ব্যাপারটা প্রথম ধরা পড়লো একজন আলোকচিত্রীর কাছে। অভিজ্ঞ একজন আলোকচিত্রী। চল্লিশ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতায় অত্র অঞ্চলের আর সব আলোকচিত্রীকে ছাড়িয়ে গেছে। বয়সও ষাটের উপরে। তবে বোঝা যায় না। চল্লিশের নিচেই মনে হয়। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আসাদের মনে হলো, এই পেশায় হাতেখড়ির সময় সম্ভবত লোকটার আরেকবার জন্ম হয়। দ্বিতীয় জন্ম। চল্লিশ বছর পার হয়ে যাবার পর যখন লোকটাকে কেউ প্রথমবারের মতো দেখে, স্বভাবতই ধারণা করে নেয় আলোকচিত্রীর বয়স চল্লিশের কোঠায়। তারমানে লোকটার আসল জন্মসাল, তারিখ, বার, মাস সব মুছে গেছে। আলোকচিত্রের কাজই তাকে আরেকবার জন্ম দিয়ে একই সাথে তার পিতা এবং মাতা বনে গেছে। লোকটা কি তার পিতার নামের ঘরে ক্যামেরা এবং মাতার নামের ঘরে ফিল্ম লেখেছে কোনদিন! না বোধহয়। এমনটা কেউই করে না। করলে হয়তো আসল পিতা-মাতার সাথে বেইমানি করা হয়। তাই প্রকৃত জন্মকে অস্বীকার করে সঠিক সময়ের জন্মক্ষণ বয়ে নিয়ে বেড়াতে থাকে সারাজীবন।
পাসপোর্ট সাইজের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আলোকচিত্রী যেন ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন মিনিট পাঁচেক। তারপর আসাদের দিকে তাকিয়ে, আসাদ দেখলো, চশমার মোটা কাঁচের মধ্য দিয়ে আসাদের চোখের দিকে একগুচ্ছ বিস্মিত দৃষ্টিরশ্মি ছুঁড়ে দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আলোকচিত্রীর নড়াচড়ায় শামুকের ভাব এসে গেছে। দীর্ঘকাল সমুদ্রলাগা জলে বাস করতে করতে যেন কান্ত হয়ে সৈকত পরিভ্রমণে বেড়িয়েছে। কোন তাড়া নেই, কবে ফিরবে ঠিক-ঠিকানা নেই। কে জানে আদৌ ফিরবে কিনা। চশমার আড়ালে আলোকচিত্রীর দৃষ্টি ঝাপসা হতে থাকে। কিছুটা আর্দ্রও। নোনা জলের ছাপ ফুটতে শুরু করে। সমুদ্রবাসের চিহ্ন সম্ভবত।
আসাদ অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করতে করতে কান্ত হয়ে যেতে চায়। মোটা শরীরের মানুষটার দিকে বিরাট ভরসা নিয়ে আসাদ দাঁড়িয়ে থাকে এবং একসময় পায়ের পেশী টনটন করতে থাকলে, বসে পড়ে। সোফা বা চেয়ারে নয়। সেরকম কোন আসবাব এই স্টুডিওতে নেই। পুরোনো আমলের টুল আছে। দুইটা। কাঠের কাউন্টারের পেছনের টুলটায় আলোকচিত্রী নিজে বসে। আরেকটা কাউন্টারের সামনে। ছবি তুলতে আসা লোকের জন্য। আসাদ সেই টুলে বসে পড়ে। একহাঁটু লম্বা চারপায়ার টুল। পেছনে হেলান দেয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। অবশ্য টুলের অবস্থান দেয়ালের পাশে হওয়ায় আলাদাভাবে হেলান দেয়ার কিছু লাগেও না। বসে আসাদ হাঁফ ছাড়ে। যেন জন্মের পর থেকে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। চব্বিশ বছর পরে বসার সুযোগ পেলো।
কোন কথা না বলে, আশা নিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে আসাদ আর ভাবে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে। আজকের অভাবের দিনে পঞ্চাশ টাকার গুরুত্ব একেবারে কম নয়। একটা ছাত্রকে এক মাস, এক মাসে কুড়ি দিন পড়ালে তবে একশো টাকা পাওয়া যায়। তারমানে তার বিশ দিনের পরিশ্রমের টাকা ছবি তোলার জন্য সে ঢেলে দিয়েছে। ছবি হাতে পেলেই তো ছবির মূল্য দেবে সে। না পেলে দেবে না। কিন্তু যদি আলোকচিত্রী দাবী করে বসে! এখন তো দাবী-দাওয়ার যুগ। দাবী করে বসলেই হলো। কোনো না কোনো ভাবে মানতেই হবে।
নাকের উপরে, দুই চোখের সামনে ঝুলতে থাকা মোটা কাচের মধ্য দিয়ে বেদনায় বিন্যস্ত দৃষ্টি আর পুরু গোঁফের নিচে লুকিয়ে থাকা ঠোঁটজোড়া ফাঁক করে একসময় আলোকচিত্রী নিরবতা ভাঙেন। বলেন, নারে বাবা তোমার ছবি তো উঠলো না। ক্যামেরার কোনো সমস্যার কারণেও হতে পারে। অন্য কোন কারণ তো থাকার কথা না। আচ্ছা এক কাজ করি, তুমি রুমের ভেতরে যাও। আরেকটা ছবি তুলে দেই।
বেশ দ্রুত গতিতে লোকটা তার ছবি তোলার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলো। লোকটার পিছু পিছু আসাদও ছবিকক্ষের ভেতরে গেলো। সেখানে উজ্জ্বল আলোতে আবার একটা ছবি তুললেন আলোকচিত্রী। সাথে সাথে ফিল্ম ওয়াশের ব্যবস্থাও করলেন। খুব দ্রুত এইসব ঘটে গেল কিন্তু আলোকছটার রেশ চোখে লেগে থাকলো বহুক্ষণ। কতক্ষণ? যতক্ষণ না থ্রি আর সাইজের ছবিটা তার হাতে আসে। ছবি এল, অন্তত ছবির মাপের মোটা একটা কাগজ। ব্যর্থতা আর হতাশায় ডুবে সাদা একটা কাগজ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে মূর্তিমান বিধাতার মতো আলোকচিত্রি ঘোষণা করলেন, বাবা দ্যাখো, আমার ধারণা কোন বিশেষ কারণে তোমার ছবি ওঠে না। এমনটা আমি আগে কখনো দেখিনি। কারো কাছেও শুনিনি। তোমার ক্ষেত্রেই প্রথম দেখলাম। আমার মনে হয় তোমার ছবি উঠবে না। কোনদিনই উঠবে না।
কথাগুলো শুনতে শুনতে আসাদের হাত কাঁপে। মাথা ঘুরতে থাকে। শূন্য দৃষ্টিতে আলোকচিত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়, এটা যেন ছবি সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত নয়। এটা যেন জন্ম ও মৃত্যুর মত সিরিয়াস কোন বিষয়। সে ভেবে পায় না কীভাবে এর জবাব দেয়া যায়। কী বলা যায় আলোকচিত্রীকে। অবচেতনেই হয়তো তার হাত চলে যায় প্যান্টের ব্যাকপকেটে রাখা মোটা কাপড়ের মানিব্যাগের দিকে। কাস নাইনে পড়ার সময়, রেজিস্ট্রেশনের আগে একটা ছবি সে তুলেছিলো। কোন স্টুডিওতে বা কার ক্যামেরায় তা আর তার মনে পড়ে না। কেবল মনে পড়ে একটা ছবি বাড়তি থেকে গিয়েছিল। তারপর থেকে আগলে আগলে রেখেছে সে ছবিটাকে। বহুকালের পুরোনো, অনেকটা মলিন ও পাতলা হয়ে যাওয়া ছবিটা সে আস্তে আস্তে মানিব্যাগ থেকে বের করে আলোকচিত্রীর দিকে বাড়িয়ে দ্যায়, বলে, কিন্তু আগে তো উঠতো; এই দেখুন!
আলোকচিত্রী প্রকৃত বিস্ময়ের সাথে ছবিটা নেয়। মোটা কাচের চশমার মধ্য দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে পাসপোর্ট সাইজের ছবিটাকে। যেন কোন পেশাদার জ্যোতিষী সে। ম্যাগনিফাইঙ গ্লাসের ভেতর দিয়ে দেখছে কারো দুর্লভ হাত। আনমনে বলে, তাই তো দেখছি। তাহলে আমার ক্যামেরায় এমন হলো কেন! কোঁচকানো ভুরুর কু-লী অকস্মাৎ সরল হয়ে যায়। আলোকচিত্রীর মুখে ছড়িয়ে পড়ে শিশুর সারল্য মাখা হাসি। জটিল কোন ধাঁধাঁর সন্ধান পাওয়ার পর যেভাবে শিশুরা হেসে ওঠে। বলে, এই ছবিটা তো সাদাকালো। এমন তো হতে পারে যে তোমার সাদাকালো ছবি ওঠে কিন্তু রঙিন ছবি ওঠে না? আগে কখনো রঙিন ছবি তুলেছো তুমি?
আগে কখনো রঙিন ছবি তুলেছে বলে আসাদের মনে পড়ে না। খুব সম্ভবত এখনো পর্যন্ত এই সাদাকালো পাসপোর্ট সাইজের ছবিটাই তার একমাত্র ছবি। সে মাথা নেড়ে উত্তর দ্যায়, না, রঙিন ছবি কখনো তুলিনি।
তাহলে আবার রুমে আসো, একটা ফয়সালা এখনই হয়ে যাক বলে আলোকচিত্রী আবার ছবি তোলার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখারও প্রয়োজন বোধ করে না, আসাদ এই প্রস্তাবে রাজি আছে কি-না। সাদাকালো ছবিতে আদৌ তার চলবে কি-না। আর আসাদও সম্মোহিত মানুষের মত আলোকচিত্রীর পেছন পেছন ছবি তোলার ঘরে ঢুকে পড়ে। হালকা হাসির ভঙ্গি করে তাকায় উজ্জ্বল আলোকগুচ্ছের দিকে এবং চোখে আলোকজড়তার রেশ মেখে আবার ফিরে আসে কাউন্টারে। আলোকচিত্রি আসে আরো আধা ঘণ্টা পর। মুখভরা উজ্জ্বল হাসি। পাসপোর্ট সাইজের সাদাকালো ছবিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আমার ধারণাই ঠিক। তোমার সাদাকালো ছবি ওঠে। কিন্তু রঙিন ছবি ওঠে না। তুমি আমাকে তিরিশ টাকা দাও। সাদাকালো ছবির জন্য পঞ্চাশ টাকা নিলে ব্যাপারটা খারাপ হয়ে যাবে। আমার স্টুডিও তে সাদাকালো ছবির রেট হলো ত্রিশ টাকা। পাসপোর্ট আকারের জন্য। এর বেশি নেয়া যাবে না।
০২.
এভাবেই শুরু। এরপর আরো বহুবার বহু আলোকচিত্রীকে দিয়ে সে নিজের একটা রঙিন ছবি তুলিয়ে নেবার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোথাও সফল হয়নি। আস্তে ধীরে তাকে এতদ অঞ্চলের সব আলোকচিত্রিই চিনে ফেললো। কেননা সে প্রত্যেকের কাছেই কয়েকবার করে গেছে। কয়েকবার চেষ্টা করেছে নিজের একটি রঙিন ছবি তুলিয়ে নেবার। কোথাও সফল হয় নি।
সাফল্য ধরা দেয় নি বলে হার মানার পাত্র সে নয়। সাড়ে চারশো টাকা দিয়ে সে একটা পুরোনো, বহু পুরোনো ফিনিক্স বাইসাইকেল কিনে ফেলে। কন্ডিশান খুব ভালো নয়।
প্রথম ক্রেতা কমপক্ষে এগারো বছর সাইকেলটা চালিয়েছে। তার সাইকেলের রুট ছিলো ক্ষেতের আইল থেকে শুরু করে মাঠের চর। ফলে সাইকেলটা কান্ত হতে হতে একসময় মালিকের বিরক্তি ধরিয়ে দ্যায়। মালিক ভাবে এই পচা, ভাঙাচোরা, তালিপট্টিমারা সাইকেল কে কিনবে। এমন কন্ডিশনের সাইকেল কেউ কিনবে বলে তার বিশ্বাস হয় না। তবু সে বাজারের দোকানে গেলে যে হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের ঘরে বসে আড্ডা মারে, সেই জ্যোসনা ডাক্তার, এইচ এম বি- এর চেম্বারে বসে ঘোষণা করে, সাইকেলটা বিক্রি করে দেবো। বহুদিন তো চালালাম, এবার একটা মটরসাইকেল কিনবো। আদপে তার হয়তো মোটরসাইকেল কেনার শখ বা প্রয়োজনীয় অর্থ কোনোটাই নেই, তবু একটা না একটা কারণ দেখাতে হয় বলে, মোটর সাইকেলের কথা বলে।
সৌভাগ্যক্রমে আসাদ তখন জ্যোসনা ডাক্তারের চেম্বারেই ছিলো। অনেক বছর আগে মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় আসাদের ডান পায়ের তালুতে একটা কাঁটা ঢুকে গিয়েছিলো। আসাদের সন্দেহ বেলের কাঁটা। কারণ কাঁটাটা যখন ফোটে তখন সে আরেকজনের হাত ধরে বেলগাছের তলা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো। যার হাত ধরেছিলো, সে হাত ছেড়ে গেছে; কাঁটা যায় নি। টেনে বের করতে গিয়েও কাঁটার মাথার সামান্য অংশ পায়ের ভেতর থেকে যায়। সে পাত্তা দেয় নি। ভেবেছিলো, সামান্য কাঁটার অতি সামান্য অংশ। পায়ের ভেতর থেকে গেলেই বা কী হবে! প্রথম দিকটায় একটু ব্যথা হতো। খুব অল্প। তারপর ব্যথাটাও কেটে যায়। কিন্তু চিরতরে কাটে না। বহু বছর পরে আবার ব্যথাটা ফিরে আসে। গোড়ালির তলার চামড়াটা শক্ত হয়ে যায়। অনেকেই দেখে বলে, এটা তো বয়রা হয়েছে তোমার। হ্যাঁ, বয়রাই। কয়েকবার জয়নাল ডাক্তারের কাছে গেছে। জয়নাল ডাক্তার বলে, অষুধের দিন শেষ মিয়া তোমার বুঝলা। অহন অষুদ খায়া আর কাম হইতো না। ব্যাদনা কমানির অষুদ খাইতে পারো। খাইলে ব্যাদনা কমবো। বয়রা কমতো না। এই বয়রার চিকিৎসা হইলো অপারেশন। পায়ের তালুর মাংস কাইট্টা হালার কাডারে বাইর কইরা আনতে হইবো।
অপারেশনে নাম শুনেই আসাদ ঘাবড়ে যায়। শব্দটার মধ্যেই যেন মাংস চিরে ফেলার মতো বেদনা-সঞ্চারী ক্ষমতা আছে। সে ওই ভীতিপ্রদ, বেদনাসঞ্চারী শব্দের কাছে হেরে যায় এবং কবিরাজের কাছে যায়। কবিরাজের কথা মতো অষুধ খায় চার মাস। তবু বয়রা কমে না। তারপর সে চলে আসে জ্যোসনা ডাক্তার, এইচ এম বি- এর কাছে এবং দেখতে পায় হ্যাংলা-পাতলা, মোটা গোঁফঅলা একজন মানুষ বলছে, সাইকেলটা বিক্রি করে দেবো। সে আঁতকে ওঠে। সে জীবনে বহুবার স্বপ্ন দেখেছে একটা ঝা চকচকে ফিনিক্স সাইকেলের। পালিশ করা কালো রঙ। জ্যান্ত ক্রিং ক্রিং আওয়াজের বেল। এবং চলন্ত সাইকেলের চাকার মিহি সুরেলা শব্দ। জ্যোসনা ডাক্তার তাকে অষুধ দেয় আর বলে, এই জায়গাটা ফুলে যাবে। ছোট্ট একটা ফোঁড়ার মতো হবে। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। সেই ফোঁড়ার মধ্য দিয়েই কাঁটার অংশটা বেরিয়ে আসবে। কাঁটাটা যেদিন বেরোবে, সেইদিন এসে আবার সাক্ষাৎ করবেন। অষুধ বদলাতে হবে। জ্যোসনা ডাক্তারের কথায় এত আতœবিশ্বাস ঝরে পড়তে থাকে যে আসাদ কাবু হয়ে যায়। আট টাকা দিয়ে দুই সপ্তাহের অষুধ কিনে ফেলে আর ভাবে আহা, এই ডাক্তার যদি এমন একটা অষুধ দিতো যে অষুধ খেলে রঙিন ছবি না ওঠার অসুখ সেরে যায়, তাহলে খুবই ভালো হতো। এটা কি ডাক্তারকে বলা যায়! অন্তত রোগী হিসাবে আসার প্রথম দিনেই? বলা উচিৎ হবে না ভেবে আসাদ অষুধের টাকা গুনে দিয়ে সেই লোকটার দিকে ফেরে যে তার সাইকেলটা বিক্রি করতে চেয়েছিলো। বলে, আপনার সাইকেলটা আমি নেব। একবার দেখা যাবে কি?
Ñ কেন দেখা যাবে না, এই তো সামনেই আছে, মাটির বারান্দায়, বাঁশের খুঁটিতে হেলান দেয়া।
আসাদের চোখ দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। মাটির বারান্দার উপরে বাঁশের খুঁটিতে হেলান দেয়া একটা সাইকেলের দিকে। মলিন। রঙ বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। তার কল্পনার সাইকেলের ঠিক বিপরীত বলা চলে। হোক না, তাও সাইকেল তো। চললেই হলো। সে আর কিছু দেখতে চাইলো না। এমনকি সাইকেলটাকে একবার হাত দিয়ে ধরেও দেখতে চাইলো না, বিক্রেতার দিকে তাকিয়ে বললো, কত দাম দিতে হবে?
বিক্রেতা এতটা প্রত্যাশা করেনি। ফলে তার চোখ ভিজে যায়। জলের ফোঁটা ভেসে উঠতে থাকলে সে আবেগ সামলানোর জন্য জ্যোসনা ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ডাক্তার দা, কত চাওয়া যায় দাম?
Ñ ওই সাইকেলের দাম আর কত হবে। সাইকেলের ‘স’ ও তো নাই ওইটার মধ্যে। দামের কথা ছাড়। শ’তিনেক টাকার মধ্যে দিয়া দেও।
আসাদের পকেটে প্রায় হাজার খানেক টাকার মতো ছিলো। সে ভাবলো, তিনশো টাকায় সাইকেল হলে তো মন্দ না। কেজি হিসাবে বেচলেও এর চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যাবে। তাই সে বলে, আমি রাজি। কিন্তু বিক্রেতা বাগড়া দেয়, বলে, আমি রাজি না। পাঁচশো টাকার কমে বিক্রি করবো না। রাজী থাকলে টাকা দিয়া সাইকেল নিয়া যান। না থাকলে আর কথা নাই।
অবশেষে সাড়ে চারশো টাকায় রফা হলে, আসাদ সাইকেলের সীটে বসে ক্রিং ক্রিং বেল বাজাতে বাজাতে বুক পকেটে বয়ড়ার জন্য কিনে আনা সাইলেশিয়ার দুই ডোজ নিয়ে বাড়ি ফেরে এবং বহুদিন পর তার মন এক অনাবিল আনন্দে ভরে যায়। রঙিন ছবি না ওঠার অসুখের কথা ভুলে গিয়ে সে ঘুরতে আরম্ভ করে। ঘুরতে ঘুরতে বহু স্টুডিওর সামনে দিয়ে বেল বাজাতে বাজাতে সে চলে যায়। গুন গুন করে কী একটা গানও যেন গায়।
কী গান গায়? কী গান গাইতে গাইতে সে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেয়। কেবল সাইকেলের ছেঁড়াখোঁড়া সিটে বসে, পাদানীবিহীন প্যাডেলে পা চালাতে চালাতে সে জানে না। হয়তো সাইকেলকেই তার দেবতা মনে হয়। গতির দেবতা। এবং চাকা তার বাহন। অবশ্য আসাদের গতিগ্রস্ত এই অবস্থা খুব বেশিদিন টেকে না। কিছু দিন যেতে না যেতেই আবার তাকে গ্রাস করে নিতে থাকে রঙিন ছবি তুলতে না পারার ব্যর্থতা। সে আবার পুরোনো সেই আলোকচিত্রিদের কাছে যেতে শুরু করে।
০৩.
এইভাবে কতদিন কাটে?
এইভাবে ততদিন কাটে যতদিন না তার ঘুম-ভাঙা চোখে একটা ভাঙা সাইকেল আর ঠিক পাশেই রেখে দেয়া একটা ঝা-চকচকে মোটর সাইকেল ভেসে ওঠে। সে প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারে না। মনে হয়, এটা কোনো স্বপ্ন হতে পারে। তার বাড়িতে কেউ মটর সাইকেল আনতে পারে? জন্মের পরে এমন দৃশ্য কখনো চোখে দেখেছে কিনা স্মরণ করতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বার বার মাথা ঝাঁকি দেয়। যেন কোন বিভ্রম মগজের গভীরে পাকিয়ে উঠলেও ঝাঁকির প্রচ-তায় তা সরে যাবে। আসাদকে নিয়ে যাবে প্রকৃত দৃশ্যের কাছে।
খানিকটা আশ্চর্যই হতে হয় তাকে যখন তার ডান চোখে একটা ছোট্ট পোকা এসে পড়ে এবং ঘটনার আকস্মিকতায় সে ডান চোখটা বন্ধ করে নেয়। ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়ে সে বাইরে তাকায় যেখানে একটা পুরোনো জরাজীর্ণ, ভাঙা, রঙ জ্বলে যাওয়া সাইকেলের পাশাপাশি ঝা চকচকে একটা মোটর বাইকও রাখা আছে। এখানেও সে ব্যর্থ হয়। মোটর বাইকটাকে দেখতে পায় ঠিকই কিন্তু সাইকেলটাকে পায় না। আবার চোখে যন্ত্রণা দিয়ে যাওয়া পোকা উড়ে গেলে সে যখন শুধু বাম চোখ দিয়ে তাকায় তখন দ্যাখে, তার ভাঙা সাইকেলটা ঠিকই আছে কিন্তু কোনো মোটর বাইক নেই। এই দৃষ্টিবিভ্রম, দৃশ্যবিভ্রম তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং সে অবোধ শিশুর মতো দুই করতল জড়ো করে নিজের মুখ গুঁজে দেয় আর কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সে হেসেও ফ্যালে। পাগলের মতো অট্টহাসি। টলতে টলতে সে এগিয়ে যেতে থাকে অভীষ্ট দৃশ্যের দিকে এবং যাওয়ার পথে একটা চারা খেজুরগাছ থেকে তুলে নেয় খেজুর পাতা। আস্তে আস্তে ডান চোখ বন্ধ করে বাম চোখের মণির মধ্যে খেজুরের কাঁটাটাকে অনেকটা ঢুকিয়ে দেয় সে। রক্ত গড়াতে শুরু করলে আবার হাসতে আরম্ভ করে সে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় তার ভাঙা সাইকেলের দিকে। পরম মমতায় হাত বুলাতে শুরু করে সাইকেলের সিটে, বডিতে, ক্যারিয়ারে। তার খুব কান্না পায় আবার। সে জানে রঙিন ছবি তোলাতে না পারলে অনেক চাকরীরর আবেদন করার যোগ্যতা সে হারিয়ে ফেলবে। তবু তার অশ্রুর সাথে সাথে যেন একটা একটা কাঁটা ঝরতে শুরু করে। সে টের পায় পায়ের তালুতে, যে জায়গায় কাঁটা ফুটেছিলো, সেখানটায় খুব ব্যথা হচ্ছে। মাটিতে বসে সে তার পায়ের তালুটাকে টেনেটুনে একটা মাত্র চোখের সামনে নিয়ে আসে এবং দেখতে পায় কাঁটার মাথার মতো খুব ক্ষুদ্র কী একটা যেন তার পায়ের তলা ভেদ করে বাইরে আসতে চাইছে। ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ দিয়ে চিমটার মতো বানিয়ে সে আস্তে আস্তে বহুক্ষণের প্রচেষ্টায় তুলে আনে বেলতলা দিয়ে হেঁটে আসার সময় তার পায়ে বিঁধে যাওয়া সেই পুরোনো কাঁটাটাকে। হাত যে ধরেছিলো বহুকাল হলো সে ছেড়ে গেছে। পায়ে যা বিঁধেছিলো তাও যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। যেন ঘাম দিয়ে তাার বহুদিনের, বহুরাতের চোরাজ্বর ছেড়ে যায়। অদ্ভুত আনন্দে স্থানু হয়ে যায় মন। সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে সে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে। তার চিৎকার শোনে ভাঙা সাইকেল, আশপাশের লোকজন। সেই অভিজ্ঞ আলোকচিত্রিকেও শ্রোতাদের মধ্যে খুঁজে পায় সে। তবে কারো দিকে তাকানোর মতো ফুসরত তার তখন নেই। সে শুধু আপন মনে চেঁচাতে থাকে, রঙিন ছবির জগতে আর আমি নেই; মোটরবাইকেও না।
###
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১০:০২