somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানবিক বিচার!!!

১৬ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বয়স্ক লোকটি অনেক্ষণ ধরে ফুলের দোকানটার পাশে ফুটপাতের ধারে বসে আছে। সেই ভোর বেলা থেকেই। রাত অন্ধকার থাকতে থাকতেই সে গাড়ি থেকে নেমেছে ঢাকায়। দিনাজপুর থেকে রাতের বাসে এসেছে। গায়ে মলিন একটা সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা, অনেক ব্যাবহারে পাতলা এবং ফিনফিনে হয়ে গিয়েছে।

ফুলের দোকানে এই সময়টা ভয়াবহ ব্যাস্ততায় কাটে। পাইকারি বাজার। এর ফাকেও দোকানীর চোখ এড়ায় না এই নতুন দেখা বুড়ো। সেই ভোর থেকে চুপচাপ বসে যেন কি ভাবছে সে। চোখেমুখে কেমন এক চাপা উত্তেজনা। যেন কিছু একটার জন্য অপেক্ষায় আছে সে। শাহবাগের মোড়টাতে ভীড় বারতে শুরু করেছে। চলছে স্লোগান – “গোলাম আজমের ফাঁসি চাই”
বুড়ো লোকটির খুব ইচ্ছে করছে ছেলেমেয়েগুলোর সাথে গিয়ে গলা মেলাতে। কিন্তু গতরাতে সারারাত ধরে বাসে সেই দিনাজপুর থেকে এসে খেয়ে না খেয়ে থাকা শরীরে আর কুলাচ্ছে না যেন। পাশের বাড়ির মন্তুর ছেলে তাকে সাবধানও করেছিল –“ চাচা এই বয়সে এতদূর একা একা যাইও না। তুমি গেলেও যা,না গেলেও তা।” কিন্তু সে শুনে নি। কিছুদিন আগে কামারুজ্জামানের রায়ের পর সে টিভি তে দেখেছে এখানে সবাই কেমন আনন্দ করে,আনন্দ মিছিল করে! দেখে তারও খুব ইচ্ছে করেছিল এখানে এসে সবার সাথে সেও আনন্দ মিছিল করবে। দেখে সে এক মূহুর্তে যেন চলে গিয়েছিল সেই ’৭১ এর ডিসেম্বর মাসে- কি যে করেছিল সেদিন তারা সবাই মিলে!! মনে হতেই মিটিমিটি হাসে বুড়ো! ফুলের দোকানী ভ্রু কুঁচকে তাকায়- পাগল নাকি লোকটা! বেলা বাড়তে থাকে। ক্ষুধাও লেগে গেছে। সেই ভোর রাতে সেহরীতে চায়ের সাথে মিশিয়ে শুকনো পাউরুটি খেয়েছিল,তাতে আর কতক্ষণ চলে? পকেটে খুব বেশি টাকাও নেই,হিসেব করে খরচ করতে হয়েছিল। আবার তো ফিরতে হবে।

পাশ দিয়ে কয়েকটা ছেলেমেয়ে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে-“সবগুলা অভিযোগ প্রমাণ হইছে দোস্ত,মিছ নাই!”
শুনে বুড়োটার ভিতরটা কাঁপতে থাকে উত্তেজনায়-কতদিন ধরে এই দিনের জন্য অপেক্ষা করে আছে!!
কেউ একজন বলে- রায় হইছে?
ক্লান্ত শীর্ণ শরীর নিয়েও উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠে বুড়ো। পাশ দিয়ে প্রায় দৌড়ে যাওয়া ছেলেটির হাত টেনে জিজ্ঞেস হড়বড় করে কোনমতে জিজ্ঞেস করে তাকে-“কি রায় হইছে বাবা?”
ছেলেটা কোনমতে একবার-“ফাঁসি হয় নাই” বলেই দৌড়ে ভীড়ের মধ্যে মিশে যায় চিৎকার করতে করতে-“এই রায় মানি না।”
বুড়োর কাছে ছেলেটির কথা মিথ্যা মনে হয়। পাশ দিয়ে যাওয়া আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে। সেও একই কথা বলে,সাথে বলে – বয়স বিবেচনায় নাকি ফাঁসি দেয় নাই!!!
বুড়োটা ধপ করে বসে পরে মাটিতে। চারিদিক যেন অন্ধকার হয়ে আসে। আশেপাশের এত চিৎকার,স্লোগান কিছুই আর কানে যায় না তার। বিড়বিড় করে বারবার উচ্চারণ করতে থাকে- বয়স বিবেচনা,বয়স বিবেচনা...!!

তার কাছে হঠাৎ-ই ’৭১ ভেসে আসে আবার। স্বাধীনতার দুই কি তিনদিন পর সে বাড়ি গিয়েছিল। যুদ্ধের পুরো সময়টা দেশের বিভন্ন যায়গায় দাবড়ে বেড়াতে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে। জান হাতে নিয়ে কত না অপারেশন চালাতে হয়েছে! প্রতিটা অপারেশনে যাওয়ার আগে মনে হত এই বুঝি শেষ। কোনদিন বাড়ি ফেরা হবে না হয়ত। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় তার একটা স্ত্রী ছিল,ছিল একটা ৪ মাস বয়সী ছেলে,আর এক বুড়ো বাবা! বড় ভাই শহরে ব্যাবসা করত,বাড়ি ছাড়ার আগের দিন সে জানতে পেরেছিল গ্রামে ফেরার পথে পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে,সাথে নিয়ে গেছে ভাবী কেউ। শুনে তার বুড়ো বাবা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ছাড়ার সময় বউ কে শুধু একবার বলে গিয়েছিল – “বাবা আর গ্যাদা রে দেইখা রাইখো।” চোয়ালবদ্ধ সংকল্প নিয়ে সে বাড়ি থেকে বেড় হয়েছিল-দেশ কে শত্রু মুক্ত করবে।

যুদ্ধ শেষ হবার পর বাড়ি ফেরার সময় নিজের কাছেই অবিশ্বাস লেগেছিল জীবিত ফিরতে পারছে বলে। স্ত্রী সন্তান,বাবার কাছে আবার ফিরে যাবার আনন্দ আর উত্তেজনার সাথে কিছুটা শংকাও ছিল-সব ঠিকঠাক আছে তো?
শেষ পর্যন্ত শংকাই ঠিক হয়েছিল-ফিরে গিয়ে সে কাউকে পায় নি। না বাবা,না স্ত্রী,না সন্তান এমনকি বাড়িও না। গ্রামের লোকদের কাছে পরে সে শুনেছিল সব কথা-
আর্মিরা হামলা করেছিল। পাশের গ্রামের চাঁন রাজাকার বাড়ি চিনিয়েছিল তাদের যে এই বাড়ির পোলা মুক্তিবাহীনি তে যোগ দিছে। মিলিটারি রা এসে বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার আগে উঠানের ওই গাছ টার নিচে জবাই করেছিল বুড়ো বাবা কে। স্ত্রী কে বাড়িতেই ধর্ষন করেছিল মিলিটারিগুলা তারপর ধরে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পে আর বাচ্চাটা মা কে ধর্ষনের সময় কিছু না বুঝে চেচাচ্ছিল বলে ছুড়ে ফেলেছিল উঠানে। চার মাস বয়সী বাচ্চার তাতেই মৃত্যু হয়েছিল!!
বুড়ো লোকটার দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মাথা ঘুরতে থাকে। নিজেকে তার বড় অসহায়,অপমানিত লাগে! যে দেশের জন্য তাকে সব হারাতে হয়েছে সেই দেশের কাছ থেকে সে আজ খুব বড় উপহার(!) পেল!!!
--------------------------------------------------------------

৯১ বছরের বুড়া একটা শুওরের ৯০ বছরের কারাদন্ড হয়েছে!! বয়সের কারণে ফাঁসি হয়নি! মানবাধিকার বিরোধী কর্মকান্ডের এমন হাস্যকর ‘মানবিক’ বিচার পৃথিবীর আর কোথাও কখনো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এই বিচার স্বাধীনতার অপমান,মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান,মুক্তিযুদ্ধের অপমান,এই দেশের অপমান!! এই বিচারের মুখে পেচ্ছাব করি!!
একটা গানের কয়েকটা লাইন বারবার মনে পড়ছে-

“রাত যায় আসে রাত দিন গেছে হারিয়ে
কাঁটা তার আকাশে চাঁদ গেছে পালিয়ে!

আমাদের হৃদয়ে আকাশ রাখনি
আমাদের মননে প্রদীপ জ্বালনি।
ধিক্কার তমাদের দেখি হাহাকার শীর্ণের
তোমরাই ভগবান বেওয়ারিশ সময়ের!!”
-চিৎকার

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×