somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারভার্ট ১

২৫ শে নভেম্বর, ২০১০ বিকাল ৩:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“তোমার মধ্যে ডুবসাঁতারের ইচ্ছেটা আমার ফুরোয় না কখনো । উদয়াস্ত ওতেই বুঁদ হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে” পার্থর নিপুণ চিরুণী হয়ে ওঠা বাঁ হাতের আঙুলের স্পর্শ অনুভব করতে করতে তার কথাটা নিয়ে মাথার মধ্যে খেলতে থাকে নীপু । “কিন্তু তাহলে শ্বাস নেবে কিভাবে ?” পার্থর কাব্যিকতাকে একটু যেন খোঁচাই দেয় নীপু । এটা একটা মজা , হঠাৎ লয় পাল্টে , গায়কের গায়কী – মুন্সিয়ানার একটা পরীক্ষা । “শ্বাস যে নিতেই হয় , ওইটাই তো আপসোস !” পার্থর উত্তরে দুজনের নিঃশব্দ হাসি ; যেন , “কি , হল তো ?” আর “যাও ! পাশ করলে” – ধ্বনি ছাড়াই প্রতিধ্বনিত হয় দুজনের মাঝে ।

একটু ঝুঁকে , নীপুর চোখ দুটোতে চুমু খেয়ে , বুড়ো আঙুলের আলতো ছোঁয়া দিতে থাকে নীপুর কান থেকে গালে , তার বুঁজে থাকা চোখের ওপর পার্থর চাউনি স্থির । এই সময়গুলোতে অদ্ভুত এক ভাললাগার অন্যরকম একটা রেশ – বেশ তারিয়ে তারিয়ে নীপু উপভোগ করে – প্রচন্ড রোদক্লান্তিতে বরফকুচি মেশানো ঠান্ডা লেবুর সরবৎ ঢকঢক করে গেলার পর যে একটা প্রশান্তি ধমনী-শিরা বেয়ে সারা শরীরে তিরতির করে অবসাদ-আনন্দ ছড়িয়ে দেয় , অনেকটা সেরকম । চিরচেনা মাঠে নিজেকে হারিয়ে এলোমেলো পদচারণ করতে থাকা খেয়ালী ভাবুকের মত , নীপুর আঙুল আলতো পায়ে হেঁটে চলে এক বুক দূর্বা ঘাসের মাঝে । শীতের সকালের প্রচন্ড আলসেমাখা সূর্যদয়ের মত , পর্দা ওঠে নীপুর চোখের – দেখে , মহাবিশ্বের ওপার থেকে আসা নাম না জানা প্রাণীর চোখের বিস্ময় পার্থর চাউনীতে । “কি এত দেখ ?” একটু ন্যাকামো মেশানো স্বর নীপুর । মুগ্ধতা কাটেনি পার্থর চোখ থেকে ,

“পিদিমের এক সলতে আলোয় গোটা দুনিয়াটাকে দেখার ইচ্ছে আমার,
দেখা হয় না ।
শার্টের বুক পকেটে, ইচ্ছে করে, আস্ত ওয়র্ল্ড ব্যাংকটাকে পুরে ফেলি,
হয়ে ওঠে না ।
হাতের তালুর গোপন গলি-ঘুপচির দুর্বোধ্য নকশা থেকে
খুঁজে পেতে ইচ্ছে করে ইকেরাসের খসে পড়া মোমের ডানা,
খুঁজে পাই না।
জীবনের অনেক না পাওয়া বাসনারা, যারা ডানা ঝাপ্টিয়ে হারিয়ে গেছে
অনেক আগে, তাদেরকেই দেখতে পাই।
বর্ণিল সূর্যোদয় দেখে মাতাল হওয়া কৈশোর,
প্রথমবার সমুদ্র দেখে উদ্বেল হওয়া শৈশব,
কিম্বা তারও আগে, যখন সময়ের গাছ-পাথরও ছিল না,
সেই মটরদানা থেকে শুরু –
তোমার মাঝেই দেখি সভ্যতার উদয়াস্ত,
সহস্রবার যাপিত জীবন!”

নীপুর ঠোঁটে মুচকি হাসি , “কার লেখা এটা ?”
“তোমার আমার যৌথ প্রয়াসের মিলিত উল্লাস । ভাবনাটুকুন তোমার দেয়া , শব্দটুকুন আমার ।”
“যাহ ! সত্যি ? কবে লিখলে ?”
“এখনো লিখিনি । লিখতে পারব বলেও মনে হয়না । কি বলসিলাম ভুলে গেসি ।”
ভুস করে যেন অতলান্তিক গভীরতা থেকে বুদবুদের মত পলকা হয়র ওঠে পরিবেশটা । “হুমম ! শর্ট টার্ম মেমরী লস , তোমার দেখি গজনী-রোগ হইসে” – বদবুদটা ফাটিয়েই ফেলে নীপু ।

হাল্কা হাসির পর আরও গুটিশুটি মেরে পার্থর বুকে নিজেকে গুঁজে দিয়ে , যেন পৌষ রাত্তিরে জীবনের সেঁক-উত্তাপ নিতে নিতে , নীপু অস্ফুট কিছু শব্দ করে । এটাকে পার্থ বলে ‘বেড়ালিপনা’ । নিরাভরণ দুটি মানুষের মধ্যে তখন যৌনতার চেয়েও গভীরতর কিছু তরঙ্গের গমনাগমন – যেন সূর্য বিদায় নেবার পরও ধূলো আর বাষ্পের কাঁধে চড়ে আলোর বহুবর্ণময় নাচন । দুটো মানব-মানবীর মাঝে যখন ঝড় বয়ে যায় , তখনও পরষ্পরকে এতটা চেনা হয়না , জানা হয়না , বোঝা হয়না , যতটা এইসব মুহুর্তগুলোতে । এই সময়খন্ডগুলোর জন্যই তৃষিত ওরা দুজন ।


“বিয়ে মানুষকে কতটুকু বন্ধনে বাঁধতে পারে ?” নীপু এইসময় এইরকম কিছু ভাবতে চাইছিল না । কিন্তু ভাবনারা বড্ড বেরসিক , বিনা নোটিশে ঠিকই হামলে পড়ে । “যতটুকু মানুষ নিজেকে বাঁধতে চায়” নিজের ভেতর অন্য কার উত্তর । আজকাল এইসব কথোপকথন কিছুতেই থামাতে পারেনা নীপু । পার্থ একটা সমাধান বাৎলেছিল , “নিজের ভিতর পরষ্পরবিরোধী স্বত্তা দুটোর মাঝে ধুন্দুমার লড়াই বাধিয়ে , তুমি নিরীহ নিরপেক্ষ দর্শক হয়ে বসে বসে তামাশা দেখো ।” কিন্তু ওতে যে নিজেকে শতছেঁড়া হতে হয় , তাদের আবার জোড়াতালি দিয়ে প্রতিদিনের বাধ্যবাধকতার সংসারের সাথে নিজেকে আর মেলানো যায় না ! কিন্তু সেই কথাটাই বা পার্থকে কি করে বোঝায় নীপু ! পুরো পৃথিবীকে ফাঁকি দিয়ে যার কাছে ছুটে আসা , তার কাছেই মনের সবকটা ডালা যে খুলতে পারা যায় না !

অন্তর্গত দ্বৈত সত্ত্বার বাকযুদ্ধ শুনতে শুনতে হঠাৎ সামনের পুরুষটিকে নীপুর বড় অচেনা লাগে । “কে সে ? সে তো আমার কেউ নয় ! তাহলে কেন সে আমার সবকিছু নিংড়ে নিয়ে সুখী হবে ? আমিই বা কেন তার হাতে আমার সর্বস্ব সঁপে দেব ? কেন ?” কি যে হয় নীপুর ! ঝট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় পার্থর বাহুবন্ধন থেকে । এলোমেলো বিছানা হাতড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পোশাকগুলো নিয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে যায় । এক ঝলকেই দেখে পার্থর চোখের হতবাক এবং ব্যাথিত চাউনী ।

*** *** *** ***

ড্রইংরুমে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন । ভদ্রলোকটি হলেন জনাব এফ. এম. ফরহাদ , ওরফে পার্থ । খুব মনোযোগ দিয়ে “অন্যদিন”-ঈদ সংখ্যার পাতা ওল্টাচ্ছেন । গোসল সেরে যে একটু শান্তি লাগছিল , এখন , ঐ ‘ভদ্রলোক’ এর ভদ্রবেশ দেখে একটা ভুইফোঁড় রাগ তীব্র খোঁচায় নীপুর মাথার তালুতে আগুন ধরিয়ে দেয় ; কেন , সেটা নীপু নিজেও জানে না , বোঝে না । শুধুই তার মনে হতে থাকে , কেন পার্থ তার আদিম , বুনো , প্রবল চেহারাটা গতানুগতিকতায় , ভালমানুষীর মুখোশে ঢেকে দিল ? ভয়ে ? হাঃ পুরুষ ! সে কি পারে না সব আবরণ , সব সভ্যতা-ভব্যতা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে তার স্বরূপ নিয়ে মাহফুজের সামনে , সমাজের সামনে , পুরো পৃথিবীর সামনে অটল হয়ে দাঁড়াতে ? সব লন্ডভন্ড করে , ভেঙেচুরে একাকার করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে ? চুলোয় চায়ের পানি চাপানোর সময় নীপুর মনে হয় , পার্থর পৌরুষ হল প্রেশার কুকারে ফুটতে থাকা তরলের মত , ওতে হাত ডোবালে তবেই পোড়াবে , কখনো আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হতে পারবে না । কাপে দুধ-চিনি মেশাতে গিয়ে নীপু টের পায় , হঠাৎ বুক ঠেলে কান্না দলা পাকিয়ে উঠছে । অন্তর্গত বহুমুখী টানাপোড়নে সবকিছুই শুন্য মনে হতে থাকে । ‘পার্থ যদি সত্যিই কোনদিন পৃথিবীর সব পার্থিবতাকে বে-তোয়াক্কা করে তোমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় , তুমিই কি সাড়া দিতে পারবে ?” – এই প্রশ্নটা নীপুর ভেতর এতক্ষণ জ্বলতে থাকা রাগ কিম্বা অভিমানের গলা টিপে ধরে তাকে তাকে অদ্ভুত এক বিষন্নতায় , হতাশায় সিঁটিয়ে দেয় । এই ভালবাসার অনেক শক্তি , কিন্তু প্রথা ছিন্ন করতে পারার জোর তার মাঝে নেই । ভালবাসা – মরিচীকার অন্য নাম ।

ঘাড়ে একটা আলতো চুমুর আর্দ্র স্পর্শ । নীপু মাথাটা পেছন দিকে পার্থর বুকে এলিয়ে দেয় । নিজের সাথে লড়াই করতে করতে সে ক্লান্ত । এই সমর্পণ যতটা না ভালবাসার , তারচে’ অনেক বেশী , ক্লান্তির , পালিয়ে বাঁচার । বেশীরভাগ মানুষই তো পলায়নপর , এবং সবচেয়ে বেশী সে নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে বেড়ায় ।


(চলবে)
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×