সরদার মোবারক আলী ।বয়স ষাট বছর ।দীর্ঘদিন কেরানীর চাকরি করার সুবাদে চেহারায় "চাকর" ভাবটা স্থায়ী হয়ে গেছে ।মোড়ের পান দোকানদার পানের মধ্যে সুপুরি কম দিলেও তিনি আবার চাইতে সংকোচ বোধ করেন ।আড্ডায় চেয়ারের শর্ট পড়লে আপনাতেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ান । ছত্রিশ বছর চাকরী জীবনে তিনি পুরটাই সৎ ছিলেন।এদেশের বেশীর ভাগ মানুষ সুযোগের অভাবে সৎ থাকে ।তারপর বৃদ্ধ বয়সে সেই "সততার" মার্কেটিং করে মসজিদ কমিটির সভাপতি হয় ।মোবারক আলী তেমন না ।তিনি শখ করে সৎ থাকেননি থেকেছেন তার বাবা সরদার মোশারফ আলীর মৃত্যু কালিন কড়া নির্দেশে ।আমাদের দেশে মৃত্যু কালিন নির্দেশ গুলোকে আমলনামার মতোই শিরোধার্য ভাবা হয় ।তাছাড়া হাদিসে আছে "দুনিয়াতে যার সম্পদ কম আখেরাতে তার হিসাব সহজ হবে।আখিরাতের ব্যালেন্স শীট সংক্ষিপ্ত করতেই মোবারক আলী কখনও অসৎ হবার সাহস করেননি ।
স্ত্রী মোমেনা বেগম আর শুদ্ধ, মুগ্ধ দুই ছেলে নিয়ে তার সংসার ।যদিও ভোটার আইডি কার্ডে মোমেনা বেগম নামের জায়গায় মোমেনা খাতুন চলে এসেছে ।তবে এনিয়ে স্বামী স্ত্রী কারোরই তেমন মাথা ব্যাথা নেই ।গরীবের বউ খাতুনও যা বেগমও তাই ।মোবারক আলী আর মোমেনা বেগমের ছেলেদের নাম আলাল দুলাল থেকে বড়জোর আকাশ সাগর হওয়াটাই সাভাবিক ছিল ।তা না হয়েছে মুগ্ধ আর শুদ্ধ ।রিকসাওয়ালার নাম রাজা,সম্রাট পর্যন্ত মেনে নেয়া যায় কিন্তু কোনমতেই যুবরাজ কিংবা রাজকুমার নয় ।আসলে নামের এই বদনাম ঘটিয়েছে মুগ্ধের আমেরিকা প্রবাসী ছোট মামা ।বিদেশ থেকে পত্র মারফত এমন অত্যাধুনিক দুটি নাম পাঠিয়েই সম্ভবত মামা তার দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছেন ।আর কখনও খোজ খবর নেননি ।বউ পুতুলের সংসার ফেলে পয়ত্রিশ বছর আগে মোমেনা বেগম সেই যে মোবারক আলীর রান্নাঘরে ঢুকেছেন আজ এতগুলো বসন্ত চলে গেল,মোমেনা খাতুনের আর ঘর থেকে বের হয়ে কৃষ্ষচুড়া দেখা হলো না ।
চাকরী থেকে অবসরের পর থেকে মোবারক আলীর একমাত্র কাজ হয় বড় ছেলের জন্য একটা চাকরির তদবির করা ।এদেশের সবারই চাকরির সুপারিশের জন্য দু একজন মন্ত্রী/ মিনিষ্টার/এমপি থাকে ।মোবারক আলীর তা নেই ।দীর্ঘ চাকরি জীবনে সততার সুনাম ছাড়া তার হাতে আর কিছু নাই ।সেই সুনামের উপর ভর করেই তিনি প্রতিদিন সকাল বিকাল বড় সাহেব ছোট সাহেবদের দরজার সামনে কাচুমাচু মুখ করে দাড়ান ।ভিতরে ঢোকার সাহস পাননা ।হয়ত কোন একদিন সাহেব নিজেই তাকে ডেকে নিবেন এই আশায় ।ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন সাহেবের একটু ক্ষুদ্র অবসরের জন্য ।অবসরে বড় সাহেব চা দিয়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খান,এসি ছেড়ে টেলিভিশনে রিমোট চাপেন ।ইদানিং সব অফিসেরই বড় সাহেবদের রুমে টেলিভিশন থাকে ।কি কারন কে জানে !
তারপর হটাত একদিন বড় সাহেবের চোখ পড়ে মোবারক আলীর সর্বশান্ত মুখের উপর।ঘাড়ে হাত দিয়ে কুশলাদি জানতে চায় ।বড় সাহেব তার ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলছেন !বাকী জীবন গল্প করার জন্য এমন একটি ঘটনাই যথেষ্ট ।বিগলিত হয়ে বলেন;
; স্যার আমার ছেলের চাকরীটা ?
- ও হ্যা ।ফাইলটা পাঠিয়ে দিয়েছি ।হয়ে যাবে ।
ফাইলের গতি প্রকৃতি মোবারক আলীর ভালোই জানা আছে ।বিনয়ে গলে গিয়ে বলেন
; স্যার যদি খরচ টরচ কিছু লাগে বইলেন !পেনশনের দুই লাখ টাকা জমা করে রাখছে ।যদি বলেন আপনার হাতে তুলে দেই !
: ছি:ছি মোবারক সাহেব ।আপনি একজন সৎ নিষ্ঠাবান মানুষ ।আপনি আমাকে ঘুস অফার করছেন !
আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ী যান ।আপনার ছেলে নিশ্চয়ই আপনার মতোই সৎ হবে ।হয়ে যাবে
মোবারক আলীর ক্ষীনকার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে ।সারা জীবনের সততার পুরস্কার আজ তিনি বড় সাহেবের কাছ থেকেই পেলেন ।কর্মজীবনে উপেক্ষিত মানুষেরা পারিবারিক জীবনে রগচটা হয় ।মোবারক আলীও তার ব্যাতিক্রম নন ।তবে আজ তিনি বিগলিত ।বাড়ীতে গিয়ে দেয়া বক্তৃটাও মনে মনে ঠিক করে ফেললেন ।তবে স্ফীত হওয়া বুকটা চুপসে যেতে বেশী সময় লাগেনি ।সপ্তাহ খানেক পরেই জানতে পারেন তার ছেলের চাকরীটা হয়নি ।যার হয়েছে তাকে দু লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়েছে ।অতি সৎ বলেই হয়ত মোবারক আলীর কাছে বড় সাহেব ঘুস চাইতে পারেননি ।"সততা" তার ছেলেকে বেকারত্ত্ব দিয়েছে আর তিনি হয়েছেন পুত্রদায়গ্রস্থ পিতা !
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১:০৬