somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোহনীয় রমণীয় প্যারিস (তৃতীয় তথা শেষ পর্ব)

২৪ শে জুন, ২০১৯ সকাল ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মোহনীয় রমণীয় প্যারিস (পর্ব ১)
মোহনীয় রমণীয় প্যারিস (পর্ব ২)


ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে একটা লম্বা হাটা দিতে হবে। অবশ্য চাইলে মেট্রোও (আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন) ব্যবহার করা যায়, কারন ডে-ট্রাভেল কার্ড এমনিতেই করতে হয়। প্যারিসের বেশীরভাগ আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশানগুলো বিশাল আর একইসঙ্গে চমৎকার। মাটির নীচে দোতলা ট্রেন আমি এখানেই প্রথম দেখেছি। তবে আমার হাটাই বেশী পছন্দ, বিশেষ করে প্যারিসে। হাটলে শহরের সাথে, শহরের মানুষগুলোর সাথে একাত্ম হওয়া যায়। আমি সবজান্তার মতো এমনভাবে হাটি যে চারিদিকের অগুনতি ট্যুরিষ্টের কেউ না কেউ বিভ্রান্ত হয়ে আমাকে স্থানীয় মানুষ ভেবে এটা কোথায়, ওটা কোথায় জিজ্ঞেস করে। কেউ ইংলিশে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলি, তুমি ফ্রেন্চ পারো না? খুবই খারাপ কথা! এখানে আসার আগে অল্প-বিস্তর কিছু শিখে আসা উচিত ছিল। এরা আমার কথা শুনে বেকুবের মতো হাসে। দেখে বিমলানন্দ অনুভব করি। কেউ ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফ্রেন্চ বলার চেষ্টা করলে বলি, নাহ, তোমার ফ্রেন্চ খুব খারাপ। কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি বরং ইংলিশেই বলো!! এরা তো আর জানে না যে, আমি ফ্রেন্চের 'ফ'ও জানিনা।

প্যারিসের চারিদিকে মনুমেন্ট আর ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। হাটতে একেবারেই কষ্ট হয় না। প্রতিটা সড়কে, অলিতে গলিতে আপনি দেখার মতো কিছু না কিছু পেয়েই যাবেন। তবে ২০১১ তে নেপোলিয়নের সাগরেদকে নিয়ে যাওয়ার কারনে হাটাহাটি খুব একটা করতে পারি নাই, সেজন্যে সেবার মজাও পেয়েছি কম। যাক, কোন ব্যাপার না। সব সময় সবকিছু আশা করাও ঠিক না।

যা বলছিলাম। ল্যুভর থেকে একটা লম্বা রাস্তা গিয়ে মিশেছে বাস্তলিঙ স্কোয়ারে যেটা প্লেস ডি লা বাস্তিল নামেও পরিচিত। এই রাস্তার বেশীরভাগটারই নাম রু ডহিভলি। শেষের কিছুটা রু সাতো তোয়ানা নামে পরিচিত। বাস্তিল দূর্গ, যেটা প্রাথমিকভাবে ইংলীশদের আক্রমন ঠেকানোর জন্য তৈরী করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে জেলখানা হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল সেটা এই স্কোয়ারেই ছিল। ফরাসী বিপ্লবের সময় বিপ্লবীরা এটাকে ধ্বংস করে একেবারে ধুলায় মিশিয়ে দেয়। বর্তমানে খুবই নগন্য পরিমান ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট আছে। সেসবের স্মরণে এখানে ''জুলাই কলাম'' নামে একটা মনুমেন্ট আছে।



এখান থেকে বুলেভাড চতুর্থ হেনরী ধরে একটা মাঝারী হাটা দিয়ে সেইন নদীর তীরে চলে এলাম। সেইন নদীতে ছোট্ট একটা দ্বীপের মধ্যে বিখ্যাত নতরদাম গির্জাটা মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। ১১৬৩ সালে তৈরী শুরু হওয়া এই গির্জাটা তার নান্দনিক আর অনুপম কারুকাজের জন্য জগদ্বিখ্যাত। এর ভিতরে-বাইরে, উপরে-নীচে যেদিকে তাকানো যায়; শুধুই মুগ্ধ হতে হয়। চলুন কিছু ছবি দেখাই।

গির্জা চত্বর। কেমন জানি মরুভূমির মতো। ঘাস লাগিয়ে সুন্দর বাগান কেন করে না?



গির্জা চত্বরে বিখ্যাত ফরাসী সম্রাট শার্লামেনের মূর্তি যিনি প্রথমে ছিলেন বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড আর জার্মানীর অধিপতি। ইউরোপের বিশাল এলাকা জয় করেছিলেন, তার জন্য তাকে ইউরোপের জনক বলা হয়। খৃষ্ট ধর্মের ব্যপক প্রচারের জন্য পরবর্তীতে পোপ তাকে হলি রোমান সম্রাট ঘোষনা করেন (জুনআপার সৌজন্যে প্রাপ্ত)।



প্রধান ফটক।



ভিতরে।








ভিতরে প্রদর্শিত মডেল আর নির্মানপর্বের ডেমো।





নতরদাম এর বিশাল সৌন্দর্য দু’বার গিয়ে একবারও পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে পারি নাই। ভেতরটাকে এরা চায়নিজ রেস্টুরেন্টের আলো-আধারীর মতো করে রেখেছে। চারিদিকেই আলো-ছায়ার খেলা! যতটুকুও বা দেখেছি, তাও আপনাদেরকে ঠিকমতো দেখাতে পারলাম না গরিবী হালের ক্যামেরার জন্য। তাই নেটের স্মরণাপন্ন হয়ে পোষ্টের প্রথম ছবিটা দিলাম। দেখে আপনারা মুগ্ধ তো হবেনই, সাথে আমিও; কারন এমনটা আমি নিজেও দেখতে পারি নাই।

নদীর পাড় থেকে এভাবেই সে দৃষ্টিতে ধরা দেয়।



এই দ্বীপের মধ্যেই অবস্থিত সুবিখ্যাত নতরদাম।



হাটা পর্বের এখানেই সমাপ্তি। এর পরের পর্ব হচ্ছে আমার 'চিলিং পর্ব'। অর্থাৎ সেইন নদীর ধারে যতোক্ষণ খুশি বসে থাকা, বিশ্রাম নেয়া। বসে বসে নদী দেখি, মানুষ দেখি, প্রতিটা মানুষের ভিতরের গল্প পড়ার চেষ্টা করি, নদীতে একের পর এক ভেসে আসা ট্যুরিষ্টবাহী জলযানগুলো দেখি আর নিজের জীবন ও দুনিয়াদারী সম্পর্কিত দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা করি। এই ক্ষুদ্র জীবনে কি করলাম, কি করলাম না, আর কি করা উচিত ছিল ইত্যকার হিসাব-পত্র মেলানোর চেষ্টা করি। আর হ্যা, আরেকটা কাজ করি। বসে বসে প্রচুর বিড়ি টানি আর ঢাকার ভ্রাম্যমান চা-বিক্রেতাদের মিস করি! চলুন, এই পর্বের কিছু ছবি দেখাই।







এই পর্বের একটা ঘটনা বলি আপনাদের। বছর পাচেক আগে গ্রীষ্মের এক শেষবিকেলে এমনিভাবে বসে ছিলাম নদীর পাড়ে। আমার থেকে একটু দুরে একটা মেয়ে বসেছিল; উচু বাধানো পাড়ে নদীর দিকে ঝুকে বেশ বিপদজনকভাবে। খোলা চুলগুলো দিয়ে এমনভাবে মুখ ঢেকেছিল যে মনে হচ্ছিল, একটা ভুত বসে আছে। মনে মনে ভাবছিলাম, এ আবার নদীতে লাফ-টাফ দিবে নাতো! মরলে মরুক, তবে দুরে গিয়ে মরলেই ভালো হয়। আগে খেয়াল করলে তো এখানে বসতামই না। যাইহোক, আমাকে হতচকিত করে দিয়ে হঠাৎ মেয়েটা বেশ জোরে শব্দকরে কেদে উঠলো, একেবারে হেচকি তোলা কান্না!

বসে বসে কান্না শুনছি আর ভাবছি, ভালো জ্বালায় পরলাম তো! সিদ্ধান্তে আসলাম, নাহ......এখানে বসা যাবে না। উঠতে যাবো, এর মধ্যে দেখি, মেয়ে কান্না থামিয়ে উঠে আমার দিকে আসছে। মতিগতি বোঝার আগেই সামনে চলে এলো। বেশ সুন্দরী, অল্পবয়সের একটা মেয়ে। আমাকে বললো, তোমার কাছে স্পেয়ার সিগারেট আছে? থাকলে একটা দাও।

বৃটেনে অল্পবয়সীদের সিগারেট চাওয়াটা একটা বড় সমস্যা। ইউরোপের মেইনল্যান্ডে এটা ততোটা প্রকট না। সে যাইহোক, আমার গৎবাধা উত্তর দিতে গিয়ে মনে হলো মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। বললাম, মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট? মেয়েটা বললো, হ্যা। আমার বয়ফ্রেন্ড গতকাল আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। ভাবছিলাম, আত্মহত্যা করবো। তবে, করি আর না করি, এই বাচ্চা আমি রাখবো না। দাও, একটা সিগারেট দাও।

মেয়েটার দুঃখে দুঃখিত হয়ে একবার ভাবলাম একটা দিয়েই দেই। এমন দুঃখের সময়ে বিড়িতে কষে কয়েকটা দম দিলে দুঃখ একটু কমতে পারে! পরমুহুর্তেই সিদ্ধান্ত বদলালাম। একে কমবয়সী, তার উপর প্রেগন্যান্ট। একে সিগারেট দিয়ে বিদেশ-বিভূইয়ে বিপদে পরার কোন মানে নাই। বললাম, তোমার ঘটনা শুনে খুবই দুঃখ পেলাম। আত্মহত্যা কোন সমাধান না। আর তোমার বাচ্চা তুমি রাখবে কি রাখবে না, এটা একান্তই তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে, একটা প্রেগন্যান্ট মেয়েকে কোন অবস্থাতেই আমি সিগারেট দিব না। দুঃখিত।

আমার হৃদয়হীনতায় মর্মাহত মেয়েটা প্রথমে বাক্যহারা হয়ে একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এমন মুখের উপর প্রত্যাখান সম্ভবতঃ সে আশা করেনি, সুন্দরী মেয়েরা প্রত্যাখান জিনিসটা এমনিতেই খুব অপছন্দ করে। তারপর 'এফ' সম্পর্কিত গোটাদুই গালি দিয়ে মধ্যমা আঙ্গুল প্রদর্শন করে স্থানত্যাগ করলো। ভর সন্ধ্যাবেলা এক ভিনদেশী সুন্দরীর মুখে এমন জঘন্য গালি শুনে মনটা কিন্চিত খারাপ হয়ে গেল। মনের দুঃখে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। নিজেকে সান্তনা দিলাম এই বলে.......আমি সিগারেট খেতেই পারি। আমি তো আর প্রেগন্যান্ট না!!!!


ছবিঃ আমার ক্যামেরা
তথ্যঃ নেট এবং বিভিন্ন গাইড বুকলেট।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৯ সকাল ১১:০৯
৩১টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×