গনজাগরন মঞ্চ শুরু হবার পর প্রথম মহাসমাবেশ হয় ফেব্রুয়ারীর ৮ তারিখে। সেদিন রাজু ভাস্কর্জে আমাদের একটা প্রোগ্রাম ও ছিল রাতে। প্রোগ্রাম শেষে রাত সারে ১১টা ১২ টার দিকে শাহবাগ থাকবো থাকবো করেও ঠিক করলাম না থাক আজ ফিরে যাই,গীটার-প্রসেসর নিয়ে থাকা ঝামেলা হয়ে যাবে। মোড় পার হয়েই রিক্সা নিলাম। রিক্সাওলা মামা রিক্সায় ওঠার পর হঠাৎই আমাকে জিজ্ঞেস করল-“মামা,এই মিটিং কয় দিন চলব?”
আমি বললাম-“কেন মামা?”
-“না,এমনি জিগাই,কয়দিন চলব?”
-“আপনার কি মনে হয়? কয়দিন চললে ভাল হয়?”
-“আমার তো মনে হয় এখনই মিটিং ভাইঙ্গা দিলে ভাল!”
-“কেন?,সমস্যা কি?”
-“সমস্যা না? রাস্তা আটকায় রাইখা মিটিং চলতেছে,রাস্তা জাম হয়া থাকে!”
-“জ্যাম তো এমনিই থাকে মামা,নতুন কি? আর এই মিটিং কেন চলতেছে আপনি জানেন?”
-“হ,জানি”
-“বলেন তো কেন?”
-“ওই যে রাজাকারের ফাঁসি চায়”
-“আপনি চান না?”
-“চামু না কেন? কিন্তু বিচার তো একটা হইছেই,তাইলে এখন এই ব্যাটার জন্য এইখানে বইসা থাইকা লাভ কি?”
-“কি বিচার হইছে? এই লোকটা ৭১ এ যুদ্ধের সময় কি করছিল আপানি জানেন?”
-“না”
আমি খুব সংক্ষেপে কাদের মোল্লার ৭১ এর সময়ের কিছু কির্তী তাকে বললাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম-“এখন বলেন,আপনার কি মনে হয়? শাহবাগে যা হচ্ছে তা ঠিক আছে নাকি বেঠিক?”
কি বুঝল কে জানে,সে বলে বসল-“তাইলে মামা,এইসব মিটিং কইরা লাভ কি?”
আমি মনে মনে ভাবলাম “ধুর হালার,এতক্ষন কি সাপ মারলাম নাকি দড়ি পিটাইলাম?!!” কিছু বললাম না।
সে হঠাৎ বলল-“আমি তো অশিক্ষিত মানুষ,অত কিছু বুঝি না। একটা কথা কই-এত মিটিং কইরা কি হইব? রাজাকার যে কয়ডা আছে সবগুলারে ধইরা একসাথে গুলি কইরা মাইরা ফেলাইতে হইব,ঠিক আছে না?”
আমি হেসে ফেললাম-“সেটা কি সম্ভব মামা? দেশে আইন কানুন আছে না? আপনি যেটা বললেন সেটা করতে পারলে তো ভালই হত,কিন্তু তাহলে তো দেশে দাঙ্গা লেগে যাবে।”
-“ধুর মামা,কি কন? শুনেন,আমি কই-মনে করেন একদিন সরকার ঘোষনা দিব যে আধাঘন্টার জন্য সব দড়জা জানালা বন্ধ,কেউ ঘরের থিকা বের হইতে পারব না। এই আধা ঘন্টায় সব রাজকার রে গুলি কইরা মাইরা ফেলব।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। মাত্র ৫/৬ মিনিটের বুঝানোতে এমন ওভার ডোজ হয়ে যাবে টের পাই নি! রিক্সা আগাতে থাকলো। কিছুক্ষন পর আবার সে বলল-“মামা,আমি সরকার হইলে এইডাই করতাম।”
আমি হেসে ফেললাম। মনে মনে ভাবলাম, “নাহ! দড়ি না,সাপ ই পিটাইছি,তাও আবার বাড়ি টা মাজা বরাবরই পড়ছে!”
যাই হোক,সহজ সরল রিক্সা চালক,অশিক্ষিত রিক্সা চালক,৭১ না জানা রিক্সা চালকও মাত্র ৫ মিনিট রাজাকারের অমানুষিকতার কথা শুনে তাদের জন্য এমন ঘৃণা প্রকাশ করে,আর আমাদের বুদ্ধিবেশ্যারা যুক্তির পিঠে যুক্তি সাজিয়ে,নানা রকম ত্যানা পেঁচিয়ে কত রকমেই না যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করেন!!
এ তো গেল অশিক্ষিত এক রিক্সা চালকের কথা। এবার বলি সদ্যই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করা একজনের কথা। আমার খুব ক্লোজ এক ছোট ভাই এর ফ্রেন্ড। আমার সাথেও বেশ ভাল পরিচিত। ফেসবুকে একদিন তার শাহবাগ আন্দোলনকারীদের আতেল সম্বোধন করে একটা ত্যানা প্যাচানিয়া স্ট্যাটাস দেখলাম যার মূল উপাদান হচ্ছে বিশ্বজিত,পদ্মা সেতু,নাস্তিক আরও দেশের বিভিন্ন সমস্যা জাতিয় ত্যানা। অনেক কথা,যুক্তি চালাচালির পর আমি তাকে বললাম-“তালগাছ টা তোমাকেই দিলাম,কিন্তু তুমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাও কি না বল?”
সে বলল-“হ্যা,চাই”
আমি তাকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তাহলে শাহবাগ আন্দোলন কে আতলামি বলার মানে কি?
সে ঘুরে ফিরে আবার সেই একই ত্যানা প্যাচানো শুরু করল! মনে মনে ভাবলাম, “তাকে তালগাছ দিয়ে আমার কি লাভ হইল?”
৪২ বছরের পুরোনো ক্ষত যখন শুকায় নি,তার মানে শরীরে ডায়েবেটিস আছে!! নতুন ক্ষত শুকাবে কিভাবে?!! আগে সেই পুরোনো ডায়েবেটিসের চিকিৎসা হোক,পঁচে যাওয়া ক্ষত শুকাক,নতুন ক্ষত শুকাবে সেই ওষুধেই। জানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না,কিন্তু জাতি হিসেবে যে বলীষ্ঠ,তার প্রমান হবে। সেই পুরোনো পঁচে যাওয়া ক্ষত শুকিয়ে গেলে নতুন ক্ষতগুলো শুকানোর ক্ষমতা যে শরীরে তৈরি হয়েছে তা অন্তত বুঝতে পারব। আত্মবিশ্বাস পাবো নতুন সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার।
যাই হোক,বেশ কয়েকদিন বোঝানোর পরও যখন সে একই ত্যানা নিয়া প্যাচ কাটতেই থাকল আমি ভাবলাম “থাক বাবা,তোমাকে যে তালগাছ দিয়েছিলাম,সাথে আরেকটা কাঁচি ও দিচ্ছি;এখন তোমার বা* কাইটা আরও কিছু তালগাছ বানাও! অশিক্ষিত রিক্সাওয়ালাও তোমার থেকে ভাল বোঝে!”
আমি মনে হয় যথেষ্ট আবেগী মানুষ। আন্দোলন শুরুর কয়েকদিন পর থেকেই বিভিন্ন জন বিভিন্ন ভাবে বিচার বিশ্লেষন করে যখন আন্দোলনের গতিপথ নির্ণয়ে ব্যাস্ত,হিসেব কষে কেউ আন্দোলনের পজেটিভ ফলাফল আবার কেউ নেগেটিভ ফলাফলের ভবিষ্যত বাণী দিচ্ছে,আমি তখন আবেগ দিয়েই ঠেলে ঠুলে নিয়ে যাচ্ছি “এবার একটা কিছু হবেই” এর দিকে।
প্রতিটা মহাসমাবেশ শুরুর আগে একসাথে দাড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় গলার কাছটাতে কি যেন একটা বেঁধে যেত। পাশে দাড়িয়ে থাকা খুব কাছের মানুষটা সেই সময় যখন নিজের হাতের মুঠিতে হাত নিয়ে চেঁপে ধরত সেই স্পর্শ আমাকে বলত-“এবার একটা কিছু হবেই।”
প্রোফেশন নিয়ে প্রচন্ড হতাশায় ভুগতে থাকা আমি যখন “থাকব না এই দেশে” বলে বাইরে পাড়ি দেয়ার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলাম তখন শাহবাগের এই প্রতিবাদী তারুণ্যের জোয়ার আমাকে বলল-“এবার একটা কিছু হবেই।”
দু’দিন পর গান গাইতে স্টেজে উঠতে হবে জেনেও রাত জেগে স্লোগানে গলা ফাটানোর সময়,অথবা ভোর হবার আগে আগে ক্লান্তি কাটাতে ছবির হাটে চা খেতে খেতে অভিজিৎ দা’র সাথে ‘কালো মেয়ে’ গানের
“মা তোর মেয়ের দিকে ম্যাচ বাক্স ছুড়ে বলেছিলাম-
কাঠি নেই,কাঠি নেই!
এবার বারুদ হয়ে জ্বলো!”
এই লাইন গুলো গাইতে গাইতে মনে হয়েছিল-“এবার বারুদ হয়ে নিজেদেরই জ্বলতে হবে।”

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




