প্রতিবেশী ভারত একতরফাভাবে বিতর্কিত টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ শুরু করেছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পেপার কাটিং ছাড়া আর কোন তথ্য নেই বলে সরকারি সূত্র স্বীকার করেছে। এর আগে একই বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র শীল বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ভারতীয় পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বা তার মন্ত্রণালয়ের কাছে কোন তথ্য নেই। তিনি এও বলেছিলেন, বাঁধ নির্মাণ হয়ে গেলে বাংলাদেশ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ভারতের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইবে। মন্ত্রীর এহেন নবিশী বক্তব্যের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে কোন ব্যাখ্যা না দেয়ায় মন্ত্রির বক্তব্যকেই সরকারের নীতি-অবস্থানের প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের আর একটি বৈঠকের আগে কোন আলোচনার সুযোগ নেই। তবে যৌথ নদী কমিশনের ভবিষ্যৎ বৈঠকটি কবে নাগাদ হবে, তাও কারও জানা নেই। তাছাড়া টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতি-অবস্থান কী হবে, এ নিয়ে সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যখন কোন সিদ্ধান্তই নেয়া হয়নি, তখন যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠানের সুযোগও বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারবে বলে মনে হয় না। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশংকর মেননের বাংলাদেশে রহস্যজনক ঝটিকা সফরের সময় তিনি বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদলকে টিপাইমুখ বাঁধ দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলে যে খবর বেরিয়েছে, তার সত্যাসত্য নিরূপণ করাও সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি। অর্থাৎ ভারত যদি সত্যি সত্যি টিপাইমুখ বাঁধ দেখার কোন আমন্ত্রণ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে থাকে, তাহলে এতেই প্রমাণ হয় যে, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সর্বৈব সত্যি। একই সাথে এই সত্যতার কারণেই পানিসম্পদ মন্ত্রী টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে অজ্ঞতার যে দাবি করেছেন, তাও ধোপে টেকে না।
ভারত মুখরক্ষার জন্যই হোক, অথবা বন্ধু সরকারের সাথে ঔদ্ধত্যের ছলেই হোক, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কথা যখন স্বীকার করেছে, তখন বাংলাদেশের অজ্ঞতা প্রদর্শন ও প্রতিবাদ না করে নিষ্ক্রিয় বসে থাকাকে জাতিদ্রোহিতার তুল্য অপরাধ হিসেবেই চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারতের খোদ মনিপুর ও আসাম রাজ্যের ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীও যেখানে প্রতিবাদ করেছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ন্যূনতম প্রতিবাদও না করায় ভারত বিনা বাঁধায় একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করবে। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ না করায় এ নিয়ে ভবিষ্যৎ সরকারের পক্ষেও শক্ত প্রতিবাদ করা কঠিন হবে। সরকার স্বেচ্ছায় বাংলাদেশকে ভারতের পানি আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। হয়তো এক্ষেত্রে সরকারের পানি নীতিটাই ভারতের পানি আগ্রাসনের দাবি ষোলআনা মিটাবে।
টিপাইমুখ বাঁধ সম্পন্ন হলে, বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা ও মেঘনার ধারা মরে যাবে। গোটা সিলেট অঞ্চলে নেমে আসবে প্রাকৃতিক মহাবিপর্যয়। এজন্য সিলেটের দলমত নির্বিশেষে সকল স্তরের নাগরিকরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ পর্যন্ত করেছে। তবে সরকার এ ধরনের জাতীয় ইস্যুতে জনগণের প্রতিবাদের মধ্যে রাজনীতির গন্ধ শুঁকতে শুরু করেছে। অর্থাৎ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো যেসব কর্মসূচি নেবার কথা ভাবছে, সরকার তাকে দেশের রাজনৈতিক স্থিতি বিনষ্ট, বন্ধু দেশের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে তোলা এবং সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেছে। বর্তমান সরকার তাদের চার মাসের শাসনে প্রমাণ করেছে যে, ভারত এতদিন বাংলাদেশের কাছে যেসব দাবি চেয়ে আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা তারা পুরোটাই উসুল করে নিতে চাইছে। শুধু তাই নয়, সরকারের নীতি-অবস্থান দেখে মনে হয় যে, ভারত যা চায় না, সরকার তাও তাদেরকে দিতে ইচ্ছুক। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ ভারতের লুণ্ঠনের অভয়ারণ্য হলেও বর্তমান সময়ের মতো ঐ সরকার দিল্লীর প্রতি এতটা নতজানু ছিল না। হয়তো রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবের জাতিগত আত্মমর্যাদাবোধ এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে ভারতের আধিপত্যবাদী লালসা পরিপূর্ণ হতে পারেনি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার অতীতের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারই শুধু নয়, দলের সভানেত্রী ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুজিবতনয়া শেখ হাসিনার সরকার ভারতের পানি আগ্রাসনের ব্যাপারে নির্লিপ্ত ও নিষ্ক্রিয় থাকায় জনমনে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ওয়াদায় ?দিনবদলের' প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ভারতের নদী আগ্রাসনের ষোলকলা পূরণ হলে দেশ হিসেবেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের দিনবদলের শ্লোগান কার্যত দেশবদলের আর্তনাদে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে সরকারের কোন ভূমিকা না থাকায় সরকারের ওপর জনগণের ক্ষোভ ও অনাস্থা বাড়ছে।
টিপাইমুখ হচ্ছে ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক ও টুইভাই নদীর সংযোগস্থল। বাংলাদেশের সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত থেকে এর দূরত্ব ১শ' কিলোমিটার। মাত্র ১৫০০শ' মেগাওয়াট পানি বিদ্যুৎ তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হলেও এর পেছনে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করে ?ভাতে-পানিতে মারবে' ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের লক্ষ্য পূরণ করাই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পেছনে রূঢ় সত্যি বলে অনেকে মনে করেন। ১৯৪৭ সালে সিলেটের জনগণ গণভোট করে পাকিস্তানে যোগদান করায় ওপাড়ের চাণক্য পন্ডিতদের মাঝে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, টিপাইমুখ বাঁধ তারই প্রতিশোধ কিনা, তেমন প্রশ্নও উঠেছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পাহাড় আর মনিপুর রাজ্যের পর্বতশৃঙ্গ থেকে নেমে আসা দুটি খরস্রোতা নদী টিপাইমুখে মিলিত হয়েছে। এ নদী প্রবাহই বাংলাদেশের সিলেটে এসে সুরমা ও কুশিয়ারা নাম ধারণ করেছে। এ নদী প্রবাহ আরও ভাটিতে এসে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীতে পড়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশের সুরমা-কুশিয়ারা-পুরাতন ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা অববাহিকা যে সভ্যতা ও জীববৈচিত্র্য গড়ে তুলেছে, তা ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিন্তু যাদের ওপর নদী রক্ষার দায়িত্ব, সেই সরকারই অন্ধ হয়ে প্রলয় বন্ধ করার কূপমন্ডূকতায় ডুবে আছে। ভারতের কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়ে প্রতিকার চাইবে কি না, এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য আরও হতাশাজনক। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে তার কিছু জানা নেই। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে সরকারের এই বিস্ময়কর এবং ক্ষমাহীন নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
সূএ : Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০০৯ রাত ১০:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




