যাপিত জীবনে প্রতিনিয়ত কত ঘটনাই না ঘটে । এর মধ্যে কিছু ঘটনা জীবনবোধ কে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয় । কোন কোন ঘটনা সুখ স্মৃতি হয়ে মানসপটে থেকে যায়, আবার কোন ঘটনা স্মৃতির আয়নায় কষ্টকর অধ্যায় হিসেবে জেগে থাকে আজীবন । ৫/৬ বছর আগের ঘটনা একদিন অফিস থেকে বেরিয়ে সহকর্মীসহ বয়স্ক একজন লোকের রিক্সায় চড়ে বাসায় ফিরছিলাম । পথিমধ্যে আমরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম । রিক্সা থেকে নামার পর যখন ভাড়া দিতে যাবো তখন বৃদ্ধ রিক্সা ড্রাইভার বললেন "চাচা আপনাদের কথা শুনে মনে হলো আপনারা সরকারি কর্মকর্তা , আমার কিছু দু:খের কথা কি আপনারা শুনবেন" ? ব্যস্ততা থাকলেও বললাম চাচা বলেন কি সমস্যা । এরপর যা শুনলাম তাতে লজ্জায় মাথা তুলে তাঁর দিকে তাকাতে কষ্ট হচ্ছিল । পড়ন্ত বিকেলের অস্তায়মান সূর্যের সাথে যেন আমরাও তলিয়ে যেতে লাগলাম । আমাদের অহংবোধ প্রচন্ড ধাক্কা খেল । অনেকক্ষণ মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না । তাকেঁ ফোন নম্বর দিয়ে পর দিন অফিসে দেখা করতে বললাম । বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা আর কেউ নন তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা । যৌবনে একরাশ স্বপ্ন আর মহান দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপটির মুক্তির লড়াইয়ে জীবন বাজি রেখেছিলেন । সে বাজিতে জীবন এবং মাটি দুটোই রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন । কিন্তু এরপর ? যুদ্ধতো শেষ হয়েছিল একাত্তরে । তাঁর জীবন যুদ্ধ আর শেষ হয়না । কঠিন জীবন সংগ্রামে পথ চলতে গিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষটির দুচোখের স্বপ্ন আজ ধুসর ,অর্থহীন । অনেক মূল্যে পাওয়া স্বাধীনতাও কি তার কাছে বিবর্ণ হয়ে যায়নি ? মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় তাঁর নাম থাকলেও কোন এক অজানা কারণে তিনি সনদপত্র পাচ্ছিলেন না এবং এইজন্য মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও তাঁর ভাগ্যে জুটছিলো না । আমার লজ্জা অন্য জায়গায় । বাঙ্গালির হাজার বছরের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় ঘটনা, সবচেয়ে বড় অর্জনও। আমার জন্মের আগে পাওয়া স্বাধীনতায় কোন ভূমিকা আমার ছিলো না । মুক্তির মরণপণ লড়াইয়ে জীবনবাজি রাখা একজন বীরসেনানির রিক্সায় চড়ে দিব্যি আমি বাসায় ফিরছি । তাঁর মত লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষ যুদ্ধ করেছিলেন বলেই স্বাধীনতার সুফল আমরা ভোগ করছি । আমরা কেউ বড় চাকুরিজীবি, কেউ বড় ব্যবসায়ী, কেউবা মন্ত্রী-এমপি আরো কত কি । পরাধীন পাকিস্তানে হয়তো আমরা অনেকে এতসব সুবিধার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না । সীমাহীন গ্লানি,লজ্জা আার অন্তর দহনে কষ্ট হচ্ছিলো আমার । হয়তো ঘৃণা হচ্ছিল নিজের প্রতিও একজন মুক্তিযো্দ্ধা আমাকে রিক্সায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন বলে । পরদিন তিনি অফিসে এসেছিলেন । ঐ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের সাথে কথা বলেছিলাম ।তিনি হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধার সনদপ্রাপ্তিতে সহায়তা করবেন বললেন । এর কয়েকদিন পরই বিজয় দিবস ছিল । সে বছরের মহান বিজয় দিবসটি জীবনযুদ্ধে পরাজিত একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য ধুসর মনে হচ্ছিল । অনেক অনেক দিন পর আবার খবর নিয়েছিলাম সেই মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছিলেন এবং ভাতাও পাচ্ছিলেন । সুখের বিষয় তিনি আর রিক্সা চালানোর মত কষ্টকর কাজ করেন না । হয়তো মুক্তিযোদ্ধা ভাতা সীমাহীন গ্লানি আর লজ্জা থেকে জাতিকে বাঁচিয়ে দিল । তারপর থেকে কোন বয়স্ক রিক্সা ড্রাইভার দেখলে আমার তাঁর কথা মনে পড়ে যায় । মার্চ আর ডিসেম্বর এলে বেশি বেশি তাঁর কথা মনে পড়ে । এ লজ্জা, এ গ্লানি আমাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে মনে হয় ।
চলবে...