পরিচিত হলেই আপন হয় না। যেমন হয়নি বয়ে চলা পাশের যমুনা নদী। শৈশবে কত গা ভাসিয়েছে এই নদীতে। মনে হতো নদীটা বুঝি বুক আগলে ধরে রেখেছে মায়াকে। অথচ এই নদীটাই গ্রাস করেছিলো তাদের সুখের জীবন। একবারো ভাবলো না, যে মেয়েটা তার বুকে পানি ছিটিয়ে, সাঁতার কেটে খেলা করতো তার কি হবে!
মায়াদের বাড়ী থেকে একটু দূরেই ছিল নদীর বাঁধ।
আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশীদের বাড়ী ছিল বাঁধ সমান্তরাল এক লাইন বরাবর। টিনের তৈরী সব বাড়ীর সামনের এবং পিছনের চিত্র এক। সামনে মূল দরজার দুপাশে ফুলের বাগান, নানা রঙের ফুল ফুটে থাকতো সারা বছর। একটু দূরে সবজি ক্ষেত এবং অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকতো বিভিন্ন ফলের বড় বড় গাছ। এই গাছের নিচে আবার প্রতি বাড়ীর লোকজনের বসার জন্য থাকতো বাঁশের মাচা। সন্ধ্যার পর এখানে বসে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলতো পরিবারের লোকজনদের। বাড়ীর পিছনের দিকটা মূলতঃ অন্দরমহল। ফসল রাখার গোলা ঘর, রান্নাঘর, স্নান ঘর, গোয়াল ঘর, খড়ের পালা এইসব।
মায়ার বাবা প্রতি সপ্তাহে নৌকা বোঝাই পন্য বিভিন্ন হাটে বিক্রি করতো। পাট এবং ধান ছিল তার মূল পন্য। এই রাতগুলোতে মায়া জেগে থাকতো বাবার জন্য। বাবা কিছু না কিছু হাতে নিয়েই ফিরতো। কখনো মিষ্টি, কখনো কাপড় আবার কখনো সাজ সামগ্রী। প্রথম যেদিন সাজ সামগ্রী পেয়েছিল সেদিনের কথা ভীষণ মনে পড়ে। মুখে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে একটা টিপ দিয়ে বাবার গামছাটাকে ঘোমটা বানিয়ে হারিকেনের মৃদু আলোয় নিজেকে দেখেছিল আয়নায়। নিজেকে কেমন যেন বউ বউ লাগছে, লজ্জায় সে চোখ বুঁজেছিল অনেক্ষণ।
একটা সময় তাদের সব ছিল। অথচ আজ পড়ে আছে নদীর বাঁধে ঝুপড়ি ঘরে। অন্ধকার রাতে দূরের পাড় ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া নদী থেকে অশনি বার্তা নিয়ে একটু পরপর আঘাত হানছে ঝুপড়ি ঘরে। ছিঁড়ে যাওয়া পলিথিন আর ভাঙ্গা টিনের গায়ে বাতাস লেগে বিভৎস পরিবেশ তৈরী করেছে। এমন পরিবেশে মায়াদের পক্ষেই থাকা সম্ভব। পাশে শুয়ে আছে মাথায় পটি বাঁধা চার বছরের শিশু নয়ন। একটু পরপর কেঁপে উঠছে সে বাতাসের আঘাত হানা শব্দে।
অসহায় মায়ার দুচোখে রয়েছে শুধু অনিশ্চয়তা। রাত শেষে কিছু প্রাপ্তির আশায় চোখজোড়া চকচক করে উঠছে। নিঃর্ঘুম চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে অন্ধকারে। দৃষ্টির সীমানা কোথায় বলতে পারবে না মায়া। রাত পোহালে যে প্রাপ্তির আশায় প্রহর গুনছে তা শুরু হয়েছিল অনেক বছর আগে। মায়ার হিসাবে যে বছর স্কুল মাঠে হেলিকপ্টার নেমেছিল সে বছর থেকে। তার কাছে বছরের হিসাবটা বড় গোলমেলে। বছরের নির্দিষ্ট কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে তার মতো বছরের নামকরন করে থাকে।
প্রতি বছর এই দিনে মায়া তার অতীতে ফিরে যায়। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। বন্যায় ডুবে গেছে নদী অঞ্চল। ত্রাণ দিতে হেলিকপ্টার নেমেছে স্কুল মাঠে। বন্যার সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত মায়ার বাবা অসুস্থ্যতার কারণে ত্রাণ নিতে আসতে পারেনি। তাছাড়া ত্রান নিতে যেতেও তার আত্মসম্মানে লেগেছিল। এতদিন তার কি ছিল না ? দুই হাতে মানুষকে সাহায্য করেছে অথচ আজ তার এই অবস্থা। মায়াকে সাথে নিয়ে তার মা চুপ করে গিয়েছিল ত্রাণ আনতে কিন্তু ভীড়ের কারণে কিছুই পায়নি। ভীড় ঠেলে ত্রাণ নেয়ার মতো পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত না তারা। মায়ার মা ছিল গৃহস্থ ঘরের মেয়ে।
দুইদিন পর কোরবানী ঈদ অথচ স্কুলঘরে আশ্রয় নেয়া মানুষের মনে কোন উৎসব নেই। ঈদের দিন খুব ভোরে মায়ার প্রতিবেশী চাচি মায়াকে নিতে আসে। শহরে গিয়ে কোরবানীর মাংস সংগ্রহ করবে। সঙ্গে ছোট বাচ্চা থাকলে একটু বেশীই পাওয়া যাবে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও; অবস্থার প্রেক্ষিতে মায়াকে ছাড়তে রাজী হয় তার মা। মায়া সেদিন অনেক মাংস পেয়েছিল।
মাঝখানে অনেক বছর কেটে গেছে, অনেক পরিবর্তন এসেছে মায়ার জীবনে। ছোটবেলায় যেটা না বুঝে খেলার ছলে করেছিল অথচ আজ তার প্রতিক্ষায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না। বিশেষ করে গত দিনের ঘটনার পর থেকে আরো বেশী।
মায়া যে বাড়ীতে কাজ করতো সেখানে ক’মাস আগে কাজ থেকে না বলে দিয়েছে। সারাদেশে কি যেন এক অসুখ শুরু হয়েছে। সাহায্যের জন্য কারো বাসায় যাওয়াও যায় না, গেলে অচেনা মানুষের মত আচরণ করে। এই কারণে কোন বাসাতে কাজও পাচ্ছে না। ছোট ছেলে নিয়ে তার সংসার। জামানো যেটুকু চাল ছিল তা শেষ হয়েছে কাজ থেকে বিদায় হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে। চাল যতো ফুরাচ্ছিল নিজেকে ততোই অসহায় মনে হচ্ছিল। ভেবেছিল চাল শেষ হতে হতেই দেশ থেকে সব অসুখ চলে যাবে। কিন্তু তা হয়নি বরং উল্টো হয়েছে। শেষে উপায় না দেখে বাঁধের পাশ থেকে কিছু শাক তুলে বাজারে বিক্রি করেছে। যা পেয়েছে তা দিয়ে নিজে না খেলেও বাচ্চাটাকে খাইয়েছে।
আজ হঠাৎ চেয়ারম্যান বাড়ী থেকে ডাক পড়েছে। এক সপ্তাহ আগে মামুন এসেছে ঢাকা থেকে। ঈদের আগের দিন অনেক কাজ তাই মায়া যেন জরুরী দেখা করে।
চেয়ারম্যান সাহেবের বড় ছেলে মামুন, পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকে। করোনা শুরু হওয়ার পর তার প্রতিষ্ঠানও বন্ধ হয়ে যায়। সারাদেশে লকডাউনের কারণে যান চলাচল বন্ধ। গৃহবন্ধী থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠেছে সবাই। ঈদের আগে গাড়ী চলাচল শিথিল হতেই মামুন পরিবারসহ বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করবে। যতদিন করোনা শেষ না হয় ততোদিন গ্রামেই থাকবে।
মায়া সকাল থেকেই চেয়ারম্যান ভাবীর সাথে কাজ শুরু করে দিয়েছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, দুপুরে নামাজের পর সবাই খেতে আসবে। তার এতদিনের পরিচিত ঘর অথচ এই ক’মাস কাজে না আসাতে খেই হারিয়ে ফেলছে। কাজ করতে ভুল হচ্ছে আর এজন্য মাঝে মাঝে বকাও খেতে হচ্ছে।
দুপুর বেলা বারান্দায় রাখা ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রেখে ব্যস্ত মায়া আবার রান্নাঘরে চলে যায়। এতক্ষণে কাজ অনেক সহজ হয়ে গেছে।
দুপুরে নামাজ শেষে মামুন তার বাবাসহ বৌ-বাচ্চা নিয়ে খেতে বসে। তাদের খাওয়ার সময় নয়ন উঠোনে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছিল। আগে এলে মামুনের ছেলে তার সঙ্গে খেলতো, ভেজা বালুতে ছবি আঁকতো, আরো কত কি। কিন্তু এবার তার কাছে আসছে না, কথাও বলছে না। নয়ন ভাবছে তাকে বুঝি চিনতে পারছে না। এমন সময় মামুনের ছেলে নয়নকে বলে মাংস খাবি ? এই নে খা, বলে একটা টুকরা ছুঁড়ে দেয়। আসলে সেটা ছিল বড় সাইজের হাড়। হাড়ের ধারালো অংশে নয়নের কপাল কেটে যায়। ছেলের চিৎকার শুনে মায়া বেরিয়ে এসে দেখে কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে। নয়নের কান্নায় বিরক্ত হয়ে চেয়ারম্যান সাহেব মায়াকে বললো বাড়ী নিয়ে যেতে। যেন কিছু হয়নি এমন স্বভাবিকভাবে তারা খেতে খেতে গল্প শুরু করে দিল। মায়া ছেলেকে নিয়ে দ্রুত তার ঝুপড়ি ঘরে এসে গমের আটা ক্ষত স্থানে দিয়ে খুব সুন্দর করে একটা ব্যান্ডেজ বেধে দেয়।
মায়া আজ ঘুমাবে না। ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়বে। করোনার এই সময় গাড়ী বন্ধ। হাঁটতে হবে বহুদুর, তারপর কোন ভ্যানে চড়ে যেতে হবে শহরে। মাংস পাওয়ার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না, যারা থাকে তারা সুযোগ সন্ধানী। স্বামী বেঁচে থাকতে অনেক স্বপ্ন দেখতো। ছেলে লেখাপড়া শিখে গাড়ী চালাবে। তার ধারণা গাড়ী চালাতে হলে অনেক লেখাপড়া শিখতে হয়। এখন সে আর কোন স্বপ্ন দেখে না, শুধু কাজ চায়। একটা কাজ হলে তাদের মা-ছেলের দিন চলে যাবে। এবার অল্প কিছু মাংস বিক্রি করবে রেল লাইনের পাশে। বন্যার কারণে যদি ঝুপড়ি ঘর ছেড়ে স্কুলে আশ্রয় নিতে হয় তখন কিছু নগদ টাকা দরকার। বেশিরভাগ মাংস নিয়ে আসবে, ছেলেটা যেন তিন বেলা পেট ভরে মাংস খেতে পারে।
দমকা হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দে চাপা পড়ে গেছে গুমড়ে ওঠা কান্নার শব্দ। আজ নদীর সব বানের পানি বুঝি আশ্রয় নিয়েছে মায়ার চোখে, কোন বাঁধেই আটকানো যাচ্ছে না।
উৎসর্গঃ শ্রদ্ধেয় ব্লগার ঠাকুরমাহমুদ ভাই
কৃতজ্ঞতাঃ বন্ধু শাহীদুর রহমান বিপ্লব (গল্পটির থিম দেয়ার জন্য)।
ছবি।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:০০