২০০১ সালে আমরা চারজন মেয়ে ডাটা এন্ট্রি হিসেবে জয়েন করি বাংলাদেশ ব্যাংকে। আমাদের চোখে কত স্বপ্ন আহা, কত সুখ সময়গুলো একসাথে কাটিয়েছি। কত গেট টুগেদার করেছি। দুপুরে লাঞ্চ করেছি আমরা একসাথে। কত আনন্দ কত হইহুল্লোড় আর ছবি তোলা।
একে একে সবার বিয়ে হলো সংসার হলো, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে যে যার মতন সুন্দর সংসার। এত সুখের মাঝেও কষ্টের ঢেউ আসছে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। চারজনের মাঝে দুইজনের ব্যাংকের কর্মকর্তার সাথেই বিয়ে। আমি এবং জেরিন। জেরিনের একটা মেয়ে হয়, স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ডিভোর্স হয়ে যায়। সে মেয়ে নিয়ে একা বিয়ে আর করে নি।
যোশিয়া ছিলো বেশী চটপটে, উচ্চাকাঙ্খা অথৈ। যোশিয়া ব্যাংক ক্লাবে কয়েকবার ভোটে দাড়িয়েঁছে। তখন দেখতাম দলবেঁধে ভোটের ক্যাম্পাস করতে। কী আনন্দ নিয়ে থাকতো মেয়েটা।
যোশিয়ার বিয়ে সম্ভবত আগেই হয়েছিলো ব্যবসায়ী স্বামী তার। তার লোনের টাকায় ব্যবসা দিয়া জামাই খুব কামিয়েছে একদিন শুনলাম জামাই পালিয়ে গেছে তার সাথে আর সংসার করা হয়ে উঠলো না। যোশিয়ার এক ছেলে এক মেয়ে, ছেলেটা সেভেন এইটে পড়ে বোধয় আর মেয়েটা ইন্টারে। যোশিয়ার আরেকটা বিয়ে হয় শুনেছি ধনী স্বামী ব্যবসায়ী, সে পক্ষেরও এক ছেলে এক মেয়ে। হয়তো সাংসারিক বনিবনা ছিলো না (আমার মনে হয়) কারণ তার দুই একটা স্ট্যাটাস পড়ে তাই মনে হলো। আর রাশিদার বিয়ে হয় অন্য অফিসের কর্মকর্তার সাথে। তার দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে এখনো আল্লাহর রহমতে সুখে আছে। আর আমি আলহাদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি দুই ছেলে নিয়ে। এই করোনা কালে হঠাৎ ফেসবুকে পোস্ট দেখি যে আমাদের যোশিয়া অসুস্থ আইসিইউতে। কলিজা চ্যাত করে উঠে। আমার জামাই বললো খবর নাও কারো কাছে ফোন করে। রাশিদার কাছে ফোন করে জানতে পারলাম যোশিয়া ব্রেইনস্ট্রোক করেছেন এখন কোমায় আছে। সেই থেকে আর কিছুই ভালো লাগে না।
সেদিন অফিসেই এসেই শুনলাম যোশিয়া না ফেরার দেশে চলে গেছে। এত কষ্ট এত কষ্ট, এখনো তার মুখ ভুলতে পারি না। এখনো চোখ দিয়ে পানি আসে। কতদিন তার সাথে দেখা হয়নি। কথা হয়নি। যদি জানতাম তাহলে তো খোজ খবর নিতে পারতাম। শেষবারের মতও যোশিয়াকে দেখলাম না। শরীর বড্ড দুর্বল হয়ে গেছে আমার। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে যোশিয়া হারিয়ে গেলো আমাদের মাঝ থেকে। যোশিয়া প্রমোশন পেয়েছে মাস কয়েক আগে। আমাকে শুধু জ্বালাতো এই প্রমোশনের সিরিয়ালটা দেখনা দুস্ত। কতজন পিআরএল এ যাবে একটু দেখে আয় না। আমি বলতাম আরে এত চিন্তা করিস না। তোর প্রমোশন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। যোশিয়া খুব ভালো গল্প লিখতো। পেন্সিল আর লিখালিখি গ্রুপে পোস্ট করতো। অনেক কমেন্ট লাইক পেত। সুলেখিকা আমাদের আজ আর নেই। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।
(তার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে রাখলাম এখানে)
যোশিয়াকে নিয়ে কয়েকটি লেখা, স্মৃতির পাতায় রেখে দিলাম=
১।
=ওপারে ভালো থাকিস বন্ধু=
কলবিতায় আর কী লিখবো, কবিতার ছন্দ গেলো কেটে,
ঘুরে ফিরে স্মৃতির দুয়ারে বন্ধুর মুখোচ্ছবি,
মন ক্যা নভাসে সুলতানা যোশিয়া ফটো হয়ে আছে সেঁটে,
তার স্মৃতি নিয়েই লিখি আমি অকবিতার কবি।
কেবল তার চিন্তাই ঘুরপাক খায় মন আকাশে ঘূর্ণিপাকে,
অবেলায় হারিয়ে গেলো সে, সে চলে গেলো না ফেরার দেশে,
তুলে রেখেছি আলগোছে তার কথা, তার হাসি স্মৃতির তাকে
কী রংবাহারী জীবন আহা, সব রেখে সে গেলো সফেদ পিরান বেশে;
কত চাকচিক্যাতায় ভরা জীবন, নিমেষেই হয়ে গেলো নাই,
কত স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘুরতো শহর, অফিস পাড়ায়,
সব মোহ সব রঙবাহারী দিন পুড়ে হলো ছাই,
সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ করে দিতে কখন যে ঘোর অমানিশা সম্মুখে দাঁড়ায়,
কে জানে,
ছুটে চলেছি আমরা কোন সে মোহ টানে।
কত চেনা মানুষের ভিড়ে, অচেনা হয়ে গেলি বন্ধু তুই,
কবিতায় তুই থাক্ শুয়ে আজ, থাক স্মৃতির পাতায় পাতায়
শব্দে শব্দে তুই থাক্, ছন্দে ছন্দে তুই থাক্, তুই ফুটিস
প্রতি মৌসুমে হয়ে বেলী বকুল জুই;
তোকে রেখে দিলাম বন্ধু, আমার ছেড়া কবিতার খাতায়।
কেউ আগে কেউ পরে, একদিন সে চলে যেতেই হবে,
অপেক্ষায় থাকিস, সময় ফুরোলে চলে আসবো একদিন,
সবাইকে যে যেতে হবে, কেউ জানি না তা কখন কবে!
তবুও তোর কথা হলে স্মরণ বুকে ব্য থারা বাজে রিনরিন।
আমাদের সুলাতানা যোশিয়া, তোকে ভোলা সহজ হবে না রে,
দোয়া করবো তোর জন্যে, যেন থাকিস তুই ভালো,
তুই আসিস বন্ধু স্মৃতির দুয়ারে বারেবারে,
তোর কবরে আল্লাহ যেন ছড়িয়ে দেন তাঁর নূরের আলো।
২।
=আমাদের বন্ধু হারিয়ে গেলো=
চিৎকার করে কাদতে গিয়েও বসে থাকি চুপ, বুকের ভেতর অজস্র কান্না,
চোখের কোণ বেয়ে দু'এক ফোঁটা অশ্রু ধারা,
তুই সুলতানা যোশিয়া, বন্ধু কলিগ আমাদের, আমাদের তুই হীরে পান্না,
শুধু স্মৃতি হয়ে গেলি, হয়ে গেলি আসমানের তারা!
কত উচ্ছ্বল মেয়ে, কত স্বপ্ন চোখে নিয়ে হেঁটেছিলিস সম্মুখ পথে,
হাসির বন্যােয় ভাসিযে দিতিস আড্ডা, গল্পবেলা,
ও যুশিয়া আমাদের না জানিয়ে উঠের গেলি যে, বেলাশেষের রথে!
চলে গেলি চিরতরে একলাই ভাসালি জীবন ভেলা।
কত হাসি ঠাট্টা কত গল্প আমাদের মাঝে, আমরা চারটি মেয়ে
একই সঙ্গে পা রেখেছিলাম স্বপ্ন সোপানে,
চায়ের আড্ডা, কখনো সবাই মিলে গেট টুগেদারে,
কত আনন্দ কত সুখে উঠেআছিলাম গেয়ে,
হায়! ভেসে গেলি একিা সুনামী, কোন্ সে তুফানে!
সুলতানা যোশিয়া, গল্পকার বন্ধু আমাদের, মানবতাবোধ অথৈ তোর
কখনো নেত্রি সেজে গিয়েছিলিস ভোটে দাঁড়িয়ে,
বন্ধুর আড্ডায় মধ্যেমণি তুই, তুই পাশে থাকা মানে কাটতো না আড্ডার ঘোর,
অবেলায় কোথায় গেলি রে হারিয়ে!
ফোনের তারে টুঙটাঙ সুর তুলে কথা বলতিস.....
প্রমোশনটা কবে তোর, বলতিস শুধু আরে দেখ্ না সিরিয়াল কত;
অন্যে র উপকারেও তো তুই একাই পথ চলতিস,
কত সাহসী ছিলিস তুই, জানি আমরা সবাই...
তুই চলে গেলি রে যোশিয়া, হৃদয়ে বাড়ালি কষ্ট ক্ষত।
দুটো সন্তান তোর, পায়নি বাবার আহ্লাদ আদর,
ভেসে গেলো, হারিয়ে গেলো অকালে এবার মায়ের মমতা,
কে বিছাবে ওদের জন্যহ আর মমতার চাদর;
বাচা দুটো হারালো মা ডাকার ক্ষমতা।
আমাদের কলিগ বন্ধু সুলতানা যোশিয়া, হয়ে গেলি আসমানের তারা,
একবারও জানিয়ে গেলি না রে বড্ড কষ্ট বুকে,
যাওয়ার কি ছিলো এতই তাড়া!
সবই পারে মানুষ, কেবল মৃত্যুেটারে পারে না রাখতে রুখে।
দোয়া করি মহান রব যেন দেন তোকে জান্নাত,
ভুল ভ্রান্তি পাপ মার্জনা করো ওর প্রভু
তোমার তরে আজ এই মোনাজাত।
৩।
=অশ্রুগুলো পাঁপড়িতে আছে ঝুলে=
বন্ধু তুই নেই আর এখানে, তোর জন্যত অশ্রু বিন্দু ঝুলে আছে পাতায় পাতায়
বিষণ্ণ আকাশে তাকালেই হাহাকার বুকের ভিতর,
আমাদের ছেড়ে চলে গেলি চিরতরে, মানতে যে কষ্ট হয় বড়,
ঘুরে ফিরে আকাশ আয়নায় তোর ছবিটাই যে দেখি।
বন্ধু অবেণলায় ভাসালি জীবন ভেলা, বৈঠা ছেড়ে দিলি সহসা
অথৈধ সমুদ্দুরে তুই সাঁতরে পাচ্ছিস না কূল, তুই কী তলিয়ে যাচ্ছিস
শুয়ে আছিলস বুঝি একলা মাটির বিছানায়!
কেউ নেই স ঙ্গে তোর, শুধু আমলনামা পড়ে আছেি তোর পাশে।
কত গল্প তো এখনো রয়ে গেলো বাকি, তোকে শুনাবো বলে অপেতক্ষায়,
কতদিন হলো না দেখা, কতদিন হলো না কথা,
ভাবিনি তুই ফাঁকি দিবি, চলে যাবি দুনিয়া ছেড়ে,
মনের আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা,
বুকে কষ্টের বজ্র নিনাদ শুনতে যে কেউ পায় না।
যোশিয়া, এত অভিামানি হলি কেমন করে, তোর চেহারা চোখের আয়নায়
হাসিখুশি মুখ, কত কথার খৈ ফুটাতি
আজ যে তুই নিরব, শেষবারও দেখতে পারিনি তোর মুখশ্রী,
দুর্বল মন, জরায় আচ্ছন্ন দেহ আমার, তোকে শেষ দেখার হয়নি সাহস ।
একটি গোলাপ দেখ্ না তোর শোকে মুহ্যমান,
পাপড়িতে ঝুলে আছে বেদনার জল,
ঠিক আমারও মনের তারে তারে ঝুলে আছেম গোপন অশ্রু তোর জন্যে,
দীর্ঘশ্বাসের উঠানামা ক্রমশঃ,
বন্ধু তুই যাবার আগে একবারও বলে যাসনি, অভিমানি এতটাই!
কিছুই ভালো লাগে না রে বন্ধু, তোর কথা শুধু আসেভ স্মরণে,
অফিুসে যাওয়ার সাহস যে ফেলেছি হারিয়ে,
আর কোনদিন হবে না শোনা তোর কণ্ঠ,
আর কোনদিন ভোট চাইতেশ দলবেঁধে আসবি না তুই এখানে,
আর কোনদিন একসভঙ্গে বসে খাওয়া হবে না চা কফি,
আর হবে না আমাদের গেট টুগেদার;
চাইছি এবেলা অঝোর বৃষ্টি ঝরুক মন আকাশ ফুঁটো করে,
কষ্টটা কম হয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি, অথচ কষ্টটা বুকে বসিয়েছে ঘা,
মন আকাশে ঘোর অমানিশা, কালো মেঘের ঝাঁক,
বন্ধু তোকে কখনো ভুলবো না, সুলতানা যোশিয়া যেখানেই আছিস,
মহান আল্লাহ যেনে রাখেন তোকে অথৈৃ ভালো।
৪।
=আকাশও কাঁদছে দেখ বন্ধু=
মন আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, চোখ জুড়ে শোকের উত্তাপ
আকাশ আয়নায় কোন সে দু:খ ছবি আছে ঝুলে,
বাড়ে বাড়ে বাড়ে ....... মনে কষ্ট সন্তাপ,
ক'ফোটা জল রেখেছি আজ চোখে তুলে।
কত কাব্য কত ছন্দ রয়ে গেলো বাকী, বন্ধু তুই চলে গেলি,
আকাশ কাঁদছে দেখ্ না চেয়ে,
বন্ধু তুই অগোচরে হারালি, উড়ে গেলি ডানা মেলি;
যাচ্ছি রে দুস্ত শোকের জলে নেয়ে;
তুই কী জানিস কত কষ্ট বুকের নদীতে উথাল পাথাল ভাঙ্গে ঢেউ,
তুই কী জানিস কত কথা রয়ে গেলো বাকী তোর সপঙ্গে,
কখন যে দিয়ে গেলি ফাঁকি আখিআ মেলে দেখলো না কেউ,
সাদা মেঘ কাপড়ে আবৃত হলি, আতর লোভান সারা অঙ্গে।
আকাশে নিলি ঠাই, তারা হয়ে গেলি, দেখ্ না কালো মেঘের পাহাড়;
পাহাড়ের ওপারে কী তুই আছিকস শুয়ে,
তোকে কী করে ভুলি, অবোলায় গেলি ছেড়ে আমাদের
জীবনের কাছে মেনে নিলি হার;
কত স্বপ্ন ছিলো বন্ধু, চোখ জমিনে রেখেছিলিস রুয়ে।
ঘনকালো মেঘের আচ্ছাদনে সূর্যটা আছে লুকিয়ে,
মেঘলা দিনের বুকে মন বড় উচাটন আজ,
তোর লাগি বুকের বামে কষ্ট, লুকানো কান্না
সহসা বুক ব্যথায় যায় ধুকপুকিয়ে;
মন ভালো নেই বন্ধু, করতে ইচ্ছে নেই সাংসারিক কোনো কাজ।
ভালো থাকিস, যেখানে আছিংস, মহান প্রভু যেন দেন শান্তি,
আমরা সবাই ওপারের যাত্রী, দেখিস একদিন চলে আসবো,
করুণাময় যেন মার্জনা করে দেন তোর মোহ ভুল ভান্তি,
স্মরণে থাকবি তুই, স্মৃতিঘরে থাকবি তুই,
তোর কথা স্মরণে সুখ অথবা দু:খ জলে অনন্তকাল ভাসবো।