তেই পারে না তার জন্য শিক্ষাটা আনন্দদায়ক হবে কীভাবে । ইংরেজির এ দুর্বলতা ক্রমান্বয়ে শ্রেণীকক্ষ ভীতিতে রূপান্তরিত হতে বাধ্য, যার অবধারিত ফল নির্ভিচারে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া । আর এভাবেই দেশের অমিত সম্ভাবনাময় কত শত শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অকালেই শেষ হয়ে যায় তার খবরই বা কে রাখে । আমাদের নিরানন্দ ও ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার নিষ্ঠুর শিকার এদেশের লাখো লাখো শিক্ষার্থী । মফ:স্বলের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলে ইংরেজি বিষয়ে দুর্বলতার একই চিত্র দেখেছি । অধুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ভর্তি পরীক্ষার ফল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষার দৈন্যদশার করূণচিত্রই আমাদের মনে করিয়ে দেয় ।
ক্লাসে কয়েকদিন আমি শিক্ষার্থীদের শুধু সিলেবল পড়াই । এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসাধারণ পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম । এ যেন 'মিরাকল' ঘটে গেল । শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক লক্ষ্য করলাম । যে শিক্ষার্থী ভালোভাবে ইংরেজি পড়তে পারতো না বরং ঘোরের মধ্য দিয়ে জীবনের দশটি বছর পার করে এসেছে, সেও গভীর মনযোগ আর প্রবল আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে উপস্থিত থাকছে এবং বড় বড় ইংরেজি শব্দ ভালোভাবে পড়তে পারছে ।
বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি গ্রামারে 'সিলেবল' অধ্যায়টি সিলেবাসেই নেই । কোন অজ্ঞাত কারণে 'সিলেবল' রাখা হয়নি এটি বোধগম্য নয় । মফ:স্বলের তুলনায় শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গুণগতমান ঢের ভালো । দেশের উপজেলা তথা প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ইংরেজি শিক্ষা অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে । শিক্ষার এই দুর্বল দিকগুলো যাদের দেখার দায়িত্ব তারাও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে বলে মনে হয় না ।
ইংরেজি শুধু একটি ভাষাই নয়, এটি টেকনোলজিও । যে যাই বলুক বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল একটি দেশের পক্ষে ইংরেজি পাশ কাটিয়ে চলা মুশকিল ।
ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আরো জোরদারের পাশাপাশি প্রশাসনিক মনিটরিং না বাড়ালে এ অবস্থা হতে উত্তরণ সহজ হবে না ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১১:৫৩