somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি

০৭ ই মে, ২০১৪ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শফিকের ফেসবুক ফ্রেন্ড-ফ্যান-ফলোয়ারের সংখ্যা অনেক। সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় এই মাধ্যমটিতে সে রীতিমত সেলিব্রেটি গোছের একজন। চটুল শব্দে, নান্দনিক ছন্দে লেখা তার মাঝারী আকারের স্ট্যাটাসগুলোতে পাঁচ-ছয়শ লাইক তো নিয়মিত পড়েই; কখনো কখনো হাজারও ছাড়িয়ে যায়। শফিক ভাল লেখে। তার পরাবাস্তব স্বত্বাটি তর্ক-সাপেক্ষে প্রগতিশীলই, তবে কোনো বিষয়ে তার অবস্থান থেকে শক্তিশালী কোনো আদর্শকে সনাক্ত করা যায় না।
আজকাল শফিক তার স্ট্যাটাসগুলোতে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে খানিক উপহাসের সুরে মতামত প্রকাশ করে। তবে বেশীরভাগ সময় তার জীবনে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাগুলোকে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে, লাইনগুলোকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে প্রাঞ্জল ভাষায় গল্পের মত করে লিখে এবং আবেগময় ও নাটুকে কিছু লাইন দিয়ে খুব দ্রুত গল্পের সমাপ্তি টানে। সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ, রাজনৈতিক হাওয়া-বাতাস সম্পর্কে হালনাগাদ থাকতে পত্রপত্রিকা, ব্লগ, ফেসবুকে আলোচিত লেখক-ব্লগারদের স্ট্যাটাসগুলোয় নিয়মিত চোখ রাখে সে। কিন্তু বই টই বিশেষ পড়া হয় না তার। সময় কোথায়? এমনিতেই বই পড়ার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ কোনোদিনই শফিকের ছিল না। হাতে গোনা যে কয়টি বই সে তবু পড়েছিল এই জীবনে, তা নিয়ে অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটা স্ট্যাটাস তার ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝে না পড়লেই নয়, এমন কিছু বই পড়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করে সে। কিন্তু ফেসবুকে সময় দিতে গিয়ে তা আর হয়ে উঠে না। তাছাড়া বই পড়তে গেলেই শফিকের নিজের লেখাগুলোর কথা মনে পড়ে। শুধু ইচ্ছে হয় আবারও একটু দেখে নেয়- আরও কটা লাইক-প্রশংসা জমা পড়ল!

একদিনে সে ফেসবুক সেলিব্রেটিতে পরিণত হয়নি। এর পেছনে আছে অনেক শ্রম, মেধা এবং অনেক ভণ্ডামির বিনিয়োগও বটে। ধর্ম বিষয়ক কিছু প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করার উদ্দেশ্যে ধর্মকর্মে সম্পূর্ণ অজ্ঞ আহমেদ ছফার ভণ্ড বাবা ‘আলি কোনান’ যেভাবে মানুষকে প্রলুব্ধ করার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে এক ইমামকে দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিল, ঠিক সেভাবে, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শফিক নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে মাথায় রেখে জ্ঞানগরিমা, বুদ্ধিশুদ্ধি আছে কিন্তু অত্যন্ত আবেগপ্রবণ- অনলাইনে সক্রিয় এমন কিছু ছেলেপেলেকে সহজেই নিজের ভক্ত বানিয়ে ফেলেছিল। এরাই মূলত শফিকের স্ট্যাটাসগুলোতে লাইক-শেয়ার দিয়ে তার বন্ধু সংখ্যা (তথা লাইক) বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। এই ভক্তরা স্ট্যাটাসের তলায় ফেটে পড়া আকস্মিক বিতর্কে শফিকের সাথে যোগ দিয়ে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করে ছাড়ত। কিন্তু শুধু শফিকই যে তার ভক্তদের প্রভাবিত করেছিল তা নয়; প্রভাবক হয়েও প্রভাবিতদের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল শফিক নিজেও। তাদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য এবং লাইক প্রদানে ব্যাপক উদারতা শফিককে তার ভক্তদের অনুগত একজন সেলিব্রেটি-পুত্তলিতে পরিণত করেছিল। নিজের মতামত প্রকাশে একসময়ের অকুতোভয় শফিক আজ লাইকের অপ্রতিরোধ্য মোহে আমূল পরিবর্তিত একটি স্বত্বা।

আগের চেয়ে এখন শফিক অনেক বেশি বিনয়ী, সংযত ও ধৈর্যশীল। বাস্তব জগত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, অনলাইন, বৈদ্যুতিন নগরের একজন মন্ত্রমুগ্ধ নাগরিক সে। হোম পেজের উত্তর-পূর্ব কোণে মুহুর্মুহু উদিত একেকটি রক্তবর্ণ নোটিফিকেশন এবং তার সংখ্যার প্রবৃদ্ধি শফিককে সারাক্ষণ মোহাবিষ্ট করে রাখে। সে আজ বাস্তব ও পরাবাস্তব জগত দুটিকে মিলিয়ে ফেলে; সত্য-মিথ্যা গুলিয়ে ফেলে। দুদিন আগে বাসের একটি ঘটনা নিয়ে লেখা শফিকের একটি স্ট্যাটাসকে উদাহরণ স্বরূপ টানলে, বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
স্ট্যাটাসটিতে লেখা গল্পটির সারসংক্ষেপ ছিল অনেকটা এরকম-- শফিক নাকি সেদিন বাসে করে ভার্সিটি যাচ্ছিল। পথিমধ্যে বাসের ভেতর হঠাৎ সে দেখতে পায়, দশাসই গড়নের মাস্তান প্রকৃতির একজন যাত্রী টিংটিঙে শরীরের হেল্পার ছোকরাটার কলার চেপে ধরে ক্রমাগত ঝাঁকাচ্ছে আর গালিগালাজ করছে। হেল্পার ছোকরাটির অপরাধ ছিল, নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম টাকা নিতে সে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিল। যাত্রীদের সবাই চুপচাপ ছোকরাটিকে ওভাবে নাকাল হতে দেখছিল; কিন্তু কেউ কিছুই বলছিল না। এ সময় নাকি শফিক সিট থেকে উঠে গিয়ে লোকটিকে উচ্চস্বরে তিরস্কার করতেই নীরব যাত্রীরা, মুহূর্তের মধ্যে সরব, প্রতিবাদী জনতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার সাথে যোগ দিয়েছিল। ফলে মাস্তান প্রকৃতির লোকটিকে ভাড়া ঠিকভাবে মিটিয়ে দিয়ে গজগজ করতে করতে বাস থেকে নেমে পড়তে হয়েছিল। তারপর স্ট্যাটাসের শেষে কিছু আক্ষেপ ও হেল্পার ছোকরাটিকে নিয়ে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী কিছু কথা লিখে নিজের বীরত্ব গাঁথার ইতি টেনেছিল শফিক।

মজার ব্যাপারটি হচ্ছে, আসলে সেদিন যা ঘটেছিল তার সাথে এই স্ট্যাটাসের ছিল আকাশপাতাল তফাৎ। মূলত সেদিন শফিক নিজেও নীরব যাত্রীদের একজন হয়ে চুপচাপ তার সিটে বসে সেই দৃশ্য দেখেছিল নির্বিকার ভঙ্গীতে। মাঝেমাঝে তার কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল বটে, কিন্তু প্রতিবারই পথের ক্লান্তি এবং দিন শেষের (মূলত সে ঘরে ফিরছিল) নৈমিত্তিক অবসাদ তাকে কিছুতেই সেটি করতে দেয়নি। তাছাড়া সে ভেবেছিল, এরাও তো এমন কোনও ভাল মানুষ নয়। যাত্রীদের কাছ থেকে তারাও তো প্রায়শই অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে! তথাপি, বাসায় ফিরতে ফিরতে ঐ পরিস্থিতিতে একজন সচেতন-সাহসী-সংবেদনশীল যুবকের কি করা উচিৎ ছিল, সেটি ভাবতে ভাবতে নিজেকে সেই কল্পিত যুবকের ভূমিকায় বসিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে একটি লেখা তৈরি করে ফেলেছিল সে মাথার ভেতরেই। তারপর বাসায় ফিরে সেটি স্ট্যাটাসে রূপ দিতে গিয়ে সে এতই নিবিষ্ট হয়ে পড়েছিল যে বেমালুম ভুলেই গেল- ঘটনার শেষাংশটি তার কল্পনা বৈ আর কিছুই ছিল না। বরং লাইকে লাইকে ক্রমাগত ভারি হতে থাকা সেই স্ট্যাটাসটিতে সপ্রশংস ফ্রেন্ড-ফলোয়ারদের কমেন্টের উত্তর, উপদেশ, উৎসাহ ইত্যাদি দিতে দিতে একজন প্রতিবাদী যুবক, একজন ভাল মানুষের ভূমিকায় নিজেকে আবিষ্কার করে শফিক রীতিমত গর্বিত হয়ে উঠেছিল।

তবে ওতে কারো কোনো ক্ষতি হয়নি নিশ্চয়ই। সকলে তো উৎসাহই পেয়েছিল আর যাই হোক! তাছাড়া এমনও তো নয় যে শফিক এইসব মিথ্যে, কল্পিত গল্পের প্রতিবাদী নায়কের ভূমিকায় নিজেকে বসিয়ে দিয়ে বিশেষ কোনো সুবিধা লুটে নেয় কিংবা অর্থকড়ি উপার্জন করে। তার অসত্য কিন্তু নিরীহ গল্পগুলোর মত, তার মিথ্যে খ্যাতিও তো নির্দোষই।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৪ সকাল ১০:৫১
১২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

(রম্য রচনা -৩০কিলো/ঘন্টা মোটরসাইকেলের গতি )

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫০



একজন খুব পরিশ্রম করে খাঁটি শুকনো সবজি( দুষ্টু লোকে যাকে গাঁ*জা বলে ডাকে) খেয়ে পড়াশোনা করে হঠাৎ করে বিসিএস হয়ে গেলো। যথারীতি কষ্ট করে সফলতার গল্প হলো। সবাই খুশি। ক্যাডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×