ছবি: গুগল
গরিবুল্লাশাহ এর মাজারের পিছনে বিশাল বিশাল দুটি ডোবার পাড় ধরেই এলাকাটি গড়ে উঠেছে। পুরো এলাকাটিই চার পাশে পাহাড় দ্বারা ঘেরা। এই ডোবা দুটিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় "ডেফা" । এই এলাকায় খুব সীমিত লোকের বসবাস। স্থানীয় যারা রয়েছে এই ডোবাকে ঘিরেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়ে যায়। যেমন কেউ কেউ ডোবা থেকে মাছ ধরে। সারাদিন ডিঙ্গী নৌকা নিয়ে ডোবাই জাল মারে। কেউ বা তীরে বসে ছিপের মাথায় কেচোঁ লাগিয়ে মাছ ধরে ভালোই মাছ পাওয়া যায়। কেউ আবার ডোবার পাড়ে গরুর খামার গড়ে তুলেছে খামারের গরুদের প্রধান খাদ্য ডোবার কচুরীপানা। খামারের মালিক জৈনক বৃদ্ধলোক প্রায়ই দেখতাম একটি প্লাস্টিকের ড্রাম লম্বা-লম্বি ভাবে কেটে তা নৌকা হিসেবে ব্যবহার করত এবং ডোবার জলে ভেসে বেড়াতো। কেউ বা আবার ডোবার পাশ ধরে নানা জাতের শাক-সবজির চাষ করতো। তবে মাছ ধরাটাই স্থানীয়দের প্রধান পেশা ছিল। ডোবা বা ডেফার কারনে এলাকার নাম হয়েছিল ডেফারপাড়। যদিও বর্তমান মানুষ জন এলাকার আধুনিক নাম দিয়েছে এবং এক ডেফারপাড়ের ভিতর তিন তিনটি আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে।
আমাদের বাসা মানে ১৮৬/বি শিড়িয়া মন্জিলের পিছন দিকে লাগানো ছিল বড় ডোবাটা। বাড়ীর একটা অংশ ও ডোবাতে ছিল। আমার ছোট বেলাটা কেটেছে এই ডোবার সাথে খেলা করে। তার বুকে মানুষের বিচরন দেখে।দূরবীন দিয়ে দূরে ওপাড়ের মানুষগুলোকে দেখে। কত কত এডভেঞ্চার কল্পনা করেছি এই ডোবাকে নিয়ে। মনে মনে কত যুদ্ধ করেছি এই সকল খারাপ মানুষদের সাথে যারা এই ডোবাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাদের কাছে আসল গুলি কিংবা ছুড়ি ছিল তাতে কি ??!! আমার আব্বু ও আমাকে একটা রিভলবার আর একটা তলোয়ার কিনে দিয়ে ছিল। তা দিয়েই প্রতিদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করতাম, প্রতিদিনই একা আমি জিতে যেতাম কিন্তু ভাগ্য খারাপ যে, শেষ পর্যন্ত বাস্তব যুদ্ধে তারাই জিতে গেল।
হঠৎ করেই এলাকায় সন্ত্রাসী বেড়ে গেল। সাথে সাথে বেড়ে গেল পক্ষ ও বিপক্ষ। প্রায় প্রতিদিন গুলির শব্দ শোনা যেত। চোখের সামনে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে অস্ত্র সহ ধাওয়া করতে দেখেছি। দু-একদিন পর পর শোনা যেত পাহাড়ে লাশ পাওয়া গিয়েছে কিংবা কেউর হাত অথবা পা কেটেঁ ফেলেছে। এক রাতে আমি আর মা ঘুমিয়ে ছিলাম মাঝ রাতে শুনি মা চিৎকার দিয়ে উঠেছে, ঘুম থেকে উঠেই দেখি এক লোক বয়স ২৮-২৯ হবে সুন্দর শরীর সাস্থ , মায়ের পা ঝাপটে ধরে বলছে "আফা আপনে আমার মা, মার পেটের বইন আমারে বাঁচান, তারা আমারে মাইরা ফালাইবো" মা বলল "খাটের নিচে ডুকেন" মা সারা রাত আমাকে জড়িয়ে ধরে খাটের এক কোনে জড়সড় হয়ে বসে ছিল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরদিনই জমিদার খালাম্মাকে ঢাকাই ফোন করে আব্বু দিনে দিনে পুরো বাসায় গ্রীল লাগিয়ে দিল। আমন দলাদলি আর গোলা গোলির মাঝে কেটে গেল আরো দুটি বছর। হায়েনা গুলোর নজর গিয়ে পড়লো ডোবার উপর। আমাদের বাসার যে একটু অংশ ডোবা ছিল তার উপর ও বিশেষ একটি দলের নজর পড়লো, তারা এটা আমাদের নিজের বাড়ী মনে করে নানা রকম হুমকি-ধামকি দিতে শুরু করলো। আমরাও জমিদার খালাম্মাকে ফোনে সব জানালাম, খালাম্মা ঢাকা থেকে আসার আগেই হঠাৎ একদিন তারা স্ব-দলবলে অস্ত্রসহ আসলো মা আগেই টের পেয়ে গ্রীলের গেইটে তালা লাগিয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে একটি রুমে ঢুকে পরলো। কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করে তারা চলে গেল। পরদিন হঠাৎ তারা আবার এসে হাজির, মা গেইটে তালা লাগানোর সময়টুকু পাইনি, কিন্তু আজ পরিবেশ ভিন্ন। তারা সবাই হাসি মুখে, গেইটের বাহিরেই দাড়িঁয়ে আছে। মা যখন তাদের সামনে গেল একজন মাঝ বয়সি সন্ত্রাসী শুদ্ধ উচ্চারনে বলল "আপা আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে, কলকের জন্য আমরা দুখিঃত। আমরা আর আপনাদের বিরক্ত করবো না। এটা যে আপনার বাড়ি তা আমরা জানতাম না।মাফ করবেন।" খানিক থেমে আবার বলল " আমরা যে কাল এসেছিলাম তা বক্কর ভাইকে বলার দরকার নেই। আর দুলাভাইকে ও এসব নিয়ে আর চিন্তা করতে মানা করবেন। " মা এবং আমরা সবাই কিছুই বুঝলা না। এখানে বক্কর ভাই বলতে কি এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কানা বক্করকে বুঝিয়েছে??? কানা বক্কর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রতিদিনই দু-তিনটা মাডার করে আনেক ছেলেপুলেও আছে তার, ডোবা দখলের মধ্যে প্রধান হচ্ছে সে। সে কেন আমাদের সেলটার দিবে???
দুলাভাই বললতে আব্বুকে বুঝিয়েছে এটা বুঝতে পেড়েছি। কিন্তু বক্কর রহস্য তখন উৎঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
এরপর রাতের আধারে আরো অনেকেই বাড়ি দখলের চেষ্টা করেছে কিন্তু অজানা কারনে সকাল হতে হতেই সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।
আমাদের বাসার ছোট্ট সেই অংশটুকু ছাড়া পুরো ডোবা ভরাটের মহাজগ্য চলছে। ট্রাকে ট্রাকে ময়লার গাড়ি আসছে আর তা ডোবার পানিতে ফেলা হচ্ছে। ধীরে ধীরে ডোবার পানির রং কালো হচ্ছে এবং ডোবা ময়লার ভাগারে পরিণত হয়েছে।পুরো শহরের ময়লা যেন এই ডোবা একাই নিজের বুকে নিয়েছে। আর আমাকে বলেছে "এটা শহরের ময়লা না এটা মানুষের মনের ময়লা তাদের পাশবিকতার ময়লা" ডোবা ভরাটের সময় যতবারেই ডোবার দিকে তাকিয়েছি ততবারেই দেখলাম ডোবাটি যেন আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে যেন সে মৃত্যুশষ্যায় এবং বলছে "তার আর কিছুই করার নেই"। ডোবার এক একটি অংশ ভরাট হচ্ছে, মানুষ গুলো দখলে মেতে উঠছে এবং একটার পর একটা লাশ পড়ছে। একদিন কানা বক্কর ডোবা ভরাটের কাজ দেখতে আসলো। তখন মায়ের সামনে এসে একটা হাসি দিয়ে বলল "আফা কেমন আছেন?" মা হঠাৎ তাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তার বাম চোখটা থ্যাতলানো।চেহারাটা চেনা , মূহুর্তেই মনে পড়ে গেল একরাতে মা তাকে আশ্রয় দিয়ে বাচিঁয়ৈ ছিল। এই জন্যই সে আমাদের বাসার অংশটি দখল করতে দেয়নি। তার বছর খানেক পর দেশে RAB এর আর্বিভাব হলো চোখের সামনে কত কত সন্ত্রসীর লাশ দেখলাম একদিন শুনলাম কানা বক্কর ক্রসফায়ারে মারা গেছে আবার শুনলাম সে বেচেঁ আছে। RAB আসারপর ।অনেক সন্ত্রসী দাড়িঁ রেখে নামাজ কালাম পড়া শুরু করে দিয়ছিল।
এখন কেউ আর ডেফার পার বলেনা। সবাই আবাসিক এলাকার নাম নিয়ে ডাকে। এখন মাঝে মাঝে ওখানে গেলে দেখি ডোবাটার বুক চিড়ে দশতলা বিল্ডিং বের হয়েছে। এলাকার সখল শীর্ষ সন্ত্রসী মারাগেল কিংবা শুধরে গেল কিন্তু ডোবাটাকে মেরে ফেললো।
পর্ব ১ Click This Link
পর্ব ২ Click This Link
পর্ব ৪ Click This Link
পর্ব ৫ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১১:৩৮