=আমাদের অতীত বেলার গল্প=
এখনকার বাচ্চারা মুঠোফোন নিয়ে পড়ে থাকে। আর অতি বাড়াবাড়ি পড়াশুনা। ওদের বিকেলগুলো হারিয়ে গেলো বন্দি থেকে থেকে। ওদের বিকেল আসে শুধু ক্রিকেট কিংবা ফুটবল খেলার আসর নিয়ে, তাও এক চিলতে জায়গায়। আমাদের ছেলেরা আমাদের মত খোলামেলা জায়গা পায়নি। ওরা শহরের মানুষ। আমরা গাঁইয়া মানে গাঁয়ের মানুষ।
ওরা যখন মুঠোফোনে বিজি থাকে, তখন বলি অন্য কিছু কী করা যায় না। ওদের কাছে বসে বলি বাবারা তোদের কোনো গল্প নেই এবেলার । আমাদের অতীত আহা, আমাদের অতীত সুখ গল্পে ভরা আর তোদের জীবন যেন ডিজিটালের খরা।
মনে পড়ে যায় সেই মুহুর্তগুলো, সেই বর্ষার মৌসুম। স্কুল থেকে ভিজে ভিজে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে ঘরে ফেরা পা টিপে টিপে। পিচ্ছিল কাঁদায় আগাতে হতো সন্তর্পণে। কখনো ছাতা, কখনো মানকচুর পাতা মাথায়। আমাদের স্কুল ব্যাগ ছিলো না। পলিথিনে মুড়িয়ে বইখাতা বগল দাবা করে ফিরে আসতাম স্কুল থেকে।
এই বর্ষার দিন ধান তোলার মৌসুম চলতো। বাড়ী থেকে দূরে খালি জায়গায় বানানো হতো খলা, গোবর আর মাটি মিশিয়ে জায়গাটি লেপা। বাড়ীর ধান শুকানো হতো সেখানে। বাড়ী ফিরেই যদি দেখতাম বৃষ্টি আসে আসে, নেমে পড়তাম ঘরে শুকনো ধান তোলার কাজে। এই আনন্দ আসলে কী যে ভালো লাগার তা বুঝানো যাবে না। কার ধান কে তোলে ঘরে তা কেউই জানি না। মানে আমাদের তোলা শেষ হলে একযোগে চাচাদের ধান তোলা লেগে যেতাম। বৃষ্টির ফোঁটা পড়লেই খুশির ঝলক চোখে মুখে আমাদের। সবাই দৌঁড়াদৌঁড়ি, কারো মুখে কোনো বিষণ্ণতা নেই, নেই হিংসা। ধানের টুকরি কখনো ভরে দিতাম, কখনও ধান টেনে টেনে জমা করতাম উঠোনে, কখনও ধান ঝাড়ু দিয়ে একজায়গায় করতাম।
ঝুম বৃষ্টি যদি হতো ঠিক তখনি শুকনো উঠোনে ভিজার জন্য নেমে পড়তাম। হা করে বৃষ্টি গিলতাম। তারপর পুকুরে ঝাঁপ। ডুব দিয়ে শুনতাম বৃষ্টির শব্দ। আগে এত বজ্রপাত হতো না। সাঁতার কেটে হুই হুল্লোড়ে ঘন্টা খানেক পুকুরেই থাকতাম। অন্য কোনো দায়িত্ব মাথার উপর না থাকায় চিন্তাও তো ছিলো না। কেবল আম্মার হাতের বাড়া ভাত আহা, কী যে তৃপ্তির দিনগুলো আমাদের।
মধ্যরাত পর্যন্ত ধান সিদ্ধ হতো, ধান যখন সিদ্ধ হতো অন্য রকম ঘ্রাণ ছড়াতো। চুলার কাছে বসে বসে মাঝে মাঝে ধান ছিটিয়ে দিতাম ছাইয়ে আর খই ফুটে উঠতো, একটা একটা খই মুখে দিতাম কী যে মজা লাগতো।
বৃষ্টির দিনগুলো খুবই মজার হতো। দোয়া করতাম আল্লাহ বৃষ্টি কমাইয়ো না স্কুলে যাওয়ার বেলা। দেখা যেত ঠিক সময়মতো বৃষ্টি থেমে গেছে। কখনও যেতে হতো কখনও যেতাম না। যেদিন সারাদিন বৃষ্টি হতো। ভাইবোনেরা কিছু সময় ক্যারাম, কিছু সময় দাবা আর লুডু খেলতাম। আম্মা আমাদের জন্য চাল ভাজা করতেন। অথবা চিড়ে ভাজা কাঁচা মরিচ মাখিয়ে আনতেন। কখনও খিচুড়ি হতো। দুপুর পরেই কাথামুড়ি দিয়ে শুইতাম। কান পেতে শুনতাম টিনের চালে বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজ। বৃষ্টিদিনের আরও কত স্মৃতি জমানো বুক পিঞ্জরে, তা না হয় আরেকদিন বলবো ইনশাআল্লাহ।
আর আমাদের বাচ্চারা মুঠোফোন নিয়েই এখন ব্যস্ত। এখন মহামারীকাল। মুঠোফোন ছাড়া উপায়ও নেই। জুম ক্লাস, কোচিং, ফেসবুকে কলেজের গ্রুপের সাথে আড্ডা। কেমন করে যে তাদের সময় কেটে যায়। আগে একটু একটু আর্ট করতো ছোট ছেলে । এখন তার সে দিকে মন নেই একদম। মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিকেলে শুধু সাইকেল চালায়। আর বড় ছেলে ছাদে কিছু সময় ক্রিকেট খেলে। বাকী সময়টা ওদের কাটে মুঠোফোনে। কবে যে খুলবে স্কুল কলেজ কবে আবার সচল হবে ওদের মন।
আমার মনে হয় পালাবদল করে করে ছাত্রদের স্কুল কলেজ খুলে দেয়া প্রয়োজন। এদের ছেলেবেলা এদের উড়ন্ত বেলা ওদের আনন্দটুকু সময় কেড়ে নিচ্ছে । সবই খোলা। আমরা অফিস করছি। যাচ্ছি আসতেছি। তবুও ভয় লাগে যদি বাচ্চাদের কিছু হয়। কিছুই তো আর ভাবা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২১ বিকাল ৪:২৬