মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন, মোটেও ধীর স্থির নয় বরং পুরোটা জুড়েই হিসেবের পশলা। অথচ এই সবের মাঝেও মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন, বড় বেশি অহংকারী। আনন্দময় বেঁচে থাকাটাই এখানে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের বলেই হয়তো এমন। ঠিক ঠাক পার করে দেয়া এই সব দিন রাত্রি গুলোতে এমন কোনো দিনের কথা মনে করতে পারি না, যেদিন রাতে ঘুমানোর সময়, কিংবা সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার মনে হয়েছে আমি অসুখী। একি অহংকারী প্রবৃত্তি নয়? সুখ ব্যাপারটা কি এতই সহজ? সব প্রশ্ন তুলে রাখুন। আমি বলি আমি মধ্যবিত্ত, আমি অহংকারী আর আমি সুখী। এইটুকুই জেনে রাখুন।

মাস দুয়েক আগেই আমরা বাসা বদল করলাম। খুব সহজ স্বাভাবিক এই ব্যাপারটা আমার পুরো পরিবারের জন্য খুব সহজ ছিল না। আমার মা বাবা তাদের মধ্যবিত্ত সংগ্রাম শুরু করেছিলেন যেখান থেকে, সেই কলোনীতেই আমরা ততদিনে পার করে ফেলছি ২৬ টি গুরুত্বপূর্ণ এবং অসাধারন বছর। আমার ছোট ভাই ছয় মাস বয়স থেকে এই কলোনীতে, আর আমার ছোট - বোনের জন্মই এখানে। মা – বাবা তাদের আনন্দ বেদনার কাব্যময় পুরোটা সময়ই পার করেছেন এখানে। তাই বাসা বদলের এই সহজ বিষয়টা একটু অন্যরকম ছিল এই বার।
আমার ব্যাপারে আমার কাছের মানুষদের একটা খুব অদ্ভুত ধারনা আছে। আমার আবেগ নাকি চির লুকায়িত। কিংবা আমি নিরাবেগী মানুষ। অথচ মজার ব্যাপার হলো সারাটা জীবন আমার ভয়াবহ আবেগ সামলে রাখতেই পালিয়ে বেড়িয়েছি। এবারও ব্যতিক্রম হলো না। আমি বাসায় জানিয়ে দিলাম, বাসা বদলানোর সময় আমি বাড়ি যেতে পারবো না। অফিসে মেলা কাজ। আমার সহজ সরল মা বাবা আমার পালানোর ব্যাপারটা ধরতে পারলো না। তবে দুদিন যেতে না যেতেই আমার মনে পড়ে গেল, আমি বাড়ির বড় ছেলে আর আর আমি খুব সহজেই ধরতে পারলাম আমি না গেলে এই ভীষন কষ্টের সময়টাতে পরিবারের মানুষগুলো মনের জমে থাকা অনেক কথা বলার মতন একটা মানুষ ও পাবে না। তাই বাসা বদলের ঠিক আগের দিন আমি হাজির।
আমাদের বাসার বেশির ভাগ জিনিষ অনেক পুরোনো। কিছু কিছু জিনিষ যে আসলে ঠিক কত পুরোনো আমরা নিজেরাও ঠিক মতন জানি না। আমার মা-বাবার আবেগী কথা বার্তার কারনে আর কিছুতেই এই গুলো ফেলে দেয়া যাচ্ছিল না। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে নাকি বয়সের হিসেবটাও বাড়তে থাকে। এতদিন শুনে এসেছি। এবার দেখার পালা। আমার বাবা প্রতিটা জিনিষের বয়সের হিসেব করতে লাগলেন।। টেবিলটার বয়স, চেয়ারের বয়স, টেলিভিশনের বয়স, স্টিল আলমারীর বয়স, জুতোর র্যা কের বয়স, খাটের বয়স, ফ্যানের বয়স, সোফার বয়স ইত্যাদি। একবার আমাকে জিজ্ঞেশ করেন, একবার আমার মা কে। আমরা উত্তর দিতে দেরি করলে আমার ছোট বোনকে। মাঝে মাঝে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেশ করে বলে “ওমা, আমি কি করে বলবো এটার বয়স কত? এটাতো আমার জন্মের আগে কেনা।”
এই কলোনিতে থাকাকালিন একবার বাসা বদল করেছিলাম আমরা। একটা বিল্ডিং ছেড়ে অন্য বিল্ডিং এ উঠলাম যেদিন, সেদিন আম্মা তার বান্ধবী (আগের বিল্ডিং এর আন্টিরা) দের ছেড়ে যাচ্ছে বলে সে কি কান্না। অথচ আমাদের পুরাতন আর নতুন বিল্ডিং এর দুরত্ব ছিল অনেকটা ফার্স্ট স্লিপ আর থার্ড ম্যানের মতন। ওইদিনের কথা ভাবতে ভাবতেই, গোছ গাছের শেষ পর্যায়ে এসে সব কিছু গুটিয়ে এই স্মৃতি বিজড়িত জায়গাটা ছেড়ে যাওয়াটা যে ভয়াবহ কঠিন হৃদয় বিদারক হবে তা ভেবেই শিউরে উঠলাম। তাই একটা প্ল্যান করলাম। কিভাবে সবাইকে প্রচন্ড ব্যস্ত রাখা যায় আর বোকা বানিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই এখান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া যায়। সবাইকে প্ল্যান বললাম। সকালে ট্রাক আসবে, সারাদিন একটু একটু করে জিনিষ নিয়ে যাব নতুন বাসায়। আর বিকেলে আমরা সবাই যাব একসাথে। সবাই মনে মনে প্রিপারেশন নিল বিকেলে সবার কাছ থেকে ঘটা করে বিদায় নেবে। আর পরদিন ঘটল অন্য ঘটনা। সকাল ১১ টার মধ্যে সব কিছু ট্রাকে উঠে গেল, আমি বাসার সবাইকে সাথে নিয়ে একবারেই বের হয়ে গেলাম নতুন বাসার উদ্দেশ্যে। টেনশনে কেউ টেরও পেলনা কারো কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসা হয়নি।
রাত নটা বাজে তখন হয়তো। আমরা সবাই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। নতুন এলাকায় রাতটা খুব দ্রুতই অনেক গভীর হয়ে গেছে। একটু দূর থেকে ঝি ঝি পোকার ডাক অন্ধকারের গভীরতাকে আরো ক্ষানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। কলোনীর বাসার জানালা দিয়ে ঠিক এই সময় উকি দিলেই দেখা যেত ছোট ছোট ছেলের দল দৌড়াদৌড়ি করছে। আংকেল আন্টিরা রাত্রি কালিন হাটাহাটি করছেন রাস্তা ধরে। উঠতি বয়সের ছেলেরা এককোনায় আড্ডা জমিয়েছে। হয়তো লুকিয়ে বিড়িতে দুটো টানও দিচ্ছে। চাকুরিজীবী ছেলেরা পার্কের বেঞ্চে বসে রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া করছে। দূর থেকে ব্যাডমিন্টন খেলা নিয়ে ঝগড়ার কড়চা শোনা যাচ্ছে। ছোটখাট ব্যালকনিটাতে দাঁড়িয়ে আমি অন্ধকার দেখছি। শীতের রাতের নিস্তব্ধতা আর ঝি ঝি পোকার ডাক, এর ভিড়েই একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেলাম। না তাকিয়েই বোঝার চেষ্টা করছিলাম এটা কার। ছোট ভাইয়ের, নাকি ছোট বোনের, বাবার নাকি মার? নাকি আমি বুঝতেই পারিনি এটা আসলে আমার নিজেরই।
অনেকদিন পর আমরা সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছি। কারো মুখেই ভালো মন্দ কোনো কথা নেই। একদম শেষ দিকে এসে হুট করে বাবা বললো,
“কলোনীতে আমরা অনেক ভালো ছিলাম, তাই না?”
কাউকে না কাউকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হতো। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে আমি নিজেই দায়িত্বটা নিয়ে নিলাম আর কিছুটা গম্ভীর ভঙ্গী করে বললাম
“এখানেও আমরা অনেক ভালো থাকবো বাবা।”
কিন্তু নিজেও বিশ্বাস করলাম কিনা ঠিক বুঝতে পারলাম না। রাতে ঘুমোতে সেদিন অনেক দেরি হলো। রাত জাগা আমার জন্য নতুন কিছু না। তবে আমার পরিবারের বাকিদের জন্য কিছুটা অন্যরকম ছিল সেই রাত জাগা। এটা শুধুই একটা নতুন জায়গায় মানিয়ে নেয়ার কারনে নয়। এই রাত জাগার পেছনে আছে ফেলে রেখে আসা সুন্দর সময়। আর সময়ের প্রতি এই গভীর টানের পেছনে বোধকরি সেই মধ্যবিত্তবোধের কারসাজি।
শুরুতে সুখী বলে যেই অহংবোধের কথাটা বললাম, এটা হুট করে বলা কোনো কথা নয়। নিজেকেই অনেকবার প্রশ্ন করেছি। আসলেই জীবনের উদ্দেশ্য কি? উত্তর একটাই সুখে থাকা। সুখে থাকার মানে কি? উত্তর খুবই সোজা, আপেক্ষিক। যে যেভাবে থেকে সুখ পায়। আমার যাপিত জীবন আমাকে আনন্দ দেয়। আমার যাপিত জীবনের ভাবনা আমাকে বলে এটাতেই আমার সুখ। আমার বোধ আমাকে বলে এইতো বেশ, এর চেয়েও বেশি বুঝি দরকার হয় সুখী হতে? এর পরেও নিজেকে অসুখী বলে নিজের সাথে যদি প্রতারনা করি সেটা কি ঠিক হবে?
যাপিত জীবন (১)
যাপিত জীবন (২)