(২০১৪ সালে বগুড়ায় তুলেছিলাম ছবিটি।)
করোনা অতিমারির সময়কার ঘটনা। ঢাকার কোথাও রেল লাইনের পাশে কিছু মানুষের ভিড় দেখে কৌতুহলী হয়ে দাঁড়ালাম। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সী জনৈক ক্ষীণকায় যুবক চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মাথা বেশ খানিকটা কেটে গেছে। অল্প করে রক্ত গড়াচ্ছে তখনও। ঠোঁটের কোণ থেকে গণ্ডদেশে লালা নিঃসরণের চিকন দাগও দৃশ্যমান। চারপাশে রক্তের দাগ শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। যার পর নেই মুমূর্ষু অবস্থা। সেখানে জানলাম যে, চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে এ অবস্থা। এর বেশি কিছু জানাতে পারলো না কেউ। একজন জ্বলজ্যান্ত যুবক এভাবে দুর্ঘটনাবশত ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাবে, ব্যাপারটা হজম করা কঠিন। খুব সম্ভবত কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো। নিছকই অনুমান অবশ্য। নিশ্চিত হবার সুযোগ ছিলো না। দুর্ঘটনাও হতে পারে। যাই হোক দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো, ঘটনা বেশ কিছুক্ষণ আগের। শুকনো ঘাশে রক্তের কালো দাগ। চোখ বন্ধ। কোনওরকমে শ্বাসটাই শুধু চলছিলো। মাথায় তীব্র আঘাত পেয়েছে। আশু চিকিৎসা দরকার, শুশ্রূষা দরকার। নাহলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যু অনিবার্য। আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছি। ঠাঠা রোদের দিন। ভীষণ গরম। খুব সম্ভবত এরকমই এপ্রিল মে’র গরম ছিলো সেটা। যাই হোক সময় গড়াতে লাগলো। মৃত্যুর কাছে চলে যাচ্ছে নিঃসাড় অসহায় আহত যুবক। এ সময় আমি বললাম, ট্রিপল ৯৯৯ এ কল দেয়া উচিত আমাদের। এখন এ মুহূর্তে চিকিৎসা না পেলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হবে। আরও দুয়েকজন সুর মেলালো আমার সাথে। ৯৯৯ এ ফোন করা হলো। দুচার মিনিট পর কাছের মোর থেকে তিনটা পুলিশকে হেলেদুলে আসতে দেখলাম। ওদের একজন ঘটনাস্থলে এসে উল্টো জনতার উপরে ক্ষোভ ঝাড়তে লাগলো। এই সামান্য কারণে ৯৯৯ এ ফোন দেয়া লাগে? আপনারা নিজেরাই তো সিএনজি রিক্সায় তুলে হাসপাতালে নিতে পারেন। হেনতেন। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম কড়া জবাব দেয়া থেকে। ভদ্রভাবে বুঝিয়ে বললাম যে, খুবই মুমূর্ষু অবস্থা। যে কোনও সময় মারা যেতে পারে। পথে মরে গেলে লাশ নিয়ে বিপদে পড়তে হতে পারে আমাদের। কে এসব ঝামেলায় জড়াতে চায় বলেন। আমি তো কিছুতেই রিস্ক নিবো না। তাই আরেকজনকেও উৎসাহ দিতে পারি না। সেজন্যেই পরিস্থিতি বিবেচনা করে পুলিশকে নক দেয়ার সিদ্ধান্ত সবার। এ পর্যায়ে ধরাধরি করে ছেলেটিকে সিএনজিতে তোলা হলো। আর ঘটনা ঠিক এ পর্যন্তই আমার জানা। তারপর ছেলেটির ভাগ্যে সেদিন কি হয়েছিলো জানি না। আমি সিএনজিতে উঠিনি। এখানে এ লেখা পড়ে হয়তো অনেকেরই আমাদেরকে ভীষণরকম নিষ্ঠুর বিবেকহীন অমানুষ বলে মনে হচ্ছে। পশ্চিমের কোনও উন্নত সভ্য দেশের নাগরিক পড়লে, হতে পারে কুৎসিত গালি দিয়ে বসবে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার বাস্তবতা আমরা কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারি না। পথে ছেলেটির মৃত্যু হলে আমাদের বিপদে পড়ার জোর সম্ভাবনা ছিলো। এই পুলিশ প্রশাসনই তখন বলতো, সময় মতো আনতে পারিনি বলে মৃত্যু। পাবলিকের গাফিলতি। তারপর এটার সাক্ষী দাও। সেটার সাক্ষী দাও। ক্যামেরার সামনে দাঁড়াও। দস্তখত করো। টিপসই দাও। বাপের নাম গ্রামের নাম জিলার নাম বলো। এরকম আরও বিভিন্ন হয়রানির মুখে পড়ার সম্ভাবনা শতকরার হিসেবে নব্বই ভাগ। এমনকি এরকম পরিস্থিতি থেকে এরচে’ও ঢেরবেশি বিপদে পড়ে টাকাপয়সা খোয়ানোও বিচিত্র কিছু নয় এ দেশে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দ্বারাও বিভিন্ন হয়রানির সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারি না। তাই আম জনতাকে সে নীরবতার জন্য চুল পরিমাণ দোষ দেয়ার সুযোগ নেই কারও। ঘটনাটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। আমি শুধু আশা করি যে, ছেলেটি সেদিন বেঁচে ফিরেছিলো। ভালোয় ভালোয় সব শেষ হয়েছিলো।