মানুষের প্রভূত্ব থেকে মানুষকে মুক্তি দানের জন্য ইসলামের আগমণ; যা বয়ে এনেছেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজ থেকে চৌদ্দশ' বছরেরও বেশী কিছু কাল পূর্বে। মানুষ কিভাবে মানুষের উপর প্রভুত্ব করে? এ প্রশ্নের জবাবে মৌলিকভাবে কয়েকটি দিক হতে পারে- ১) সরাসরি প্রভু হিসেবে নিজেকে পেশ ও প্রতিষ্ঠিত করা, ২) যোগ্যতা ও বস্তুর প্রভাবে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করা ও ৩) বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করা।
আসা যাক, মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার এ তিনটি দিকের পর্যালোচনায়-
এক) সরাসরি প্রভু হিসেবে নিজেকে পেশ ও প্রতিষ্ঠিত করা: পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় যে, এ দাবী পেশ করেছিল ফির'আওন। সে ছিল তৎকালীন মিসরের রাজা, প্রবল প্রতাপাম্বিত হবার পর সে তার দেশবাসীকে বলেছিল: أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى "আমিই তোমাদের বড় প্রভু" [সূরা আন-নাযি'আত: ২৪]। তার সে প্রভুত্ব ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো যখন সে নীলের পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছিল। পৃথিবীবাসীর জন্য আল্লাহ্ সেই স্বঘোষিত "বড় প্রভু"র ধ্বংসাবশেষ আজো ঝুলিয়ে রেখেছেন মিসরের পূরাকীর্তি পিরামিডের অভ্যন্তরে সে যুগের মানুষকে মমি বানানোর প্রযুক্তি দানের মাধ্যমে। এই জ্বলজ্যান্ত উদাহরণের মানদণ্ডে খুঁজে দেখলে আজো দেখা যাবে পৃথিবীতে বহু ফির'আনের আনাগোনা চলছে। কোন কোন ফির'আওন বিশ্বপ্রভু হবার স্বপ্ন দেখছে বিশ্বায়নের বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আবার কেউ দেখে গেছে কিংবা আজো দেখছে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে, যেমনটি একদার হিটলার। এ পর্যায়ের উদাহরণ বুঝা অনেক সহজ করে দিয়েছেন আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনে ফির'আওনের উদাহরণ পেশ করার মাধ্যমে।
দুই) যোগ্যতা ও বস্তুর প্রভাবে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করা: সোভিয়েত আমলের রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রচারিত বেশ কিছু উপন্যাস দেখা যায় এখনো। যেগুলোতে বিভিন্নভাবে স্রষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের পাঁয়তারা করা হয়েছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মাধ্যমে। তান্মধ্যে একটার কথা বলি- যেখানে দেখানো হয়েছে যে, একজন সার্জন বিভিন্ন প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অদল-বদল করে নানা অদ্ভুত প্রাণী সৃষ্টি(?) করেছে। পড়ে আমার কাছে দারুন হাস্যকর ঠেকেছে। ভাবলাম যে, এরা কি চায় আসলে? নিজেদের পাগলামীর প্রতিষ্ঠা নাকি আসলেই কোন একটা আদর্শের প্রতিষ্ঠা? পৃথিবীর এই সুসামঞ্জস্য পদ্ধতির পরিবর্তন দেখিয়ে স্রষ্টা সাজার অভিলাষ যে কত বড় মূর্খতা আর তা যে কি ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনবে সে ব্যাপারে হয়ত সেই কল্পকাহিনীর লেখক ভাবার অবসরই পাননি। এমন বিধ্বংসী চিন্তার মানুষদের হাতে পৃথিবীকে ছেড়ে দিলে তারা খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই পৃথিবীকে মানুষের জন্য বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে; এমনকি প্রাণীজগৎও সে ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পাবে না।
সে যাক, যোগ্যতা মানুষের আছে এবং সে অনেক কিছুই করতে পারে এর মাধ্যমে। কিন্তু যত বড় যোগ্যতাধারীই হোক না কেন এবং যত বড় কিছুর সম্পাদকই হোক না কেন, যদি সে তার নিজের যোগ্যতার উৎস খুঁজে না পায়; তবে তার মত অসহায় আর কাউকে খুঁজে পাবে না কোথাও কেউ। সে জানে না কে তার জীবন-মৃত্যু-যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা-চিন্তাশক্তি ইত্যাদির সুতো ধরে বসে আছেন, কখন টান দেবেন আর তখন তার যাবতীয় শক্তি-যোগ্যতা ধুলোয় মিশে যাবে সে নিজেসহ! এর চেয়ে অসহায়ত্ব আর কি থাকতে পারে। পরন্তু তার জন্য এতটুকু সান্ত্বনাও নেই যে, কে এসবের মূলে রয়েছেন। কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, বিজ্ঞানী, গবেষক, বিধান রচনাকারীরাও এ পর্যায়ে শামিল। যেমন, আমাদের দেশীয় এক নাট্যাভিনেত্রীর খাহেশ হয়েছিল যে, তিনি কবি রবীন্দ্রনাথের পূজা করবেন; এমনকি তিনি সবাইকে সে উপদেশও প্রদান করেছিলেন।
বস্তুর ব্যাপারটিও এখানে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থসম্পদ, পেশীশক্তি, অস্ত্রবল, জনবল কিংবা কোন জাগতিক আবিস্কার হতে পারে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। যেমন, আমাদের দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এক শ্রেণীর এনজিও অর্থ সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে প্রভুত্বের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। বাহ্যিক ভাবে এই প্রভুত্ব বিশ্বস্রষ্টা কিংবা যীশুখৃষ্টকে প্রদর্শন করলেও আসল প্রভু যে সেই দাতারাই সেজে থাকেন, তা কোন দৃষ্টিমানের কাছেই লুক্কায়িত নেই। বিশ্বনীতিতে আজ তো গুটিকতক দেশই কেবল পরমাণূ শক্তিধর হতে পারবে বলে নিজেরা নিজেরা সালিশী ডেকে ঠিক করে নিয়েছে এবং রায় ঘোষণা করেছে, আর বাকী সব দুর্বল দেশের উপর প্রভুত্বকে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। কোথাও কেউ শিল্পের অগ্রগতি কিংবা বাস্তবিকই স্বদেশ সুরক্ষার জন্য চুল্লি বসালে তারা এসে চোখ রাঙায়, হুমকি দেয়, এমকি হামলে পড়ে বিনাশ সাধন করে নিরপরাধ শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ অগুণতি বনী আদমের। একে কি করে কেউ প্রভুত্বের সংজ্ঞা থেকে বাদ দিতে পারবে? পরন্তু পৃথিবীর নানা প্রাযৌক্তিক উদ্ভাবনের মনীষীগণকে তো গদগদ কণ্ঠে অনেকেই প্রভুর আসনে সমাসীন করে দিয়ে থাকেন। ষ্টিফেন হকিংয়ের বাণীকেও ওহীতুল্য কিংবা তারচেয়েও অধিক গুরুত্ব দেয়ার লোক খুঁজতে বোধহয় খুব বেশী দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে না।
মোদ্দাকথা, এই শ্রেণীর মানুষেরা অন্যদের চোখে চমক সৃষ্টি করতে পারেন নিজেকে দিয়ে, নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে। তারা চান বা না চান; মানুষেরা তাদেরকে প্রিয় ভাবতে শুরু করে, তারপর এই প্রিয় একসময় বদলে যায় শ্রদ্ধায়, শ্রদ্ধার বেলুনটি হাওয়ায় হাওয়ায় ফুলতে ফুলতে একসময় 'ভগবান' হয়ে উঠে। তারপর জীবিত হলে পায়ের ধুলো কুড়োতে কুড়োতে সিজদার কাছাকাছি পৌঁছে যায় মানবতার উন্নত শির আর মৃত হলে কবরে, স্মৃতিস্তম্ভে বা মূর্তি বানিয়ে তাতে ফুল চড়িয়ে, বিনয় নম্রতা প্রদর্শন করে; এমনকি কেউ কেউ বিপদে আপদে তাদের নাম স্মরণ করে কিংবা সরাসরি ডেকে সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যেম তাদের ইবাদাতে মশুগুল হয়ে উঠে। এভাবেই এই শ্রেণী তাদের যোগ্যতা ও বস্তু বলে মানুষের উপর তাদের প্রভুত্ব কায়েম করে থাকে। তবে এক্ষেত্রে এহেন বিভ্রান্তি শুধুমাত্র তাদের বেলাতেই ঘটে, যাদের কাছে নেই কোন সুস্পষ্ট জীবন বিধান, সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড, মানবতার পরিচয় বিধি, স্রষ্টার পরিচয় সম্বলিত কোন অকাট্য ঐশী বাণী; প্রকৃত মুসলমানগণ এই ভয়ংকর পতন প্রতিরোধে অব্যর্থ নিরাপদ, কেননা তাদের কাছে রয়েছে আল-কুরআন।
তিন) বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করা: এই পর্যায়ে এসে কাকের বাসায় কোকিল ডিম পেড়ে উত্তরাধিকার অর্জনের মত অবস্থা হয়ে থাকে। খাজা বাবা কখনো বলে যাননি যে, তার কবরের উপর বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করা হোক, বলেননি সড়ক পরিবহনের মোড়ে মোড়ে ডেকচি বসানো হোক, লালন শাহ্ জীবিতাবস্থায় কখনো বলে যাননি যে, তার জন্য মূর্তি নির্মাণ করা হোক, বলে যাননি শেখ মুজিব কিংবা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারাও; তবে কেন ভাস্কর্যের নামে তাদের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে মূর্তি? তাদেরও ছিল ধর্ম বিশ্বাস। তারা যদি মূর্তিপূজারী ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে থাকে এবং মূর্তিপূজারীরা যদি তাদের মূর্তি বানিয়ে থাকে তবে সেটা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ব্যাপার, সে ব্যাপারে কথা নেই। কিন্তু মুসলিম নেতা, মুসলিম দরবেশ কিংবা মুসলিম বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কেন অপমানিত করা হচ্ছে তাদের মুর্তি নির্মাণ করার মাধ্যমে। তাদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তো এসবের মাধ্যমে তাদের পরকালীন জীবনকে তাদের উত্তরসূরীরা আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে! যার প্রমাণ, কেয়ামতের কঠিন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মানুষেরা যখন বিভিন্ন নবীদের কাছে যাবেন, তখন ঈসা আলাইহিস্ সালাম জবাব দেবেন এই বলে যে, আমাকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেয়ার পর আমার উম্মতেরা আমাকে আল্লাহর পুত্র বানিয়ে বসেছিল, তাই তা নিয়ে আমি নিজেই শংকিত যে আল্লাহ্ সে কারণে আমার সাথে কি ব্যবহার করেন! [হাদীসের ভাবার্থ থেকে]।
অথচ আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ নির্মম সত্যকথাগুলো কেউ বলতে গেলেই সে নাস্তিকদের কাছে হয়ে যাবে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী। লালন সুফী জগতের মানুষ, ইসলামের মৌলিকতার সাথে তার দর্শনের সংঘাত অনেক। কিন্তু সে তো মুসলিম জনগোষ্ঠীর একজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন, হিন্দু ধর্মের কোন পূজ্য দেবতা ছিলেন না। তবে কেন তার মূর্তি নির্মিত হবে? ঠিক একই কায়দায় আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণার্থে তাদের মূর্তি নির্মাণ করা সেসব মৃত মানুষদের প্রতি বিরাট অন্যায়, অমার্জনীয় জুলুম। এর প্রতিবাদ করা উচিত, এসবকে প্রতিহত করা মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব। অন্ততঃ সেসব মুসলিম পরিবারের দায়িত্ব; যাদের পূর্বসূরীদের মূর্তি নির্মাণ করা হচ্ছে। কেননা, তাদের পরকালীন একটি জীবন রয়েছে, তাদের প্রতি করুণা করে হলেও সেদিকটা ভাবা দরকার।
এখন ভেবে দেখার বিষয় যে, তারা যদি জীবিতাবস্থায় বলে না গিয়ে থাকেন তবে কেন তাদের জন্য মূর্তি নির্মিত হচ্ছে?
এর জন্য খৃষ্টজগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করাই যথেষ্ট হবে। কেন খৃষ্টানগণ ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করেছিল? গীর্জায় গীর্জায় তাঁর মূর্তি স্থাপন করে প্রভু হিসেবে এক আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে যীশুখৃষ্টের কাছেও প্রার্থনা করা হচ্ছে? মরহুম আহমাদ দীদাত প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন সমগ্র খৃষ্টজগতের প্রতি যে, আমি বললাম তোমাদের বর্তমান বাইবেলে আল্লাহর নাযিল করা একটি শব্দও নেই, সব তোমাদের বানানো; পারলে আমার এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা কর! খৃষ্টজগত ব্যর্থ হয়েছে তার এই প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ্যের মোকাবেলায়। কিভাবে হয়েছে তাদের এই অধঃপতন? তাদের আলেম সমাজের সাথে আঁতাত হতো শাসক গোষ্ঠীর, তারা বিক্রিত কিংবা বাধ্য ছিল শাসক শ্রেণীর কাছে। তাই যত অপরাধ শাসক গোষ্ঠী করতো, সেসবকে ধর্মের চাদরে ঢাকার জন্য বছর বছর তারা তাদের ধর্মগ্রন্থে পরিবর্তন আনতো। এভাবেই কালক্রমে স্রষ্টা প্রদত্ত ইঞ্জীল শরীফ তাদের বর্তমানের বানানো বাইবেলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। যার প্রমাণ মিলবে পাশ্চাত্য জগতে নিষিদ্ধ করা "বার্নাবাসের বাইবেল" এর সাথে তাদের প্রচলিত বাইবেলের পার্থক্যসমূহে।
তাহলে কি দাঁড়ালো অর্থ? এ পর্যায়ের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার মূলে ক্রিয়াশীল ছিল এক শ্রেণীর ধূরন্ধর স্বার্থবাদী মহল, এক শ্রেণীর চক্রান্তকারী, সুবিধাভোগী কিংবা শত্রু। এরা আকাশে আরোহণকারী ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যক্তিত্বকে পুঁজি করে তাঁর নামে মিথ্যা রটিয়ে যেমন পৃথিবীতে তাদের নিকৃষ্ট অভিলাষের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে, তেমনি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতেও এক শ্রেণীর ঘরোয়া শত্রু-যারা বিক্রিত সামান্য অর্থের বিনিময়ে-পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী আগ্রাসী শত্রু এবং দাতাগোষ্ঠীর নামে বর্তমান "সংস্কৃতির যুদ্ধে" অবতীর্ণ পশ্চিমা শত্রুরা; আমাদের স্বাধীনতার রূপকার শেখ মুজিবের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে তার মূর্তি রচনা করেছে, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মানুষের ভালবাসা ও আবেগকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভাষ্কর্যের নামে তাদের স্থানে স্থানে মূর্তি স্থাপন করেছে, দেশের ঐতিহ্যবাহী ব্যক্তিত্বদের মূর্তি নির্মাণ করে করে তাতে মানুষকে ফুল চড়ানো শিখিয়েছে। এরা কারা? কেন তাদের এত আগ্রহ এসকল মৃত মানুষদের জন্য মূর্তি বানানোতে এবং সেসবে দিন গুণে গুণে ফুল চাড়নোতে, বেদীতে বলির মত করে নানা কার্যক্রম উদযাপনে? কি তাদের স্বার্থ এখানে?
এসব ভাবার অবসর যেন আমাদের জনগণের নেই, ফুরিয়ে গেছে সময়। বরং আমরা যেন খুঁজে বেড়াচ্ছি পৃথিবীর কোথায় কোন অপসংস্কৃতির জন্ম হচ্ছে আর আমরাও তাকে আমদানী করবো। কেন আমাদের এই তাড়া? কে শিখাচ্ছে আমাদেরকে এই অধঃপতন? একবারো কি ভাবনায় জাগলো না যে, মূর্তিতে ফুল দেয়া কোন পর্যায়ের কাজ, কাদের সংস্কৃতি? কোথায় অজান্তে বিক্রিত হয়ে যাচ্ছি আমরা!
মূলতঃ পৃথিবীতে প্রথম মূর্তিপূজার প্রচলনই ঘটেছিল কিছু সম্মানিত ও আল্লাহ্ওয়ালা মানুষকে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়াস থেকে। নবী নূহ আলাইহিস্ সালামের জাতিই হচ্ছে প্রথম জাতি যারা সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা শুরু করেছে। আয়াদ্দ, সূয়া, ইয়াউস, ইয়াউক ও নসর ছিল তাদের মধ্যকার সম্মানিত ও আল্লাহ্ওয়ালা কিছু মানুষ। এদেরকে স্মরণীয় করে রাখতে তারা এঁদের মূর্তি তৈরী করে রেখেছিল। এসব মূর্তির পাশে তারা জমায়েত হত এবং মনে করত এদের ভালোমানুষী তাদেরকে আল্লাহ্র কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। কিন্তু কালক্রমে তাদের এই জমায়েত হওয়া রূপান্তরিত হয় ভক্তি-শ্রদ্ধায়, আর ভক্তি-শ্রদ্ধাগুলো রূপ নেয় ইবাদাতে এবং পর্যায়ক্রমে এদেরকেই তারা তাদের উপাস্য বানিয়ে নেয়। এই মূর্তিগুলোর কথা কুরআনে সূরা নূহের ২৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
এছাড়া বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুরা যখন পূজা করে তখন কি করে? তারা তাদের দেবতাগুলোর মূর্তি তৈরী করে তা বিশেষ বিশেষ স্থানে স্থাপন করে, সেগুলোর সামনে একটি বেদী থাকে, সেখানে পূজার সময় তারা ফুল ছিটিয়ে দেয়, মূর্তির গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। তারপর তারা তাদের ধর্মগ্রন্থের মন্ত্র কিংবা কবিতা বা স্তুতিবাক্যাদি গেয়ে বা পাঠ করে তাদের পদ্ধতিতে হয়ত সিজদা করে, কিংবা মৌনব্রত পালন করে কিংবা অন্য কোন কায়দায় তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালবাসা প্রকাশ করে তথা ইবাদাত করে তা বাস্তবায়ন করে থাকে।
এবার দেখুন মূর্তির সামনে কি করে থাকে বাংলাদেশের মুসলমানগণ? এ পর্যন্ত যেসব মুসলমানের মূর্তি বানানো হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জন্ম কিংবা মৃত্যু দিবসে অথবা মূর্তির কাছাকাছি যেসব ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে সেসবে কি করা হয় বিভিন্ন নির্ধারিত দিবসে? সেখানে মধ্যরাতের পর থেকে কিংবা অন্য কোন সময় থেকে নিয়ে বেদী ধুয়ে মুছে, রঙ করে সেই বেদীতে ফুল ছিটানো হয়, মোমবাতি জ্বালানো হয়, মূর্তি কিংবা ভাস্কর্যের গলায় ফুলের মালা পরানো হয়। তারপর তাদের স্মরণে অথবা প্রশংসায় সংগীত পরিবেশিত হয়, কখনো শিল্পীর দ্বারা কখনো সকলেই খালি গলায়, কখনোবা হাতে হাত রেখে মৌন নিরবতায় স্মরণে এবং অবশেষে আরো নানা কায়দায় সমাপ্ত হয় এই বিনয় প্রদশর্ন, ভক্তি প্রদর্শন, শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও ভালবাসা প্রদশর্ন। পরন্তু দিনে দিনে আরো অভিনব কায়দা উদ্ভাবনের গবেষণা চলছে রীতিমত। একদিন হয়ত তা সিজদায় গিয়ে ঠেকতে পারে (নাউযুবিল্লাহ্)!
বলে রাখা জরুরী যে, আরবী ইবাদাত শব্দটি ইসলামী পরিভাষায় যে অর্থ প্রকাশ করে থাকে তা মূলতঃ এ তিনটি বিষয়ের সমাহার- পরিপূর্ণ বিনয়, পরিপূর্ণ ভক্তি-শ্রদ্ধা ও পরিপূর্ণ ভালবাসা।
কি পার্থক্য থাকলো তাহলে হিন্দুধর্মের মূর্তিপূজার সাথে এসব ভাস্কর্য আর মূর্তির প্রতি সম্মাননা প্রদর্শনের মধ্যে? এর বিচারের ভার বিজ্ঞ পাঠকের উপরই ন্যস্ত করলাম।
এতদূর বিস্তারনের পর যে আকুল আবেদনে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এ লেখকের মত মুসলিম বাংলার আরো বহু ব্যথিত অন্তর থেকে তাহলো, একটি বারের জন্যেও কি ভেবে দেখবেন না যে, আপনি একজন মুসলমান হয়ে কি করে এসব করে যাচ্ছেন? আপনি আপনার অন্তরে যে বিশ্বাস লালন করছেন, যে বিশ্বাসের আলোকে আপনি আপনার পরিচয় পেশ করছেন মানুষের কাছে যে-আপনি একজন মুসলমান-আপনার সে বিশ্বাসের সাথে এহেন গর্হিত মূর্তি নির্মাণ ও সেসবের পূজার মধ্যে সংঘর্ষ কতটা প্রবল! কখন সময় হবে আপনাদের এসব ভাবনার? কখন আপনাদের ঘুম ভাঙ্গবে? কখন এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোহময় জাল ছিঁড়বে? এসবের জন্য কারা মরিয়া হয়ে উঠছে; সে কথা কি কখনো ভেবেছেন? যারা এদেশে নাস্তিক মুরতাদ হিসেবে স্বঘোষিত, তাদেরকেই সবচেয়ে বেশী তৎপর দেখবেন এসব মূর্তির হেফাযতে এবং সেসবের পূজার ক্ষেত্রে নানা কৌশল বের করে করে শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের মূর্তিপূজা পর্যন্ত পৌঁছানোতে।
বলতে পারেন, হিন্দুধর্মকে কেন টানছেন? এর জবাবে আবারো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, পৃথিবী ব্যাপী এখন চলছে সংস্কৃতির লড়াই। এবং তা চলছে ইসলামী সংস্কৃতির সাথে অন্য সকল সম্মিলিত সংস্কৃতির। কুফরী শক্তি পরস্পর এ বিষয়ে একমত যে, ইসলাম ও মুসলমানদের নিষানা দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে হবে। আর সে পন্থা পূর্বেকার মত হত্যা করে নয়; বরং তা হবে পরিবর্তনের মাধ্যমে -এটাই তাদের পরিকল্পনা। তাই আপনি যতদিন নামায পড়বেন, ততদিন আপনার ম্যধে ইসলামী চেতনা অবশিষ্ট থাকবে, যখনি নামায ত্যাগ করে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের নামে মূর্তিপূজায় লিপ্ত হবেন, তখন আর আপনার মধ্যে ইসলামী চেতনা বেঁচে থাকবে না। তাই আপনার ভেতরকার ইসলামী চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে পারলে আর আপনার দেহটিকে ধ্বংস করে শুধু হন্তারক সাজার কি প্রয়োজন? সংস্কৃতির এ যুদ্ধে একজন মুসলমানের সত্যিকারের মুসলিম হিসেবে বেঁচে থাকা নির্ভর করছে তার ইসলামী চেতনাবোধ বেঁচে থাকার উপর। সেটিকে দুর্বল করতে পারলে কিংবা সেটির মৃত্যু ঘটাতে পারলেই আপনাকে শত্রুরা মৃতের তালিকায় উঠিয়ে দিতে পারবেন নিশ্চিন্তে। কিন্তু তা কি এতই সহজ? না। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শত্রুরা শিখেছে যে, ইসলামের বীজ মুসলমানদের অন্তরের এতটাই গভীরে প্রোত্থিত থাকে যে, মৃত্যুও মুসলমানদের অন্তর থেকে তা উপড়ে ফেলতে পারে না!
সুতরাং আপনাকে আর হত্যা করে নয়; বরং আপনার ইসলামী চেতনাবোধকে হত্যা করেই আপনাকে পরাজিত করা এ যুদ্ধের রণকৌশল। তাই বাংলাদেশের মত একটি দেশের পটভূমিতে সংস্কৃতির বিপর্যয় ঘটানো যতটা সম্ভব তার প্রতিবেশীদের থেকে, প্রতিবেশীদের দ্বারা; ঠিক ততটাই অসম্ভব ও সুদূর পশ্চিম থেকে আটলান্টিক-প্রশান্ত পাড়ি দিয়ে নিয়ে আসা সংস্কৃতি থেকে, সংস্কৃতি দ্বারা। এ কৌশলের আলামত খুঁজলে দেখবেন যে, নাস্তিক-মুরতাদগুলো সর্বদা ধর্মের বিরোধিতা করে কিন্তু এ অঞ্চলে ইসলামের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মের ওকালতি করে। ইসলামের মোকাবেলায় তারা হিন্দু ধর্মকে অব্যর্থ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আমাদের হিন্দু ধর্মের প্রতিবেশীদেরও বুঝা উচিত এ বিষয়টি। পরন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার যত ধরনের কায়দা কানুন রয়েছে, সেগুলো তো আমাদের 'মহান সেবক সংস্থাগুলো' (!) (যারা স্ত্রীর ঋণের দায়ে স্বামীকে হত্যা করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে আমাদের সেবা করে যাচ্ছেন; তারা) খুবই নিষ্ঠার সাথে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
তাই সর্বশেষে বলতে চাইছি যে, বর্তমানে বিমানবন্দর এলাকা থেকে লালন শাহর মূর্তি সরানোটা যদি চাপের মুখে হয়ে থাকে, তবে চাপ সৃষ্টি করা সেসব মুসলমানদেরকে আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম জানানো উচিত এবং জানানো উচিত অভিনন্দন। আর যদি সরকার হাজ্জীদের বিষয়টি লক্ষ্য করে সরিয়ে থাকেন তবে সরকারকে এহেন মহতি উদ্যোগের জন্য এদেশের প্রায় তের কোটি মুসলমানের পক্ষ থেকে অভিনন্দন। এবং এ মুহূর্তে তৌহিদী জনতার জোর দাবী এই যে, বাংলাদেশের মত একটি বৃহৎ মুসলিম দেশে পর্যায়ক্রমে যে হারে মূর্তি নির্মাণ ও স্মরণ-সম্মানের নামে সেসবের পূজা করা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সরকারে উচিত আইন করে তার প্রতিরোধ করা। অন্যথা তৌহিদী জনতা যদি লালনের মূর্তির মত অন্যান্য মূর্তিগুলোর গলায় দড়ি দিয়ে টেনে হিঁচড়ে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করে, তবে সেজন্য সরকারই দায়ী থাকবে; এ দেশের তৌহিদী জনতা নয়।
ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বলেছিলেন: "আমি পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছি মূর্তি ধ্বংসের জন্য।" তিনি যখন মদীনায় হিজরতের পরিকল্পনা করছেন, তখন তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু 'আনহুকে পাঠিয়ে মদীনার সকল উঁচু কবরগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন; যা কবর পূজার অন্তর্ভুক্ত। সর্বোপরি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন কা'বা শরীফে প্রবেশ করে তাঁর হাতের লাঠির আঘাতে কাবাভ্যন্তরের ৩৬০ মূর্তিকে একটি একটি করে ভেঙ্গে ফেলছিলেন আর বলছিলেন যে, جَاء الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقاً "সত্য সমাগত এবং মিথ্যা বিতাড়িত, নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হবারই ছিল।" [সূরা আল-ইসরা: ৮১] সেদিন থেকে পবিত্র কা'বা শরীফ থেকে চিরতরে মূর্তি বিতাড়িত হয়েছিল।
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মাত হিসেবে বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠী এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আহ্বান করছি- আপনারা পৃথিবীর এক দশমাংশ মুসলমানের অভিবাস এই বাংলাদেশ থেকে মূর্তি স্থাপন ও মূর্তি পূজার বিলুপ্তি ঘটান। এটা আপনাদের ঈমানী দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। অন্যথা ঈমানের দাবী আল্লাহর নিকট ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ্ এদেশের মুসলমানদের হেফাযত করুন মূর্তিপূজার সংস্কৃতির কবল থেকে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: হিন্দু ধর্মের লোকেরা তাদের ধর্মমত মূর্তিপূজা করবে, তাদের মন্দিরে মূর্তি স্থাপন করবে, তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। এ প্রবন্ধে মুসলিম প্রধান দেশে সামাজিক ভাবে মূর্তি স্থাপন ও মূর্তিপূজা প্রসারের যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, তার প্রতিবাদ করা হয়েছে।
-১৬ অক্টোবর ২০০৮
মদীনা মুনাওয়ারা, সউদী আরব।
ছবি: যায়যায়দিন-এর সৌজন্যে। http://www.jaijaidin.com
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০০৮ রাত ১:২৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




