মাননীয় অতিথি আসবেন আমাদের ইস্কুলে। খুশির সীমা নেই। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নানান কাজে। অনুষ্ঠানে কে কী বলবে, কেমন ক’রে বলবে, কে সুন্দর ক’রে উপস্থাপনা করতে পারে তা সবই ঠিক করে ফেলা হয়েছে। অতিথিকে খুশি করার জন্য কী কী অনুষ্ঠান করে দেখানো হবে তা নিয়ে আমরা রীতিমতো রিহার্সেল করে যাচ্ছি। আমরা সবাই ব্যস্ত আর ব্যস্ত।
ইস্কুল ধোয়া-মোছার কাজ চলছে সমানে। ক্লাসরুম, লাইবেরি, কমন রুম থেকে শুরু করে বাউ-ারি ওয়াল, গেট, ওয়াশরুম কোনোটা বাদ নেই। মাঠের সবুজ ঘাসগুলোকে মেসিন দিয়ে ছাঁট দিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। বাগানের ফুল, অর্কিড ও পাতাবাহার গাছগুলোকে চমৎকার ভাবে সাজানো হয়েছে। ভবনের যেখানে রং পলিশ করা দরকার তা করা হয়েছে। তারপর আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখছি কোথাও কোনো ছেঁড়া কাগজ বা শুকনো পাতা পড়ে আছে কিনা। পেলেই তা তুলে নিয়ে ময়লা রাখার ঝুড়িতে রেখে দিচ্ছি। হেডস্যার থেকে শুরু করে দপ্তরি পর্যন্ত কারো নিস্তার নেই। সবাই আছে ছোটাছুটির মধ্যে। তাঁরা যখন হাঁটেন তখন পন্ পন্ শব্দ হয়।
কয়েক জন স্যার আছেন, তাঁরা কাজ তেমন করেন না কিন্তু অনেক কাজ করছেন এমন দেখায়। তাঁরা খুব ব্যস্ত-সমস্ত ভাবে চলাফেরা করেন। যাকে সামনে পান তাকেই ধমক মারেন। এবং হাত-পা ছুঁড়ে কথা বলেন। এবং জোরে হেঁটে হেড স্যারের কাছে গিয়ে যখন কাজের অগ্রগতির কথা বলেন তখন তাঁরা হাঁপাতে হাঁপাতে কথা বলেন। আর এসব কাজ করতে গিয়ে কী পরিমাণ পেরেশানির মধ্যে আছেন তাও বলেন। আমরা স্যারের কা- দেখে মুখ টিপে হাসি।
আমরা ইস্ত্রি করা ইউনিফরম পরে খুব পরিচ্ছন্ন ভাবে ইস্কুলে এসেছি। বেলা সাড়ে দশটায় অতিথি আসবেন। আমরা সাড়ে ন’টা থেকে রাস্তার দুই ধারে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি। ইস্কুল গেট থেকে মেইন রোডমুখী রাস্তার দিকে চলে গেছে আমাদের লাইনটি। সবাইকে সিজিল করে রাখার জন্যে সবচেয়ে রাগী স্যারদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁদের হাতের বেতের মাথা সবসময় কাঁপে। ফুলের মালা, তোড়া আর পাঁপড়ি ভর্তি ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। লাইন একটু আঁকা-বাঁকা হলে আর রক্ষা নেই। রাগী স্যার দৌড়ে এসে বেত নাচিয়ে বলবেন, এই, তোমরা একি করছ? সাবধান। একটুও নড়বে না, এই যে আমার হাতে বেতটা দেখছো ঠিক এটার মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। আমরা তখন সোজা হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
বারোটা বাজে অতিথির কোনো খবর নেই। স্যার, আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, পা ব্যথা করতেছে। কখন আসবেন অতিথি?
তোমরা প্রস্তুত হয়ে থাকো। যে-কোনো সময় এসে পড়বেন অতিথি। এই ছেলে তুমি লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেনো? এসব বলতে বলতে স্যার ব্যস্ত হয়ে সামনের দিকে চলে গেলেন।
একটু পর পর হঠাৎ স্যারেরা এমন ব্যস্ত হয়ে ওঠেন যে এই বুঝি অতিথি এসে পড়ছেন। আমরা তখন রোবটের মতো দাঁড়িয়ে যাই। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পরে আবার একটু ঢিলেডালা ভাব। আবার বেত নিয়ে স্যার আর মেডামদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। রোদের প্রচ- তাপ। ঘামছি আমরা। মেয়েরা গরমে দাঁত বের করে কপালে ওড়না টেনে ধরেছে। কেউ কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ ছোট করে বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ঢিলেমি ভাব দেখলেই স্যারেরা হুট হাট ধমক মেরে সোজা করে ফেলেন।
স্যার কখন আসবে অতিথি?
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। একদিন একটু কষ্ট করলে কী হয়? অতিথি এসে পড়ল বলে।
একটু পরে এক কোণায় একটু হই চই পড়ে গেল। একজন ধপ করে বসে পড়ে বলল, স্যার আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, আমার চারপাশের সব ঘুরছে। স্যার কোনো কথা না বলে তাকে টেনে তুলে সোজা করে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।
এখনই অতিথি আসবেন। এবার স্যারেরা পেরেশান হয়ে ছোটাছুটি করছেন যেন কোথাও লাইন আঁকা বাঁকা না হয়। পানি পিপাসায় মুখ শুকিয়ে গেছে আমার। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু জ্হিবাটাও শুকিয়ে ঠনঠনা। কিছুই করার নেই। রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছি, অতিথি আসছেন। হর্ন বাজছে।
মাননীয় অতিথি চলে এসেছেন। আমরা সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কেউ কেউ উঁকি মারছে অতিথিকে দেখার জন্য। পেছনের জন টান মেরে সোজা করে ফেলছে। পরিবেশটা গরম হয়ে উঠল।
দেখতে দেখতে অতিথি চলে এসেছেন। অতিথির সাথে আমাদের হেডস্যার ও দুই মেডাম আছেন। হেডস্যার ডান হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে অতিথিকে পদ দেখিয়ে দেওয়ার মতো করে হাঁটছেন। স্যার ও মেডামদের চোখে মুখে বিনয়ের হাসি।
অতিথি হাত ও মাথা নেড়ে হাসিমুখে আমাদের শুভেচ্ছা-অভিভাদন এবং ফুলের তোড়া, মালা গ্রহণ করছেন। হেডস্যার ইঙ্গিত করতেই বৃষ্টির মতো ফুলের পাঁপড়ি পড়তে লাগল অতিথির ওপর। কিছু গিয়ে পড়ছে হেডস্যার ও মেডামদের গায়েও। মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আটকে আছে ফুলের কিছু পাঁপড়ি। আকাশের তারার মতোই জ্বল জ্বল করছিল পাঁপড়িগুলো।
ডালা থেকে পাঁপড়ি ছিটিয়ে দিতে দিতে আমি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম মাটিতে।
অতিথির পেছনে সবাই ছুটে চলেছে। আমার সামনে হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুইজন স্যার। তাঁরা বিরক্তির সুরে বললেন, আর কোনো সময় পেলিনা। মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
এই মুহূর্তে মাটিতে পড়ে যাওয়া যে কত বড় একটা ঝামেলার সৃষ্টি করেছে- এসব নিয়ে দুই স্যার নিজেদের মধ্যে নানান কথা বলাবলি করলেন অতপর দুই স্যার আর দুইজন সুঠাম ছাত্রকে ডেকে এনে আমাকে পাঁজাকোলা করে কলপাড়ে নিয়ে গেলেন। কলের নিচে ঠেসে ধরলেন দুজনে আর একজন হ্যা-েল চাপছেন। মাথায় পানি দিলেন। কিছু পানি কানে আর নাকে ঢুকল। হাঁচি আর কাশিতে সোজা হয়ে গেলাম আমি।
প্রধান অতিথির বিলম্বে আগমনের কারণে আমাদের অনুষ্ঠানসূচি সব এলোমোলো হয়ে গেল। বেশি সময়ের অনুষ্ঠান কম সময়ে করতে হবে। দীর্ঘদিন চিন্তাভাবনার পর আমাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অল্পসময়ের মধ্যে চিন্তা কর সঙ্কুচিত করতে হলো। কোনটা লেজ আর কোনটা মুড়ো দেখে বোঝার উপায় নেই। এমন করেই কোনো মতে শুরু হয়ে গেল অনুষ্ঠান।
ইস্কুলের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে মাননীয় অতিথিকে কিছু বলার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বললাম। অনেক কথার মাঝে এও বলেছি, মাননীয় অতিথি যদি দয়া করে সময় মতো আসতেন, তাহলে আমাদের এত বড় আনন্দ আজ এতটা কষ্টে পরিণত হতো না।
মাননীয় অতিথি বিষয়টি খুব বুঝতে পেরেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে বললেন, দেরি করে আসা মোটেও ঠিক হয় নি। বিষয়টা আমার মনে থাকবে। আমি এজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। সবাই দিল তালি।
এর কদিন বাদেই একটি নির্দেশনা এলো, এখন কোনো অতিথি বা নেতার আগমনে ইস্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না।
কষ্টের বিনিময়ে পরিবর্তন এলে আর কোনো কষ্ট অবশিষ্ট থাকে না। আমাদের তাই হােলা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৯:৫৬