যখন জিগাতলায় থাকতাম, তখন পাশের বাসার মেহরানের আম্মু আমার আর ভাইয়ার চরম শত্রু ছিলেন। কারণ, স্কুল থেকে প্রতিদিন বাসায় ফিরে দেখতাম, বাসায় ছোট্ট ফুটফুটে মীরা নেই, ওর পাকনামি নেই, নরম মুঠির চুল টানাটানি নেই, খিল খিল হাসি নেই। পাশের বাসার মেহরানের আম্মু মীরাকে ছিনিয়ে নিয়েছে...
আমাদের সে কি রাগ! আমাদের আপুকে কেন নিবে সব সময়? ওরা নতুন বাবু আনতে পারে না? আমরা যত ক্ষেপতাম, আন্টি তত হাসতো। একবার তো স্কুল থেকে এসে মীরাকে না পেয়ে খুব রেগে মেগে পাশের বাসায় যেতেই দেখি লোহার গেইটটা বন্ধ। দুম দুম করে ধাক্কাতেও কেউ খুলে না। বাসায় যেই মহিলাটা কাজ করতো, তিনি বন্ধ গেইটের ওপাশ থেকে সে কি হি হি হাসি! ছোট বোনকে তো উদ্ধার করতেই হয়! ক্লাস ওয়ানে পড়া ভাইয়া তখন ঝটপট গেইট টপকালো। তারপরে ভিতর থেকে দরজা খুলে দিয়ে আমার হাত ধরে সোজা আন্টির বেড রুম। 'আমরা আমাদের আপুকে চাই!' ভাইয়ার কড়া গলার নির্দেশ। আন্টি হাসতে হাসতে কুটি কুটি। আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল।
অদ্ভূত কান্ড, ওই বাসা থেকে যখন প্রথম গেলাম এসএম হলের বাসায়, তখন আন্টিকে জড়িয়ে মায়ের সে কি কান্না! আমাদেরও ক্যামন ক্যামন লাগছিল।
তারও আগের পাশের বাসার সাত্তার আন্টি মনে দাগ কেটে আছেন নিয়মিত আমাকে বউ সাজিয়ে দেয়ার জন্য। একটু বড় হওয়ার পরে পাশের বাসার তানভীর ভাইয়ার আম্মু, কনু আন্টির কাছে ছিল আমার যাবতীয় আবদার। স্কুল থেকে ফিরে নিয়মিত আন্টির বিছানায় পা তুলে বসে আচারের বয়াম শেষ করতে করতে হাবি জাবি গল্প। আন্টির রান্না ছিল জগৎ বিখ্যাত, বাসায় থাকতেন আর সারাদিন বিভিন্ন নতুন রান্না করে বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। এবার বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে আন্টির বাসায় গেলাম আগে থেকে না জানিয়ে। আন্টি, আমার, মায়ের সবার চোখে পানি!
মা বাবা বাসায় নেই সপ্তাহ দু'য়েক। যাওয়ার আগে ফোনের পাশে একটা খাতা রেখে গিয়েছেন ফোন আসলে সব লিখে রাখার জন্য। ইতিমধ্যে বেশ খানিকটা ভরে গিয়েছে। প্রথমে ভয় পাচ্ছিলাম আগা গোড়া রান্না করার কথা চিন্তা করে। অথচ বেশ কয়েকদিনই কাটলো দাওয়াতে দাওয়াতে, সাথে আন্টিদের স্নেহময় উৎকণ্ঠা, আবার ফিরার সময় বক্সে বক্সে খাবার
আন্তরিকতাটা টের পাওয়া যায়, বুক ভরে যায়। আমরা অস্ট্রেলিয়া আসার পরের কয়েকটা দিনের কথা মনে পড়ে। পুরো এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় কাটিয়েছি দুই জনের বাসায়। দ্্বিতীয় জনকে তো আগে চিনতামই না। বাসায় চমৎকার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও পুরোটা সময়ে গাড়ি দিয়ে এখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া, বাসা দেখা, সিডনী সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেয়া... কি হয় নি? এমনকি নতুন বাসায় যখন উঠলাম বিহবল আমরা, তখন দেখি ফ্রিজ, আলমারি থেকে শুরু করে সবই আছে, এর তার কাঁচুমাঁচু স্বীকারোক্তি, 'আমাদের আর দরকার নেই, কিছু মনে না করলে অল্প কিছুদিনের জন্য ব্যবহার করতে পারেন'। মনে আছে, প্রথমে যখন ওয়াশিং মেশিন ছিল না, তখন কয়েক ব্লক পরের আন্টি নিজে বাসায় এসে কাপড় নিয়ে যেতেন মেশিনে ধোয়ার জন্য, হাজার আপত্তিও শুনতেন না একদম। বাসা বদলানোর সময় সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে সমস্ত রান্না... প্যাকেটে করে বাসায় চলে আসলো। আর ওই যে আঙ্কেলটা খুব অসুস্থ হয়ে গেল, তখন মা হাসপাতালে যাওয়ার পরে মাকে জড়িয়ে আন্টি যেভাবে কাঁদছিল, আপন বোনকে জড়িয়ে ধরেও কি সেভাবে কাঁদে? আশে পাশের কারো বাবু হতে পারলেই হয়েছে, মা যত ক্লান্তই থাকুক, রান্না করে দিবেই।
রেড ক্রস, মিশন অফ হোপের মত কিছু সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে কাজ করে চিন্তা করে দেখলাম, ওরা যেই সমাজ সেবা করছে, আমাদের বাঙালী আন্টিরা কোন রকম স্বীকৃতি ছাড়াই, রক্তের বন্ধন ছাড়া, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব ছাড়া তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি সমাজ সেবা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সমাজসেবীদের একটা অংশ নার্সিং হোমে গিয়ে বুড়ো বুড়িদের সাথে সময় কাটায় সপ্তাহে একবার। নানুকে নিয়ে নানুর এগারো সন্তানের টানাটানি দেখলে নি:সঙ্গ বুড়োবুড়িগুলোর জন্য খুব মায়া হয়। চাইলড কেয়ারে সন্তান রাখা নিয়ে বাবা মায়ের কত দুশ্চিন্তা, অথচ ছোট বেলা অযাচিত চাইলড কেয়ারিং পেতাম পাশের বাসার মেহরানের আম্মু আন্টি থেকে। আমি ভাবছিলাম, আশ্চর্য সমাজে আছি। সমাজের ভেঙে পড়া না ঠেকিয়ে ভেঙে পড়ার পরে সেগুলো জোড়া লাগানোর অদ্ভূত ঠুনকো দড়ি আবিষ্কার করছে। অথচ বাঙালি আন্টিদের মায়া, স্নেহ আর ভালবাসার সুপার গ্লু থাকলে এতটা বেড়াছ্যাড়া কি লাগতো কখনও?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




