ইলুমিনাতি নিয়ে আগে আরো দুটি পোস্ট দিয়েছিলাম। একটি-তে ইলুমিনাতির হালকা পরিচয় ও আরেকটি তে ইলুমিনাতির করা কিছু ভবিষ্যৎবাণী। কিন্তু ইলুমিনাতির জন্ম কীভাবে হল, কেন হল, এর মূল লক্ষ্য কী এইসব নিয়ে কিছুই লেখা হয়নি আগের দুটি পোস্টে। এইসব নিয়েই আজকের এই পোস্ট।
ইলুমিনাতি হল এ যাবৎকালের সবচাইতে পাওয়ারফুল সিক্রেট স্যাটানিক সোসাইটি। কিন্তু প্রারম্ভের ইলুমিনাতি মোটেও শয়তানি সংঘ ছিল না। তাদের শুরুটা হয়েছিল বিজ্ঞানের হাত ধরে, ভালর হাত ধরে, ভালর উদ্দেশ্যে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে এটি রুপ নেয় শয়তানি সংঘে। এর পিছনের কাহিনী জানব আমরা এই পোস্টে।
সেই আদিকাল থেকেই ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যকার লড়াই চলে আসছে। অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত বিজ্ঞানী এই কোপানলে পড়ে খুন হয়েছেন। স্পেসিফিকলি বললে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল চার্চ। তো একপর্যায়ে গিয়ে সেটা সীমা ছাড়িয়ে যায়। ষোড়শ শতকে ইতালিতে নামকরা বৈজ্ঞানিল ব্যাক্তিত্বরা গোপনে দেখা করা শুরু করেন। ইউরোপের সবচেয়ে জ্ঞানীগুণী লোকগুলো একত্র হয় বিজ্ঞান-কে ধর্মের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে। এভাবেই জন্ম নেয় দ্যা ইলুমিনাতি, যার অর্থ আলোকিত। চার্চ যখন জানতে পারে এই গ্রুপের কথা, তারা হন্যে হয়ে খুজে বেড়ায় এর মেম্বারদের হত্যা করার জন্য। যেখানে যেভাবে পায় হত্যা করা শুরু করে। তখন ইলুমিনাতির বেশীরভাগ চায় গির্জার সাথে লড়াই করতে। কিন্তু তাদের পথে বাধা হয়ে দাড়ান বিশ্বের সবচেয়ে দামি মানুষগুলোর একজন। তিনি বলেন ধর্ম আর বিজ্ঞান একই মুদ্রার ই এপিঠ আর ওপিঠ। এই নিবেদিতপ্রাণ ক্যাথলিক বলেন বিজ্ঞান আর ধর্ম দুই বন্ধু যারা একই কথাই বলে, শুধু তাদের নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন পথে। তাকে বলা হত-ইলুমিনাতির জ্ঞানগুরু। শুধুমাত্র তার কারণেই ইলুমিনাতির সদস্য তখন অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
এই দামী ও জনপ্রিয় মানূষটির নাম গ্যালিলিও গ্যালিলি। কিন্তু তার সব চেষ্টায় বৃথা যায়, তিনি ইলুমিনেতিকে ধর্মের সাথে যুদ্ধ থেকে রক্ষা কrতে পারেন, কিন্তু চার্চের রোষানল থেকে নয়। ফলে ইলুমিনাতি ডাকসাইটে চলে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের কাজকর্ম থেমে থাকেনা। অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে তারা তাদের ইলুমিনেশন চালিয়ে যেতে থাকেন। ষোলোশ থ্রিশের দশকে ইলুমিনেতি বিস্তৃতি পেতে শুরু করে। গোপনে গোপনে সারা দুনিয়া থেকে মানুষ আসতে শুরু করল ইলুমিনেতিতে যোগ দিতে। কিন্তু দূ:খের কথা দু:খের সাথে বলতে হয়, তারা জানত না, কীভাবে কোথায় মিলিত হতে হবে এই ইলুমিনেতির সাথে। কারণ ইলুমিনেতি ছিল একধরণেত ব্রাদারহুড।
আর যেকোন ব্রাদারহুড-এর মূল শর্ত গোপনীয়তা। ব্রাদারহুডের বাইরের কাউকে এর কথা বলা যেত না। ফলে ইলুমিনাতি হয়ে গিয়েছিল এক ধরণের ওপেন সিক্রেট। সবাই জানত ইলুমিনেতি আছেন কিন্তু তাদের অস্তিত্ব, কাজকর্ম, আড্ডাস্থান সম্পর্কে কারো কো ন আইডিয়া ছিলনা। কিন্তু ইলুমিনেতিকে তো বেড়ে উটতে হবে, দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে হবে, তাদের কথা দুনিয়া জুড়ে প্রচার করতে হবে। আর এর জন্য চাই নতুন রক্ত, নতুম মেধা। কিন্তু সাথে সাথে গোপনীয়তা ও রক্ষা করতে হবে। তাই তারা চার্চের হাত থেকে বাচার জন্য রোমে একটি অতি গোপনীয় আস্তানা তৈরী করে, যেটাকে তার ডাকত চার্চ অফ দ্যা ইলুমিনাতি। আর এই চার্চ পর্যন্ত পৌছানোর জন্য তারা একটা ম্যাপ বা পথনির্দেশিকা তৈরী করে, যারা ছড়ানো ছিটানো ছিল সারা রোম জুড়ে। সারা রোম জুড়ে তারা চিহু দিয়ে রাখে। সাধারণ মানুষের পথেই ছড়ানো ছিল সেইসব চিহু, কিন্তু প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন, জটিল। One Kind of puzzle। তাদের অনুমোদিতে লোকজন ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবেনা এমন করে বানানো। ধাধার সমাধান করে নতুন একটা জায়গা, যেখানে আরেকটা ধাধা লুকানো আছে, তারপর আরেকটা। এভাবে শেষে গিয়ে 'চার্চ অফ দ্যা ইলুমিনাতি। কিন্তু তৎকালীন সময়ে রোম ছিল মেধাবীদের তীর্থস্থান। ঠিক ই কেউ না কেউ বের করে ফেলত। তাই তারা আশ্রয় নেয় পুরোনো কিন্তু কার্যকরী এক প্রক্রিয়ার। সিম্বলজির ভাষায় যেটাকে বলা ডিশমিউলেশন। শব্দটা এসেছে ডিশমিউল্যাজিওনে থেকে, এর অর্থ ক্যামোফ্লাজ, প্রকৃতির সবচেয়ে সেরা প্রতিরক্ষা। তারা তাদের চিহ্ন-গুলোকে ঢেকে দিয়েছিল ধর্মের আবরণে। যার কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে বা চার্চের পক্ষে তাদের খোজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তারা বিশ্বাস করত পৃথিবী শুধু ৪টি জিনিস দিয়ে তৈরী- মাটি, পানি, বাতাস, আগুন। তারা এই ৪টিকেই তাদের চিহু হিসেবে ব্যাবহার করল, চিহুগুলোকে এমন ভাবে বানাল যেটা দেখতে ধর্মীয় মনে হলে ও আসলে এই ৪টি জিনিসের প্রতিনিধিত্ব করে। আর তারা এই চিহুগুলোকে রাখল গির্জাকেন্দ্রিক করে। প্রত্যেক্টা গির্জায় তার পরের গির্জায় যাবার ক্লু দেওয়া থাকত। তারা এই চার গির্জার নাম দিয়েছিল- 'দ্যা অল্টার অব সায়েন্স'। এই চার ধাপ পার করার পর ই পাওয়া যেত চার্চ অফ দ্যা ইলুমিনাতির হদিস। আর তারা এই সম্পুর্ণ প্রক্রিয়াটাকে বলত "দ্যা পাথ অফ ইলুমিনেশন"।
১৬১২-১৩ সালে পৃথিবীর গতি সম্পর্কে গ্যালিলিও তার মতবাদ প্রকাশ করে। তিনি বলেন- ঈশ্বর তার সৃষ্টিকে কেন্দ্রে না রেখে একটু দূরে স্থাপন করেছেন। সুর্য নয়, বরঞ্চ পৃথিবী ই একে কেন্দ্র করে ঘুরে।ফলাফল চার্চ তেতে উটল। ১৬১৪ সালে সান্তা মারিয়া নভেলার প্রচারবেদিতে দাড়িয়ে ফাদার টমাসো কাচ্চিনি ব্যাখ্যা সহকারে পৃথিবীর গতি সম্পর্কে গ্যালিলিওর মতবাদ বর্ণনা করেন। সেই মতবাদের ভিত্তিতে তার বিচার করেন এবং ঘোষণা করেন যে, এগুলো ভয়ঙ্কর এবং ধর্মদ্রোহীতার শামিল। গ্যালিলিও কে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ইলুমিনেতি তেতে উটল তাদের ধর্মগুরুকে আটকে রাখায়। তারা তাকে মুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ নিল। আর দূর্ভাগ্যবশত চার বিজ্ঞানী ধরা পড়ল চার্চের হাতে। এবং ভোগ করল নরকুযন্ত্রণা। শুদ্ধিকরণের নামে তাদের উপর চালানো হয় অমানুষিক হত্যাচার। জীবিত অবস্থাতেই তাদের বুকে ক্রসের সিম্বলে একে দেওয়া হয়। তারপর নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় রোমের পথে। চার্চের এইসব হত্যাচারের মুখে পড়ে ইলুমিনাতি চলে যায় পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে, জন্মস্থান ইতালি থেকেই পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে যায়। ক্যাথলিকদের হাতে হেনস্থা হওয়া অনান্য দলের সাথে মিশে যেতে থাকে আস্তে আস্তে। সবার থেকেই একটা জিনিস ছিল কমন, চার্চের জন্য ঘৃণা, ধর্মবিরোধিতা, যার জন্য দায়ী ছিল চার্চ নিজেই। সময়ের সাথে সাথে এই ঘৃণা বাড়তে থাকে। ১৭০০ খিস্ট্রাব্দের দিকে গিয়ে উদিত হয় এক নতুন ইলুমিনেতি, হিংস্র-গভীর-অন্ধ ইলুমিনেতি,ধর্মবিরোধী ইলুমিনেতি। তারা তাদের লুসিফারীয় আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উটে। চার্চ বলে লুসিফার শয়তান, কিন্তু ইলুমিনেতি তাকায় আরো গভীরে।লুসিফার ছিল প্রথম এঞ্জেল যাকে গড সুর্যের আগুন, পবিত্র আলো আর মৃত্যু দিয়ে বানিয়েছিল। যার প্রধান কাজ ছিল পৃথিবীকে সূর্যের আলোয় আলোকিত করা। যাকে গ্রীক মিথোলজিতে The light bringer, The Illuminator, Son of Hades, Son of Morningstar,The Fallen Angel ডাকা হয়। তারা শক্তি জড়ো করতে থাকে, অগ্রসর হয় সারা দুনিয়ার জন্য প্ল্যান করে।
১৭৭৬ সালে ব্যাভারিয়া, অর্থাৎ জার্মানীতে Adam Weishaupt-র মাধ্যমে আবার সূর্যের আলোর মুখ দেখে ইলুমিনেতি। এরই মাঝে তারা যুক্ত হয়ে পড়ে তৎকালীন সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সিক্রেট সোসাইটির সাথে-'দ্যা মেসনস'। ফলে তারা একটা ছদ্ম আবরণ পেয়ে যায়। আস্তে আস্তে সবার অজান্তে ধীরে সুস্থে ম্যাসনদের বড় বড় পোস্টগুলো দখল করে নেয় তারা। সিক্রেট সোসাইটির ভিতর গড়ে উটে আরো এক সিক্রেট সোসাইটি। মূল আদর্শ একই, কিন্তু ইলুমিনেতির আরেক আদর্শ ধ্বংস। এবং তারা সেটাকে আস্তে আস্তে চাপিয়ে দেয় মেসনের উপর। তাদের বোঝানো হয়, চার্চের খড়গহস্তের জন্য থমকে আছে মানব্জাতির পথচলা।দ্যা মেসনস পুরোপুরি দখল করার স্বল্প সময়ের মাঝে তারা পুরো ইউরোপেই ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম হয়, তারপর তারা নজর দেয় আমেরিকার উপর, যেখানে জর্জ ওয়াশিংটন, ফ্রাঙ্কলিন-এর মত অনেক হর্তাকর্তাই ছিল মেসন। এই সদাসিধে, সৎ, ধর্মভীরু মানুষগুলো কোন কিছু না জানাই, তাদের কব্জা করতে ও কষ্ট হলনা। আস্তে আস্তে তারা ব্যাংক, ইন্ডাস্ট্রি দখল করা শুরু করে। লক্ষ্য একটাই-New World Order। এক ভুবন, এক রাষ্ট্র, এক আদর্শ-এক অভিন্ন দুনিয়া, যেখানে ধর্ম বলে কিছু থাকবেনা।
তারা এতই দ্রুত এত পাওয়ারফুল হয়ে উটে যে ১৭৮২ সালেই আমেরিকার জাতীয় সিলমোহরে তাদের সিম্বল জায়গা করে নেয়, আর ১৯৩৫ সালে আমেরিকান ডলারে। জাতীয় সিলমোহরে এই চিহু আনার প্রস্তাবনা দিয়েছিলেন ডিজাইন এক্সপার্ট চার্লস থম্পসন, আর রুজভেল্টকে তার ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ওয়েলস সেইম লোগো ডলার নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে হেনরি, চার্লস, জর্জ ওয়াশিংটন, ফ্রা. ডি রুজভেল্ট সবাই ছিলেন মেসনস। তাই প্রেসিডেন্টদ্বয় চার্লস- হেনরির প্রস্তাবনা চিন্তা ভাবনা না করেই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা এটা জানতেন না, হেনরি এবং চার্লস ইলুমিনেটাস ছিলেন।
এখানে যে থ্রিকোণটি দেখতে পাচ্ছি এটিকে বলা হয় ডেল্টা, এটি প্রতিনিধিত্ব করে পরিবর্তনের, আর চোখসহ থ্রিকোণকে তারা বলে দৈব ডেল্টা, যা আলোময়তার প্রদর্শন করে বলে বলা হয়। অসম্পুর্ণ পিরামিড আর ত্রিকোণাবৃত চোখ। এর নিচে লাতিন ভাষায় লেখা 'NOVUS ORDO SECLORUM' মানে 'নতুন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাবস্থা', আর উপরের 'Annuit cœptis' মানে 'অনুমোদিত প্রতিশ্রুতি'। পিরামিডের শেষ ধাপে রোমান নিউমেরাসে লেখা MDCCLXXVI-র অর্থ হল ১৭৮৬, ইলুমিনাতির পুর্নজন্ম বা ডার্ক ইলুমিনাতির জন্মের সন।
তথ্যসুত্র: 1/Quora
2/Youtube
3/Penterest
4/Wikipedia
5/Somewhereinblog
6/National Geographic
7/'Angels & Demons' Written by Dan Brown
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৪:৪০