০১.
শুরুর সময় ধরলে অমিতাভ পাল আশির দশকের কবি। অথচ আশির দশকের কবিদের তালিকায় তার নাম খুব একটা পাওয়া যাবে না। কেন? কেননা আমরা যারা কবিতা লিখি, দশকের খোপে নিজেকে এবং নিজেদেরকে আটকে রেখে একেকজন রথী, মহারথী হতে চাই, তারা একটা বিষয় চাই না, কী সেটা? সেটা হলো আমরা চাই না, আমাদের অপছন্দের কোন কবি আমার মুখ দিয়ে কবির স্বীকৃতি পাক। দলের বাইরে কারো নাম নিতে হোক। সাধারণত যাদের নাম উচ্চারণ করি, তাদের সাথে হয় আমার বা আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের সম্পর্ক আছে, না হয় সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। এই সম্ভাবনা থেকেই আন্তঃসম্পর্ক রচিত হয়। দশক ওয়ারী গোত্র বিভাজন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে কবি রণজিৎ দাশের একটা কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। শহরে নিস্তব্ধ মেঘ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা। কবিতাটির নাম, ক্যাপ্টেন ঘোষ।
‘যে মানুষ কবিতা পড়ে না, আমি
তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখি না।’ - বললেন
ক্যাপ্টেন ঘোষ; তাঁর মাথাভর্তি সাদা চুল
যেন আর্মি-জীবনের বহু বহু সীমান্তের
নির্বিকার শান্ত কাশফুল।
আমরা তাঁকে ভালোবাসি, কারণ তাঁর সঙ্গে গেলে
মিলিটারি ক্যান্টিন থেকে শস্তায় সুটকেশ ও মদ
পাওয়া যায়। কারণ আমরা কবি-ধূর্ত প্রাণী, আর তিনি
অত্যন্ত সরল
কবিতা-পাঠক, তিনি বিশ্বাস করেন,
কবির হৃদয়ে থাকে বেদনার পরিস্রুত জল।
রণজিৎ দাশের এই কবিতা থেকে আমরা কবি চারিত্রের যে সকল গুণাবলী পাই তাতে তো ধারণা করাই যায়, ¯^ার্থ বিনা নাহি দেব সূচাগ্র ¯^ীকৃতি। আসলে আমাদের মূল সমস্যা হলো, আমরা ক্রমশ একটি ¯^ার্থ-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় ঢুকে যাচ্ছি। একটা আশার জায়গা হলো, সৃজনশীল ব্যক্তিরা নাকি এহেন ব্যবস্থায় সহজে যেতে পারেন না। আবার নিরাশার জায়গাটা হলো, আমাদের মধ্যে যারা সৃজনশীল তারাই যেন সানন্দে এই ¯র্^াথ-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা পত্তনে ঢাক-ঢোল-রণভেরী বাজিয়ে চলেছেন। যেখানে ¯^ার্থ সেখানেই যাতায়াত, যেখানে ¯^ার্থ সেখানেই ¯^ীকৃতি। অমুক কবি জীবনানন্দকে অতিক্রম করে গেছেন। তমুক ছাড়া আর কোন কবি নাই। ইত্যাকার প্রশংসা সূচক বাক্যাবলী যে আমরা উচ্চারণ করি না তা নয়। করি, তবে সেখানেই করি যেখানে আমাদের ¯^ার্থের ন্যূনতম সম্ভাবনা থাকে। প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকে।
তো বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে ¯^ার্থ-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের মনের এই যে সংকোচন, এর প্রসারণ হতে পারে একমাত্র মেধা ও জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায়। কিন্তু এটা খুব সহজ না। কঠিন। জটিল। তবু আশা করা যায় এমন দিন আসবে যখন ¯^ার্থ ও প্রাপ্তির চেয়ে বড় হয়ে উঠবে মেধার ¯^ীকৃতি।
সেইদিন আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারবো অমিতাভ পাল আশির দশকের অন্যতম কবি।
০২.
অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১১-তে সাহিত্যদেশ থেকে প্রকাশিত অমিতাভ পাল- এর কবিতার সংকলন পুনর্নির্বাচিত আমি আসলে তার নির্বাচিত কবিতার সংকলন। ইতোপূর্বে প্রকাশিত তার চারটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা কবিতার সংকলন হলো পুনর্নির্বাচিত আমি।
০৩.
কী অকেশে রাস্তায় থুতু ফেললো লোকটা
অথবা উল্টে দিলো ময়লাভর্তি ওয়েস্টপেপার বাস্কেট
অনেকটা কবিকে দেয়া সংবর্ধনার মতো
কবি তো রাস্তাই!
(কবির সংবর্ধনা/ অমিতাভ পাল)
কবি অমিতাভ পালের এই কবিতাটি আমি পড়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে। দুই হাজার এক অথবা দুই সালের দিকে হয়তো। কোন একটা ছোট-কাগজে। সেই ছোট-কাগজটার নাম তো মনে নেই। অন্য কার কার লেখা ছিলো, বা কী কী লেখা ছিলো, তাও মনে নেই। কেবল মনে আছে সেই ছোট-কাগজটায় কবি অমিতাভ পালের কবির সংবর্ধনা শিরোনামের কবিতাটি পড়েছিলাম। তার অর্থ, আমার মনে থাকার যোগ্য ওই একটিই কবিতা ছিলো কাগজটায়। বাকী যা ছিলো সব ছিলো বাতিল, জঞ্জাল। এই একটি কবিতার কল্যাণেই সেই কাগজটির কথা আমার মনে পড়ে, বারো অথবা তের বছর পরেও, এটাই সেই কাগজটির ¯^ার্থকতা।
০৪.
এবার আসা যাক পুনর্নির্বাচিত আমি’র কবিতাগুলোর প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, কবি অমিতাভ পালের কবিতা প্রথাগত বাংলা কবিতার সাথে মেলে না। বরং চলমান ও ট্রাডিশনাল প্যাটার্নের বাংলা কবিতার সাথে তার কবিতার ফারাক বিস্তর। নিচের কবিতাটির দিকে তাকানো যেতে পারে।
বাল্ব ফিউজ হয়ে যাবার পর অন্ধকার এসে
দাঁড়ালো খাটের চারপাশে
এখন কিছুদিন শোক পালন করা হবে
তারপর আরেকটি নতুন প্রাণীর মতো জন্ম নেবে
নতুন বাল্বের আলো।
(নতুন বাল্বের আলো/ পুনর্নির্বাচিত আমি)
পাঁচ পংক্তির এই কবিতাটি থেকেই পাঠক ধারণা করে নিতে পারেন কবি অমিতাভ পালের ধাঁচ কী রকম। তার কবিতায় ট্রাডিশনাল বাংলা কবিতার গীতলতা ও আবেগ একরকম অনুপস্থিত। তার সমসাময়িক অথবা অগ্রজ অথবা অনুজ কবিগণ যখন আবেগ, গীতলতা, ছন্দ ইত্যাদি বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছেন, শব্দের ঘোর নির্মাণের চেষ্টা করেছেন, সেখানে কবি অমিতাভ পাল এইসব বিষয়ে অনেকটা উদাসীনতাই অবলম্বন করে গেছেন। আরো ভালোভাবে বলা যায় এখনো তাই করছেন কেননা কয়েকদিন আগেও ফেসবুকে তার সাম্প্রতিক যে সকল কবিতার পোস্ট তিনি দিয়েছেন তাতেই বোঝা যায় এখনো তিনি ওইসব ট্র্যাডিশনাল বিষয়ে ভাবিত নন। কনসার্নড নন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে প্রথার বাইরে গিয়ে তাহলে অমিভাভ পাল কী নিয়ে কনসার্নড? আমি বলি, এখনো বলি, আমার ব্যক্তিগত ধারণা থেকে বলি, অমিতাভ পাল থিম বা কনটেন্ট নিয়ে কনসার্নড। তার কবিতায় মৌল ফোকাস এসে পড়ে তার থিমের উপর। কিছু ক্ষেত্রে উপমার উপর। সর্বোপরি জ্যামিতিক নির্মাণের উপর।
যেহেতু তার কবিতা কনটেন্ট নির্ভর, থিম নির্ভর, দর্শনমুখি তাই অবধারিতভাবেই তার কবিতার নির্মিতি এগিয়ে গেছে জ্যামিতিক গঠন শৈলির দিকে। উপরের কবিতাটির দিকে তাকালেই কথাটি একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায় পাঠকের কাছে। তার কবিতায় প্রতিটি পংক্তি, বাক্য এমনকি শব্দও যেন সংগঠিতভাবে একটি উপসংহারের দিকে যাত্রা করে। কবিতাটিকে একটি নির্দিষ্ট সমাপ্তি-বিন্দুর দিকে নিয়ে যেতে থাকে। ফলে তার কবিতায় মূখ্য হয়ে ওঠে বোধ, থিম, বক্তব্য, দর্শন বা যেভাবেই একে আখ্যায়িত করা হোক না কেন - ওটাই। সাথে থাকে নির্মিতির সচেতনা।
০৫.
অমিতাভ পালের কবিতায় বোধের যে বিক্ষেপ আমরা মানে পাঠকেরা পাই তার সাথে বাংলা কবিতার প্রথাগত ধারার মিল কম। মিল বেশি পাশ্চাত্যের ধারার সাথে। কাঠ কাঠ। শুক্নো তার কথা বলার ভঙ্গি। অনেকটা ছুরি চালনার মতো। আকস্মিক।
কে এলো আততায়ী - অস্থির কলিংবেল উচ্চকিত
দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে কার্পেট
কার পদশব্দ শোনা যায়
বাথরুমে নাক ঝাড়ল একটি শাওয়ার
হা হা করে হেসে উঠল সিলিং ফ্যান
একটি বই দ্রুত উল্টাতে লাগল পৃষ্ঠা
ঘড়ি তার শব্দগুলোকে খুলে ফেলে দিলো মেঝেতে
সময় হয়েছে বলে সুটকেসে ঢুকে পড়লো কয়েকটি পোশাক
স্নান সেরে নিল একটি শেভিং কিট
কে এলো আততায়ী/ নাকি ভুল শব্দ
(শব্দময় নির্জন/ পুনর্নির্বাচিত আমি)
একটি জ্যামিতিক ভিত্তির উপরে যেন তার একেকটা পংক্তি একেকটা ইট অথবা ইটের দেয়াল। যৌথ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে নির্মাণ করে নিতে চাইছে সুনির্দিষ্ট ইমারত।
(চলমান)