
-তোমার কিছু হয়নি বাবা। যাস্ট গলায় একটু ঘা হয়ে গেসে আর কি। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ওষুধ পত্র ঠিকমত নাও।
গলার ঘা কিছুতেই ভালো হচ্ছেনা, দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সাইফ নেশা করা এখনো ছাড়েনি। সে এখনো দিনে বিশটার বেশি সিগারেট খায়। সাইফের বন্ধু তার খবর নেওয়ার জন্য সাইফের ভাই কে কল দিলো,
-ভাইয়া, সাইফের কি অবস্থা এখন? কি রেসাল্ট আসলো?
সাইফের ভাই ফোণে কাদছে।
-ভাইয়া? কি হলো? কিছু বলছেন না কেন?
-তোমাদের বন্ধুরতো গলায় ঘা থেকে ক্যান্সার হয়ে গেছে!
-কি!
বড় বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে এবং কি বিদেশে নিয়েও সাইফের চিকিৎসা করানো হলো। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এখনো আগের মতই অবস্থা বরং আরো বেশি খারাপ হচ্ছে। সবাই দোষ দিচ্ছে সাইফের অতিরিক্ত নেশা করাকে। কিন্তু এই নেশা কেন?
-দোস্ত আমার পূরভীকে এনে দে আমার কাছে। ওকে ছাড়া বাঁচবো না আমি। আমি পূরভীরে চাই। আমি পুরভীরে চাই।
-তুই কি রে? এতকিছু হইয়া গেলো। তোর শরীরের দিকে তাকাইয়া দেখ। কি অবস্থা করসোস, সবই তো ওই পূরভীর দোষ।
-ওই শালা তুই এইডা কি কইলি? আমার পূরভীরে দোষারোপ করতাসোস! তোর এত বড় সাহস! আমার পূরভী আমাকে ভালোবাসে নাই। আমাকে বুঝে নাই। কিন্তু ও কি কইসে আমাকে নেশা করতে? ওর কেন দোষ দেস? আমার নিজের দোষেই তো সব হইসে। এখন আমি কিছু জানি না। তোরা ব্যাবস্থা কর, আমার পূরভীরে আইনা দে।
সাইফের ভাই ও ভাবির রিকুয়েস্টে সাইফের বন্ধুরা মিলে পূরভীর সঙ্গে যোগাযোগ করলো। পূরভী শুনে প্রথমে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু পরে সাইফের সঙ্গে সাইফের বন্ধুরা দেখা করিয়ে দেয়। তারপর বুঝতে পারে সাইফের আসলে কি হয়েছে। পূরভী আসলে অনেক কনফিউজড। কিভাবে কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
-আমি না করে দিয়েছিলাম বলে এইভাবে নেশা! নেশা থেকে ক্যান্সার!
পূরভী কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এখন সাইফকে একটু সময় দেওয়া শুরু করেছে। ফোণ করে খবর নেয়। ঔষুধ ঠিকমত খেয়েছে নাকি, খাবার ঠিকমত খাচ্ছে নাকি। আরো কত কি!
সে যে বসে আছে একা একা, রঙিন স্বপ্ন তার বুনেতে
সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে, জানালার ফাঁকে মেঘ ধরেতে।।
সাইফের কানে শায়ানের এই গানটি সারাদিন বেজে চলছে....
দ্বিতীয় বারের মত আবার প্রেমে পরতে চায় তার পূরভীর।
পূরভীর এভাবে সাইফের খেয়াল রাখতে রাখতে সাত মাস পার হয়ে যায়। সাইফের অবস্থা, যতক্ষণ পূরভী পাশে থাকে ততক্ষণ ভালো। কিন্তু পূরভী চলে গেলেই তার অবস্থা খারাপ থেকে অধিক খারাপ হয়ে যায়।
-ওগো ভালোবাসা আমার, তুমি শুনছো? তোমাকে আমি একটি গিফট দিতে চাই। তুমি নিবে?
-কি গিফট?
-আচ্ছা তোমার নীল রঙ কেমন লাগে? আমার প্রিয় রঙ কিন্তু নীল।
-ভালোই লাগে। কেন?
-না কিছু না। ঘুরতে যাবে আমার সাথে?
-কই?
-ওই সবুজে ঘেরা জঙ্গলে।
-জঙ্গল! কি বলো!
-হাহাহাহা মজা করছিলাম রে পাগলি।
বড় অবেলায় পেলাম তোমায়, কেন এখনই যাবে হারিয়ে?
কি করে বলো রবো একলা? ফিরে দেখো আছি দাঁড়িয়ে।
কেন হঠাত তুমি এলে? কেন রয়ে তবে পুরোটা জুড়ে?
-পল্লিমার সামনে এসো দেখা হবে।
-আমিতো অসুস্থ রে পাগলি। তুমি আসো না একটু।
-না তুমি আসো।
সাইফ গেলো কষ্ট করে তার পুরভীর সঙ্গে দেখা করতে। তার ভালোবাসার কাছে সব হেরে যাবে দুনিয়ার।
-এই নাও। তোমার জন্য।
-কি এটা?
-বাসায় গিয়ে খুলে দেখো কেমন।
বাসায় গিয়ে সাইফের দেওয়া উপহারটি খুলে দেখলো, একটি নীল রঙের শাড়ী। সাথে কাঁচের চুড়িও আছে। বাহ! দারুন!
-ওমা! এতো দেখি একটা চিঠিও আছে।
“পূরভী, আমার ভালোবাসা। আমার জীবন। আমি জানি আমি বেশিদিন বাঁচতে পারবো না। তোমায় একটু দেখতে চাই এই নীল রঙের শাড়ীতে প্লিজ। তুমি সময় করে একদিন এসো রমনা পার্কে। দেখা করবো।”
পূরভী ভাবছে এবার একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। ও অসুস্থ অসুস্থ বলে আমার প্রয়োজনীয় সময়টুকও কেঁড়ে নিতে চাচ্ছে। না সে যাবে না। সাইফের ফোণ ধরে না। কোনোরকম যোগাযোগ নেই তাদের মাঝে। একদিন সাইফের ভাবি পূরভীকে ফোণ দিয়ে বলল,
-তুমি কেন ওর সাথে কথা বলো না? ওতো পাগলামি করে তোমার সাথে কথা না বলতে পারলে তুমি জানো না?
-ভাবি দেখুন আমারও একটা লাইফ আছে। পরিবার আছে, ভালোবাসার মানুষ আছে। সব কিছু ফেলে দিয়ে তো আর ওর জন্য আসতে পারবো না তাই না?
-তোমাকে বলছি না ওকে সময় দাও সারাদিন। বলছি দিনে একটিবার করে হলেও কথা বলো ওর সঙ্গে।
-না আমি পারবো না আর দুঃখিত।
-পূরভী, তুমি কি জানো ওর হাতে বেশি সময় নেই?
-মানে?
-হ্যা ও তোমাকে কিছুই বলেনি। তোমাকে নীল শাড়ী দিয়েছে কেন জানো? ওর প্রিয় রঙ এবং এটাই ওর মৃত্যুর শেষ ইচ্ছা।
-মানে কি ভাবি!
-ডাক্তার বলেছে ওর হাতে অল্প কয় মাস আছে। বেশিদিন বাঁচবে না আর। তাই আমাদের বলেছে ওর প্রিয় রঙের শাড়ীতে তোমাকে দেখাই ওর মৃত্যুর শেষ ইচ্ছে।
পূরভী বাকহীন হয়ে পরলো।
শুনছো কি তুমি আমাকে? ছিলে আমার হয়ে পুরোটা।
রবে কোথায় রেখে আমাকে? এ পথ চলায় তোমাকে চাই....
সবুজ ঘাসের উপরে বসে সাইফ অপেক্ষা করছে তার প্রিয়তমার জন্য। সবুজ গাছে ঘেরা সেই রমনার মনোরম দৃশ্যে হঠাত করে সাইফের চোখ পরলো সেই মায়ায় ঘেরা মেয়েটির দিকে। ঠিক তেমনিভাবে আবারো প্রেমে পরে গিয়েছে। পূরভীর দিকে প্রথমবার তাকিয়ে যেমনি ভাবে তার সিগারেটের আগুনে হাত পুড়ে গিয়েছিলো, ঠিক আজ তেমনি গোলাপ ফুলের কাঁটা লেগে হাত আবারো কেটে গেলো। পূরভী? এ যেন সাইফের জন্যই পৃথিবীতে পাঠানো এক অপরূপ সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ নারী। সবুজ ঘাসের উপর হেঁটে হেঁটে নীল রঙের শাড়ীতে পূরভী, আজ শুধুমাত্র সাইফের জন্য এসেছে।
সাইফ পূরভীর হাতে গোলাপ ফুল দিলো। পূরভী দেখলো সাইফের হাত কেটে গিয়েছে গোলাপের কাটায়।
-কিভাবে কেটে গিয়েছে? খেয়াল করো নি তুমি? খেয়াল কই থাকে হুম?
-তোমাকে দিকে।
-ও তাই! বসো এখানে।
জীবনে প্রথমবার পূরভী সাইফের হাত ধরলো, বুঝতে পারলো সাইফের অবস্থা। আজ কেন জানি খুব খারাপ লাগছে সাইফের জন্য। মনে হচ্ছে এই তাদের শেষ দেখা। আর কখনো সাইফের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। আজ পরিবার, পড়াশুনা, নিজের বয়ফ্রেন্ড সব কিছুই ভুলে গেলো।
-আজ কেন জানি তোমাকে বিদায় দিতে ইচ্ছে করছে না সাইফ।
-কেন?
-জানি না। ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে দূরে কোথাও চলে যাই।
-হাহাহাহাহা কি যে বলো! তোমার তো পরিবার আছে। নিজের পড়াশুনা আছে এবং কি তোমার ভালোবাসার মানুষও আছে। সব কিছু ফেলে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলেটির কাছে কেন থাকবে?
-জানি না। কিছু মনে না করলে তোমায় কি একটিবার জড়িয়ে ধরতে পারি?
সাইফ চুপ করে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে পূরভীকে জড়িয়ে ধরলো।
-আজ মনে হচ্ছে অসুস্থ হয়ে জীবনে সার্থক হয়েছি। আমার পূরভীর ভালোবাসা পেলাম অবশেষে।
পূরভী কাঁদছে। কেঁদেই চলেছে অনবরত.....
সাইফকে বিদায় দিয়ে আসতে অনেক কষ্ট হয়েছে। কয়দিন পর একটি ফোণ আসলো গভীর রাতে,
-হ্যালো পূরভী?
-জি ভাবি? এতো রাতে!
-পূরভী সাইফের অবস্থাতো খুব খারাপ। তুমি জলদি এসে পরো প্লিজ ওকে দেখতে।
-ভাবি এখনতো রাত তিনটা বাজে। আমি কিভাবে আসবো?
-পূরভী, সাইফের শেষ নিঃশ্বাসে তুমি থাকবে না?
পূরভী চুপ করে ফোণটা কেটে দিয়ে রেডি হয়ে গেলো। পূরভীর মা,
-কিরে এতো রাতে কই যাস? তোর কি মাথা খারাপ?
-মা তোমাকে একটি ছেলের কথা বলেছিলাম না? ঐযে ক্যান্সার হয়েছে।
-হ্যা।
-তার অবস্থা খুব খারাপ মা। আমাকে যেতে হবে।
কোনোমতে একটা সিএনজি নিয়ে চলে আসলো হসপিটালে। কেমন যেন সব শূন্য লাগছে। নিরিবিলি, নিস্তব্ধ সব কিছু। খুব ভয় করছে। সাইফের ক্যাবিনের একটু সামনে আসতেই কান্নার আওয়াজ আসছে। পূরভী আর এগুতে পারছে না। ওখানেই নিশ্চল।
-সাইফ! সাইফ! সাইফ তোমার কি হয়েছে!
সাইফের চোখ খোলা। মনে হচ্ছে যেন ঠিক পূরভীর দিকে তাকিয়ে আছে। পূরভীও সাইফের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর সাইফের ভাই এসে সাইফের চোখ বন্ধ করে দিলো এবং সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলো সাইফের দেহ। পূরভী? এই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান!
জ্ঞান ফিরার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো সাইফের কবরের সামনে। মানে সাইফকে কবর দেওয়া হবে। তখন মনে হচ্ছিলো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলো পূরভী সাইফকে না করে। সেদিন যদি সাইফকে না করে অপমান না করতো তাহলে হয়তবা এখন কিছুই হতো না। কিন্তু সব কিছুতো আল্লাহ্ তা’য়ালার আদেশেই হয়ে থাকে। কারো কিছু করার থাকে না। এভাবে হাজারও মানুষকে অন্যের হৃদয় ভেঙে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। বিদায় নিতে সাইফ বাধ্য। এখন তার পরিবার আছে এবং সাথে পূরভীর ভালোবাসাও আছে। সব আছে, কোনো কিছুর কমতি নেই। আছে শুধু কমতি জীবনের সময়ের।
তুমি কেন বুঝো না, তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়
আমার সবটুকু, ভালোবাসা তোমায় ঘিরে
আমার অপরাধ ছিলো যতটুকু, তোমার কাছে
তুমি ক্ষমা করে দিয়ো আমায়....।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


