ফুলেল বিরম্বনা!
কাল রাতে অফিস থেকে আমার বাসায় যাবার পথে প্রচন্ড জটলায় সাইন্স ল্যাবোরেটরি থেকে ধানমন্ডি ৩,৪,৫,৬ নম্বর রোডে ঢুকতে মিরপুর রোডে আটকে পরেছি আরো শত শত যান-বাহনের সাথে আমিও। প্রচুর নারী-পুরুষ ফুল, ফুলের মালা হাতে যাচ্ছেন প্রধান মন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে। আমরা অসংখ পথচারী, যাত্রীবাহি যান বাহন নিয়ে আটকে আছি। ফুলের তোড়া, ফেস্টুন হাতে প্রায় সব মানুষগুলোই গাড়ীর পাশ কাটিয়ে যাবার সময় গাড়ীর উপড় একটা চাটি মেরে চলে যাচ্ছে-যেনো গাড়ীগুলো "ঢোল-তবলা"! সামান্য একটু সহযোগীতা করলেই গাড়ীগুলো অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারে-কিন্তু মিছিলকারীদের অহমিকা-তারা "প্রধান মন্ত্রী"কে ফুল দিতে যাচ্ছে-কাজেই তাদের ক্ষমতা অপরিসীম! তারা কেনো সাধারন মানুষকে আগে যেতে দিবে!! প্রায় ত্রিশ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে যেইনা একবার হর্ণ বাঁজালাম অমনি ফুল এবং ফুলের মালা হাতে একদল টগবগে যুবক রক্ত চক্ষু করে আমার দিকে তেড়ে আসলো। হুংকার দিলো-"ফিইররা হরন বাজাইলে গাড়িগুরি ভাইঙ্গা এক্কেবারে পু.....'র মধ্যে হান্দাইয়া দিমু"! আমার কাচু-মাচু ভয়ার্ত চেহারা দেখে দলবদ্ধ যুবকদের সাথে থাকা অনেক বর্ণীল যুবতীরাও হেসে খুন!
একটা এম্বুলেন্স প্যাসেন্ট নিয়ে উলটো দিকের ল্যাব এইড হাসপাতালে যেতে পারছেনা। পুলিশের সাহায্য চাইলে অসহায় পুলিশ অন্য দিকে চলে যায়। তারপর কয়েকজন ধরাধরি করে স্টেচারে করে প্যাসেন্ট নিয়ে রাস্তা পার হয়ে যায়। আমি অন্য সবার মত নির্বাক, নিশ্চল বসে আছি বিড়ি-মুড়ি খাওয়া ভারাটে রাজনৈতিক কর্মিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে যাবার জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে।
আমাদের দেশে ফুলেল সম্বরর্ধনার ব্যাপক প্রচলন করেছিলেন লেঃজেঃহোঃমোঃ এরশাদ। তিনি ফুল খুব ভালোবাসতেন। খু-উ-ব বেশী ভালোবাসতেন রজনীগন্ধা। নিজে যখোন যেখানে ফিতা কাটতে যেতেন সবাইকে তখোন ফুল দিয়ে সমবর্ধনা দিতে বাধ্য করতেন। সারিবদ্ধ কুমারী মেয়েরা তার যাত্রা পথে ফুলের পাপড়ী ছিটিয়ে দিত, রং-বেরংযের কুলা হাতে নিয়ে শুয়ে বসে "কুলা নৃত্য" করা হতো। নরম পাপড়ীগুলো সুন্দর হাতের উত্তাপ হারিয়ে যাবার আগেই পীচ ঢালা পথে লুটিয়ে পড়তো আর সেই পথে জঙ্গলী বূটের তলায় পিশে ফেলতো সেই সুবাসিত কোমল ফুল-স্বৈরাচারী এরশাদ। এরশাদের মুখে পরিপুর্ণতার, পরিতৃপ্তির হাসি-দুপাশে দন্ডায়মান জনারন্যের দিকে হাত উঁচু করে মাথা উঁচু করে চলে যেতেন তিনি-সেই দৃশ্য টেলিভিশনে প্রতি দিন আমরা দেখতে বাধ্য হতাম। আমি সেই দৃশ্য দেখে মনে করতাম ইংরেজ কবি ব্রাউনিং এর একটি কবিতার অবিশ্বরনীয় কয়েকটি লাইনের কথা-"there was roses, roses all the way".
সে দিন ছিল দেশ প্রেমিক বীরের যুদ্ধ জয় শেষে দেশে ফেরার দিন। তাঁকে সম্বর্ধনা দিতে সারা পথে বিছানো হয়েছিলো লাল গোলাপ। দু'পাশে জনারণ্য। সমস্ত শহর ভেঙ্গে পড়েছে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য। সেই সঙ্গে নেমেছে মানুষের ভালোবাসার ঢল। যেনো চাইলেই এই মুহুর্তে এনে দেবে আকাশের চাঁদ। বীর ফিরে এলেন এক রাশ ফুল মাড়িয়ে ভালোবাসার পাপড়ীতে ভর করে।
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ব্যাবধান অনেক বেশী। তারই ফলশ্রুতিতে বছর ঘুড়তে না ঘুড়তেই ভিন্ন দৃশ্যপট! সেদিনও মানুষ উপছে পরেছিলো। কিন্তু শহরে নয়-বদ্ধভূমিতে। প্রবল বর্ষনের মধ্যে শকট বন্ধী বীর'কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বদ্ধভূমির দিকে। সেখানে জনতার ললুপ দৃস্টির মাঝে লুটিয়ে পড়বে বীরের মাথাটি। আজ আর ভালোবাসার কোলাহল নেই। নেই কোন ফুল, ফুলের পাপড়ীর সমারোহ।
রাজনীতির জগতে একটা শাশ্বত সত্য পরান পেয়েছে কবি ব্রাউনের কবিতার লাইনটি। একটা বৈপরীত্য ঘিরে জনপ্রিয়তার ক্ষণস্থায়িত্ব মূর্ত হয়েছে কবিতাটিতে। আমাদের কাতান-ফ্রান্স/ইটালীয়ান জর্জেট, খদ্দর-পাঞ্জাবী পড়া রাজনীতিবিদ এবং বুটপরা রাজনীতিবিদেরা কিছু কি শিখবেন-সেই কবিতাটি পড়ে?
আবার ফিরে যাই স্বৈরাচার প্রেসিডেন্ট, কবি কীট এরশাদের কাছে। ৯০ এর গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্চুত হবার পর দেখেছি-তার প্রতিকৃতির(চারু কলার ছাত্র-ছাত্রীদের বানানো মুর্তি) পশ্চাতদেশে রজনীগন্ধার স্টীকগুলো উলটা করে ঢুকিয়ে ছেলে বুড়ো সবাই আনন্দ মিছিল করছে.........
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০০৯ সকাল ১১:১৩