somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দারাশিকো'র বঙ্গভ্রমণ: করমজলে-জঙ্গলে (খুলনা)

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মাথার উপর চড়া রোদ। হলুদ-লাল সুতি গামছাকে ঘোমটা বানিয়েছি। একটা হকার 'অ্যায় সিঙ্গারা, ছয়টা দশ টাকা, ছয়টা দশ টাকা' বলে চেঁচাচ্ছে এবং ক্রেতাদের পত্রিকার পাতায় মুড়ে সিঙ্গারা বিক্রি করছে। আমি বসে আছি লঞ্চের পেছন দিকে কোনায়, নিচু রেলিং এর উপর। লঞ্চে প্রচন্ড ভিড়। ইঞ্জিনের আওয়াজ, হকারদের চিৎকার আর যাত্রীদের গুঞ্জন মিলে একধরনের নতুন শব্দ তৈরী হচ্ছে। আমি একাকী বসে যাত্রীদের কার্যকলাপ দেখছি। ঠিক এক বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করে। দারাশিকো'র বঙ্গভ্রমণে আমি তখন খুলনায়, যাবো সুন্দরবন।

সুন্দরবন যাওয়ার আগ্রহ অ-নে-ক দিনের। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্লাসের বন্ধুরা গিয়েছিল পাচ দিনের ট্যুরে। জনপ্রতি বোধহয় হাজার পাচেক টাকা বাজেট। আমার যাওয়া হয় নি - ব্যস্ততা, অর্থাভাব এবং তৃতীয় আরেকটি কারণে। পরবর্তীতে পরিচিত আরও অনেকে সুন্দরবন ঘুরে এসেছে। আমি টিম তৈরী করার চেষ্টা করেছিলাম, হয় নি। গত বছর এরকম সময়ে ঈদের পরে ঢাকায় ফিরেছি, ইচ্ছা সিলেট ঘুরতে যাবো, কিন্তু এবারো সঙ্গী পাওয়া গেল না। আমি হতাশ। রুমমেট জুনিয়র ভাইকে ফোন দিলাম, সে জানালো ফিরতে তার একটু দেরী হবে, কারণ অ্যাসাইনমেন্টের কাজে যে সুন্দরবন যাবে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে আমি খুলনার গাড়িতে উঠে পড়লাম, ভোরে নামলাম যশোরে। সেখান থেকে মুকিতের সাথে যাবো খুলনায়।

যশোর থেকে খুলনা যাওয়ার রাস্তাটা ভালো ছিল না, অন্তত প্রথম অর্ধেক। তবে পরের অর্ধেক জায়গা ভালো এবং সুন্দর। রাস্তার পাশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা। কারখানাগুলা সুন্দর, শান্ত ভাব। রাস্তাও ভালো, মন জুড়ায়।

খুলনায় বাস থেকে নামলাম সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকে যাবো মংলা। মংলা যেতে হলে লোকাল বাসে যেতে হবে। আধাঘন্টা পর পর বাস ছাড়ে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে। টিকেট কেটে সিট দখল করতে হয়। বাসগুলো ঢাকা শহরের তিন নাম্বার বাসের মত ছোট এবং সংকীর্ণ। বাংলাদেশের সব লোকাল বাসের মতই এই বাসও সময়ের চেয়ে দেরীতে ছাড়ে, শহর ছেড়ে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক মোড় থেকে যাত্রী তোলে, যাত্রীরা কন্ডাক্টরের চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে নানাবিধ বাণী বর্ষন করে। যেহেতু আমরা পর্যটক, এ ব্যাপারে আগ্রহ একদমই নেই, বরং প্রতিটি মুহুর্ত উপভোগ্য।

সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডটাই শহরের প্রান্তে, তাই একটু পরেই শহর থেকে বেরিয়ে পড়া হয়। এরপর মফস্বল বা গ্রাম এলাকা। সব মিলিয়ে আড়াই ঘন্টার মত লাগে মংলা বন্দরে পৌছাতে। মংলার কাছাকাছি পৌছে গেলেই অসাধারণ এক অনুভূতি তৈরী হয়। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ফাকা, কোথাও লবনের ঘের, কোথাও সব্জি ক্ষেত। সাথে চমৎকার আকাশ এবং বাতাস। বোঝা যায় আমরা নদী বা সমুদ্রের ধারে চলে এসেছি।

কোন খোজ না নিয়েই মংলা এসেছি। ভেবেছি, কোন না কোন বোট সুন্দরবনের দিকে যাবে, আমরা সেখানে উঠে পড়বো। আজ না হোক, কাল সকালে তো যাবে, রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দেখা গেল ধারনা ঠিক নয়। মংলা থেকে সুন্দরবনে বোট যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা শুধু করমজল পর্যন্ত। ঘন্টাখানেক ব্যয় করলেই ঘুরে আসা সম্ভব। এর বেশী ভিতরে যেতে হলে বনরক্ষীদের পারমিশন নিতে হবে, মিনিমাম একজন বন্দুকধারী রক্ষী নিতে হবে, টাকা পয়সা খরচ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথমে বিশ্বাস হয় নি। ঘুরে ঘুরে কয়েকজন বোটম্যানের সাথে কথা বলে তারপর বুঝলাম, কেউ-ই মিথ্যে বলছে না। অর্থ্যাৎ গেলে করমজলেই যেতে হবে।

মংলা বন্দর থেকে ছোট ইঞ্জিন নৌকা চলে করমজল পর্যন্ত। দুই তিনটা পাবলিক নৌকাও আছে, সেখানে ভাড়া পড়ে ত্রিশটাকা জন প্রতি। আর প্রাইভেট নৌকায় যার কাছ থেকে যত নিয়ে পারে। আমরা প্রাইভেটেও গেলাম না, পাবলিকেও না। সোয়া চার সদস্যের এক পরিবার নৌকা বুক করেছে, বোটম্যান আরও দুএকজনকে তুলে নিতে চায়। অনেক দোনামোনা শেষে উঠে পড়লাম। জনপ্রতি একশ টাকা।

আহা! সে এক অসাধারণ মুহূর্ত। নৌকায় চড়েছি অনেক, সেই বাচ্চাবেলা থেকে। ফলে পার্থক্য করা কষ্ট। কিন্তু এই ভ্রমন খুব মনে থাকবে। ফুরফুরে বাতাস, আমার হাফ টাকলু মাথার চুল উড়ছে! আর আকাশ! উফ! অসহ্য রকম সুন্দর।


মংলা বন্দর ছেড়ে এসেছি


ট্রলার। এসব ট্রলারেই করমজলে যায়। এটা একটু বড় ট্রলার।


কাদায় মাখামাখি হয়ে ছেলেগুলো যখন ঘোলা পানিতে ডুবাডুবি করছে, তাদের মাঝে এই মেয়েটিকে খুব ব্যতিক্রম লাগছিল



করমজল কি? সুন্দরবনের শুরু। বেশ কিছু এলাকা নির্দিষ্ট করে নিয়ে বনবিভাগ ও পর্যটন কতৃপক্ষ পর্যটকদের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলেছে। নিরাপদে সুন্দরবন ভ্রমণ বিশেষত নারী ও শিশুদের নিয়ে আসলে করমজল বেস্ট। বনের ভেতরে কাঠের তৈরী পাটাতন, দুই ধারে গাছে রেলিং। এর মাঝে হেটে হেটে বনের ভেতরে ঢোকা যায়। কাঠের পাটাতনের নিচে কাদা। জোয়ারের সময় পানিতে ঢেকে যায়। পানি নেমে গেলে অনেক অনেক লাল কাকড়া বের হয়ে আসে। ছোটাছুটি করে, গর্তে ঢোকে, বের হয়। আর দেখা যায় নানান রকম পোকা। পাশের গাছগুলোয় তাদের নামফলক লাগানো। পশুর, বাইন, সুন্দরী। গোলপাতা - সে মোটেও গোল নয়, লম্বাটে নারকেল পাতার মতো। পাখির ডাক শোনা যায় কম বেশী। পশু বলতে বানর। আর আছে চিপসের প্যাকেট, ড্রিংক্স-জুসের বোতল এবং বাদামের খোসা। পাখির ডাক শোনার চেয়ে বেশী শোনা যায় কাঠের পাটাতনে জুতার আওয়াজ। কোলাহল। ক্লিক ক্লিক। কিছু নব্য জানোয়ার চিৎকার আর হৈ হুল্লা করে বনের নিস্তব্ধতাকে বারবার ভেঙ্গে দেবে। করমজলের চেয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন অনেক বেশী নিস্তব্ধ।


জোয়ারের সময় পানি এতটুকু পৌছায়, কিছু থেকে যায় ভাটার সময়


একটা মৌচাক দেখা যাচ্ছে। ছোট ক্যামেরায় জুম করে তোলায় ঝাপসা হয়ে গেছে।


শ্বাসমূল দেখতে খুব একটা শ্লীল নয়!


নাল কাকড়া


করমজলের বাঘ!



কাঠের পাটাতনের শেষে আছে ইট বিছানো রাস্তা - অল্প কিছুদূর পর্যন্ত
করমজলে একটি হরিনখাঁচা আছে। খোলা জায়গায় বেশ কিছু হরিণ ঘুরে বেড়ায়, পর্যটকের হাত থেকে খায়। আর আছে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। বড় এক পুকুরে পূর্নবয়স্ক কুমিররা থাকে। তাদের দেখাশোনা করে যে কর্মচারী সে ডাকলে লাফ দিয়ে পুকুরে পরে, সাঁতরে কাছে আসে। আর কিছু আছে মরার মত পরে থাকে, এমন কি হা করা মুখেও। পাশে আছে বাচ্চা কুমিরদের আস্তানা। সেখানে বিভিন্ন ছোট ছোট জলাধারে বিভিন্ন সাইজের বাচ্চা কুমির জড় পদার্থের মত নট নড়ন চড়ন অবস্থায় ধ্যানরত। আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। গাছের জন্য জঙ্গল দেখা যায় না।

করমজলে পৌছার পর থেকেই হতাশা শুরু। এই সুন্দরবন দেখার জন্য আমি এতদূর আসি নাই। মুকিত এসেছে তার অ্যাসাইনমেন্টের কাজে। কয়েকজন লোকাল লোককে যখন জিজ্ঞেস করলো - বনের গাছ চুরি হয় না? সবাই একই কথা বলল - না। লবডঙ্কা। বন থেকে বের হবার আগে এক কোনায় চলে গেলাম পাটাতনের উপর দিয়ে হেটে। এই দিকটায় সবাই আসছে না - প্রচন্ড নীরবতা। আমরা দুজন বসে আছি। পানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। জোয়ার আসছে। কাদার উপরে পানির স্রোত ভেসে আসছে। অল্প অল্প করে। চুপচাপ তাকিয়ে দেখছি। চোখের সামনে একটা একটা করে শ্বাসমূলগুলো ডুবে যাচ্ছে। পানি ভেতরের দিকে ঢুকছে। সাদা ফেনা দেখা যাচ্ছে। পানি বাড়ছে, আরও-আরও। অসাধারণ দৃশ্য। মন ভালো করে দিল।

ফিরতে হবে। খুলনায় বিনা খরচায় রাত কাটানোর ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
১৫টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×