ঈদের আগের দিন ছিল রবিবার। দুর্ভাগ্যক্রমে। বাসায় থেকে সারাদিন কাজ করতে হয়েছে রান্নাঘরে। দিন শেষে অবসর হয়ে বসলাম বাসার সবার সাথে। আড্ডাবাজি করতে করতে মেহদী পর্ব চলল। রাতে শুতে শুতে বারোটা। পরের দিন যখন শুরু হতে চাইল পাঁচটায়, তখন একটু কষ্ট হল বটে! অনেক বকা খেয়ে অবশেষে বাথরুমে ঢুকলাম। সময় সীমা দেয়া হয়েছিল পাঁচ মিনিট। গোসল সেরে বেরুতেই সবার সাথে নাস্তা খাওয়া। তারপরে হুটহাট রেডি হওয়া এবং ঈদের নামাযে যাওয়া।
আমাদের এলাকাতেও আছে ঈদের জামাত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বরাবর গিয়ে আসছি বাইসেন্টেনিয়াল পার্কের ঈদের জামাতে। বাইসেন্টেনিয়াল পার্কেই সিডনী অলিম্পিক পার্ক। ২০০০ সালের অলিম্পিক হয়েছিল যেখানে। বিশাল, সুন্দর পার্কটা অতিথিদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি। সিডনী সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব ভাল ধারণা নিয়ে যেন যায়। খুবই ওয়েল মেইনটেইনড পার্কের ঘাসের সবুজ দেখলে পাগল হতে হবেই। এক পাশে বিশাল এক কৃত্রিম লেইক। পার্কের সবুজের সাথে লেইকের নীল, সুন্দর দিন দেখে পার্কে আসলে ফিরতে ইচ্ছে হয় না একদম। আমি আজ অব্দি পার্কটার পুরোটা দেখি নি, এতই বড়।
এবার বলি ঈদের জামাতের কথা। ঈদগাহ তো অসম্ভব। গত কয়েক বছর ধরে কাউন্সিলের অনুমতি নিয়ে সিডনীর মুসলিমেরা নামাজের আয়োজন করছে এই পার্কে। রীতিমত মিডিয়া কাভারেজ পায়, তাই উল্টা পাল্টা কিছু হয় না। হয় নি। তাই হয়তো, অনুমতি পাওয়া যায় প্রতি বছরই।
আমাদের বাসা থেকে ওখানে যেতে সময় লাগল এক ঘন্টা। পার্কের কাছাকাছি গিয়ে ফ্রী ওয়ে থেকে বের হয়েই টাসকি খেতে হল। পার্কে ঢুকার রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার লম্বা লাইন। প্রতিটা গাড়িতে দাড়িওয়ালা বা হিজাব পরিহিতা মানুষেরা বলে দিচ্ছে ওরাও নামাজে যাচ্ছেন। রাস্তার উপরে 'ইমারজেন্সি ট্রাফিক কনডিশন' এর জন্য বরাদ্দকৃত ডিজিটাল সাইনবোর্ড দেখি জ্বল জ্বল করছে, 'ঈদের নামাজের জন্য পার্কিং করুন পি-৩ এ'। অস্ট্রেলিয়া এভিনিউয়ে ওই লেখাটুকু পড়ে মন কত খানি ভাল হয়েছে বলে দেয়া লাগবে?
খুব কষ্টে গাড়ি পার্ক করে দৌঁড়ে গেলাম নামাজের ওখানে। এবার শুনুন নামাজের কথা। দিনটা ছিল ফাটাফাটি। ঝাক্কাস টাইপ। স্বচ্ছ নীল আকাশ। পাশের লেইকের স্বচ্ছ নীল পানি। সবুজ, সবুজ ঘাস। তার মাঝে ছয় হাজার মুসলিম। হ্যা তো, ভুল শুনেন নি... ছয় হাজার মুসলিম। আজ কিন্তু সোমবার ছিল। সব অফিস, স্কুল খোলা থাকার কথা। তারপরেও, অন্যান্য বারের চেয়ে বেশিই মনে হল মানুষ জন। প্রথমে পুরুষদের সারি। তারপরে, কয়েক মিটার পরে মেয়েদের সারিগুলো। একবার চিন্তা করুন তো, পৃথিবীর সব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জায়গাগুলো থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, খোলা আকাশের নিচে আরও হাজার মানুষের সাথে স্রষ্টার দিকে সিজদা অবনত হতে ঠিক কেমন লাগে?
নামাজ সেরেও সেখানে থাকলাম অনেক্ষণ। একটু কল্পনা করে দেখার চেষ্টা করুন না পরিবেশটা, তাহলে বুঝবেন কেন থাকলাম। এখানে সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে উইনি দ্যা পু বা ক্লাউন সাজা ভলান্টিয়ারগুলো, পিছনে এক দঙ্গল পিচ্চি। জাম্পিং কাসেলের সামনেও বাচ্চাদের বিশাল লাইন। সেখানে বাচ্চাদের উপহার আর বেলুন দেয়া হচ্ছে। বাচ্চাদের আজ খুব খুশি। স্কুলে যেতে হয় নি যে! বড়দের জন্য খাবার আর ড্রিংকস ফ্রি। কেমন উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে। এই ভাবটুকু, আমি কিন্তু বাংলাদেশেও একবারও পাই নি। সেখানে দেখা হয়ে গেল পরিচিত অনেকের সাথে।
অবশেষে গাড়িতে ফিরলাম। নিজেদের বাসায় না কিন্তু। তখন শুরু হল গাড়িতে করে বাসায় বাসায় ঈদ ভিজিট। সে কি অত্যাচার! ছয়টা বাসায় গিয়ে যন্ত্রনাদায়ক পর্যায়ের ভরা পেট নিয়ে বাসায় এসে দুপুরে ঘুমিয়ে নিলাম এক চোট।
বিকেলে মায়ের জ্বালায় ঘুম থেকে উঠতেই হল। সালাদ কাটতে হল এক গাদা। কারন? রাতের মেহমান সেবন। সবাইকে বলাই ছিল সকালে বাসায় থাকব না। সবাই আসা শুরু করল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে। গেলেন এগারোটার দিকে। এই পুরো চার ঘন্টা আমাদের বাসায় ছিল উনসত্তর জন মানুষ। হ্যা, ঠিক শুনেছেন। উনসত্তর জন মানুষ। একই সাথে। এর মধ্যে যেমন ছিল পঞ্চাশোর্ধ মানুষেরা। তেমনি ছিল দেড় দিনের এক পিচ্চি। ওর মা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমাদের বাসায় চলে এসেছে। গমগমা বাসাটা ছাড়া ঈদের কিছুই বুঝতে পারবে না তাই। অন্তত ত্রিশটা পিচ্চিকে কি করে সামলিয়েছি চার ঘন্টা তাই ভেবে নিজের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছি। মায়েদের তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, শাড়ি পড়েছেন সব... দেখাতে হবে না? ছিল বাংলাদেশ থেকে আসা এক গাদা স্টুডেন্ট। মায়ের খুব মায়া লাগে মা বাপ ছাড়া ঈদ করতে থাকা পোলাপানগুলার জন্য।
উনসত্তর জন মানুষেরা হয়েছেন কিন্তু খুব ঘনিষ্ট অনেককে ছাড়া। ওরা আসবেন আগামী কাল বা পরশু। অথচ আজই দিনের শেষে আগের কয়েক দিন ধরে রাধা সব রান্না ঠেকেছে তলানিতে। কি অদ্ভূত ব্যপার, এই মানুষগুলোকে চার বছর আগে আমরা চিনতাম না। অথচ এদের ছাড়া ঈদ যে একেবারেই অসম্পূণ!
দিনের শেষে সারা বাসায় হাঁটা যাচ্ছিল না ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাত আর টিস্যুর জালায়। এখানে সেখানে পর্দার আড়ালে গ্লাস। সিংক উঁচু করা প্লেটের পাহাড়। সব একদম ভুলে গিয়েছি পিচ্চিগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে। ভাঙাচুড়া উচ্চারনে কি সুন্দর করে বলছিল, 'ঈড মুবারাক'! ললি ব্যাগগুলো হাতে পেয়ে সে কি খুশি!
আর গিফট এক্সচেঞ্জ... ঈদ শুরু হতে না হতেই পেয়ে গেছি এক গাদা উপহার।
সবে তো শুরু... কাল দিনটা কাটাবো বন্ধুদের সাথে। ইশিদের বাসায়। ন্যাডু মনি ড্রাইভ করবে, আমরা বহুত পাগলামি করব। তারপরে দুই দিন পড়াশোনা আছে। তারপরে শনিবার একটা ঈদ রিউইনিঅন। আর রবিবার মালটিকালচারাল ঈদ ফেস্টিভেল এন্ড ফেয়ার। সেখানে প্রতি বছর মানুষ হয় তিরিশ হাজার। সেগুলো আসবে... পর্যায়ক্রমে...

তো, বলুন আপনারাই, পিছিয়ে আছি বুঝি খুব বেশি?
[ওহ, ছবিটা আমার না-পড়া-ঈদের শাড়ির। পুচকিদের সাথে কোস্তাকোস্তির পোশাক হিসেবে সালওয়ার কামিজের উপর ভরসা করতে হয়েছে।]

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।

