কাসালং, মাইনি, মাতামুহুরি আর সাঙ্গুঁ নদীর পার ঘেষে চমৎকার উপত্যকা আর পাহাড়ের জনপদ। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো সহ বারোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস এখানে। নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য আর জীবনাচরণের মাধ্যমে ছোট্ট বাংলাদেশে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির মূল রসদ তারাই যুগিয়েছে যুগ যুগ ধরে। এই পাহাড়ি জনপদের নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিময় জীবনগুলো একবার মুখ থুবড়ে পড়ে উপত্যকার মাটিতে। সাল ১৯৬২, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কর্ণফুলি নদীতে কৃত্রিম বাঁধ দেয়া হয়। ডুবে যায় বর্তমান রাঙামাটি জেলার সিংহভাগ জনপদ। লক্ষাধিক মানুষ উপত্যকা থেকে উঁচু পাহাড়ে এসে আশ্রয় নেয়। অনেক মানুষ সীমান্ত পাড়ি দেয় স্বদেশ আর প্রিয়জন ছেড়ে। স্বজন হারানো অযুত পরিবারের মুখ এখনো পাহাড়ের ঘরে ঘরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নিকটে গভীর জলের মধ্যে কোন মতে মাথা উঁচু করে থাকে ‘ডুবো পাহাড়’, প্রাক্তন জমি, ঘর, মাচাং, চাকমা রাজবাড়ি আর কয়েকদশকের অমোঘ স্মৃতিকাতরতা। পাহাড়িদের চোখ স্থির হয়ে আসে কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ পর্যটনপ্রিয় নীল জলে। শুভলং ঝর্নার চেয়েও তীব্র বর্ষনের অবিশ্রান্ত ধারা ফুটে ওঠে পাহাড়িদের চোখে। গেন অজস্র চোখগুলো আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। ২০০৮ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গবেষনার কাজে রাঙামাটি যাই। বিকেলে ‘মেজাং’ এ বসে কফি খেয়ে আমরা যাই বৌদ্ধ মন্দিরে। মন্দিরের শান্ত- সৌম্য পরিবেশ আর অহিংস বৌদ্ধ ভিক্ষু কিংবা শ্রমণদের দেখে অনুভব করি পাহাড়ের মধ্যে ঝিরঝির করে বয়ে চলা শান্তির সুবাতাস। ভগবান বুদ্ধের একটি বড় মুর্তি আমার চোখ আটকে দেয়। বনভান্তের মন্দির আমাদের প্রেরণা দেয় এক মহান জীবনের। অকস্মাৎ আমি আমার আশেপাশে অজস্র, অসংখ্য বুদ্ধকে আবিষ্কার করি। যারা শান্তি কামনায় সংসার আর জীবনের বৈষয়িক সব আকাক্সক্ষাকে পায়ে ডলে শান্তির মাধুকরী করছে। এই শান্তি থেকে আপাতত বিদায় নেই সাত স্বর্গের দিকে। ভূ/মনুষ্যলোক ধামের পাশে গিয়ে দাড়াই।
তখন সন্ধ্যে বেলা। পাহাড়ের আলোগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কাপ্তাই লেকের মধ্যে। ভিক্ষু আর শ্রমণদের গেরুয়া পোষাক শান্তির দ্যুতি ছড়ায়। আমার মনে পড়ে যায় ভিক্ষুরাও হত্যা আর ধ্বংসের হাত থেকে নিস্তার পায়নি। এরপর আমরা রিজার্ভ বাজারে যাই। তরিতরকারি আর মাছের বাজারে ঘুরতে থাকি। পাহাড়ে উৎপন্ন মিষ্টিকুমড়াসহ কাপ্তাই লেকের তেলাপিয়া মাছে বাজার ভর্তি। দোকানিদের অধিকাংশ বাঙালি। আমার খুব মজা লাগে। আমি রাঙামাটিতেও চাকমা মুখ কম দেখি। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ভাষার কোন আলাপ আমার কানে আসেনা। রাতে অফিসে ফিরে আমি বই উল্টাই। বইগুলো আমাকে জানায় : ১৯৫১ সালের পর থেকে পাহাড়ে পাহাড়িরা ধীরে ধীরে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৭ থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই লঘুকরণ প্রক্রিয়া আরো জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এখন বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমনটি বাংলাদেশের অন্যসবখানে। পরদিন আমরা রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াই। একজন হিডম্যান আর কারবারির সাথে কথা বলি। কথা হয় আরো সব চাকমা বন্ধুদের সাথে। আমি তাদের চোখে কোন ঘৃণা দেখিনা, কলহ দেখিনা, উত্তেজনা দেখিনা। তবে কি স্বপ্ন দেখি?
একজন চাকমা নারীর সাথে কথা হয়। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য। আমি খুব আগ্রহ ভরে তার কর্মকান্ডগুলো শুনি। ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করার অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে বিস্মিত করে। আমাকে তাদের সনাতনী জীবনের বহমান কর্মসূচিগুলো আকৃষ্ট করে। রাতে আমরা মানে আমার আরো দুই সহকর্মী রিয়াজ ভাই ও নাওমি মিলে আমাদের বন্ধু ও গবেষক অসীম চাকমার বাসায় যাই। তার বাড়িতে আমরা আপ্যায়িত হই তাদের প্রথাগত খাবারে। পাশের বাড়ির ছোট্ট মেয়েটি শুরুতে অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও পরবর্তীতে আমাদের পাশে বসে। আমাদেরকে কবিতা শোনায়। বাংলা ছড়া, আমরা কোন চাকমা ছড়া শুনতে পাইনা। ছোট্ট মেয়েটিও আমাদেরকে ভয় পায় - আমরা বুঝতে পারি। আমরা আরো বুঝতে পারি , সংখ্যাগুরু - সংখ্যালঘু সম্পর্কের নানান মাত্রা, নানান ধরন। আধিপত্যের নানান রূপ আমাদের সামনে উনে§াচিত হতে থাকে। আমরা বিদায় নেই। আমাদের ঠোঁটে চাকমা খাবারের ঘ্রাণ, চোখে ছোট্ট মেয়েটির চোখের সেই বিষন্নতা কিংবা দূরত্ব পোস্টারের মতো সেঁটে থাকে।
পরদিন আমরা মগবানে যাই। রিজার্ভ বাজার থেকে ট্রলারে। অসীমের চাকমা ভাষার গানের মধ্যে আমরা কর্ণফুলি আর ডুবন্ত পাহাড়ের কান্না শুনতে পাই। ডুবে যাওয়া চাকমা রাজবাড়ির উপর দিয়ে ট্রলার যাওয়ার সময় আমার মনে হতে থাকে - একটি সভ্যতাকে নিমজ্জিত করে তার উপরে আনন্দ বিহারে মত্ত। পাশাপাশি আমরা জেলা প্রশাসকের বাংলো এবং একটি সংযোগ সেতুর শেষে তার অবকাশ যাপন কেন্দ্রটি দেখি। আমরা কাপ্তাই লেকের নাম না জানা পাখিগুলো দেখতে থাকি। ট্রলার এগুতে থাকে। ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ডুবো পাহাড়ের চূড়ায় আমরা চাকমা, মারমা এবং তংচঙ্গাদের বাড়িগুলো দেখি। একজন চাকমা নারীকে কাপ্তাই লেকে কলসে করে পানি ভর্তি করতে দেখি। কলসে পানি ভরার শব্দ আমাকে জীবনের কোন সংগীতকে মনে করিয়ে দেয়না। তার চোখ অকস্মাৎ যেন বিস্ফোরিত হয়। সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি বুঝতে পারি মহালছড়ি, দীঘিনালায়, পানছড়িতে গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিদ্বগ্ধ, মাচাংয়ে ধর্ষিতা পাহাড়ি নারী। লোবাং এর মাটি জুড়ে দগ্ধ পাহাড়িদের দেহভস্মের ধূসঢ় আলপনা। এই দেশে তারা কোন দিন সালাম, বরকত হবে না - নিশ্চিত জানি।
আমার মাথা নত হয়ে আসে পাহাড়ে। আমি নতজানু হই কলসের জলে। আমি নতজানু হই নাম না জানা পাহাড়ি নারীর শংকার কাছে। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে আমরা মগবানে পৌছাই। কথা বলি পাহাড়ি মানুষদের সাথে।যে কাপ্তাই লেকের জীবনসংহারী জল বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিলো। অগয়্যাছড়ির সেই বৃদ্ধ কারবারির গরে আজো বিদ্যুৎ যায়নি। দুপুরের খররোদে সেই নিষ্পাপ মারমা শিশুর চোখে আমি কোন আলো খুঁজে পাইনা। সেখানে কেবলি অন্ধকার। আমরা একই পথে শহরে ফিরে আসি। তবলছড়িতে আমরা আদিবাসী তাঁতবস্থ্র দেখি। কালচারাল একাডেমিতে যাই। এখানেও আমি পীড়নের শব্দ শুনি – সাইনবোর্ডে লেখা উপজাতি শব্দটি আমাকে আহত করে। এই তুচ্ছবাচক শব্দটি এখনি তুলে ফেলা দরকার। শুদু সাইনবোর্ড থেকেই নয়, আমাদের সবার মন থেকেও এবং চিরতরেই। জাদুঘর আমাদেরকে এক সমৃদ্ধশালী পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে স্নান করায়। আমরা স্নাত হই - পাহাড়ের গর্বে , সং®কৃতির চির প্রবাহমানতায়, বৈচিত্র্যে । পড়াশুনা করে শেখা সেই সব অপরের ডিসকোর্স এইখানে এসে আপন ডিসকোর্স হয়ে যায়। হৃদয় এখানে প্রশ্নহীন নীরবতার সামনে দাঁড়ায়। আমার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে আমাদের অন্তহীন সত্তা।
অসীমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ঢাকার পথে রওনা করি। রাঙামাটি থেকে ঘাগড়া পৌছেই আমার মুঠো ফোনটি বেজে ওঠে ক’দিনের নীরবতা কাটিয়ে। রাঙামাটির হতভাগ্য মানুষগুলো এ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। বাসের আলাপে কানে আসে - এখানে নেটওয়ার্ক এলে দু®কৃতিকারীরা সুবিধা পাবে। আমার মনে পড়ে ১৯৭১। যখন পাকিস্তান রেডিও থেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও ঐ নামেই ডাকা হতো। আমার হাসি পায়। আমি মুঠোফোনে মার সাথে কথা বলি। মা বলে - পাহাড় কেমন? আমি কোন উত্তর দিতে পারি না। কেননা আমার কাছে পাহাড় মানে কেবল ঝর্ণা নয়, সবুজ নয়। পাহাড় মানে মানুষ। পাহাড় মানে জীবন। পাহাড় মানে সুখ আর হৃদয় চোয়ানো জল। আমি মাকে কিছু বলতে পারি না। জানি, সীমিত নেটওয়ার্ক চালুর পরেও কোন পাহাড়ি সন্তান তার মাকে সাজেকের গহীন জঙ্গল থেকে কোনদিন মা বলে ডাকতে পারবেনা মুঠোফোনে। আমার ঝিমুনি আসে। সমগ্র রাঙামাটি আমার কাছে একক সত্তা হয়ে দাড়ায়। এক প্রাণ। অখন্ড জীবন। আমি তার শরীওে গভঅর ক্ষত দেখতে পাই। আমি তার চোখে অশ্র“ পাইনা। শোক পাইনা। কোন স্বপ্নও আর অবশিষ্ঠ নেই সে চোখ্ ে। আমাদের গাড়ি ছুটতে থাকে সমতলের দিকে।
১২ মে, ২০০৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





