somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভুবনচিলের ডানায় - পিছলে পড়ে রোদ (ছোটগল্প)

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১১:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :






এইসব রাতে - একাকী ল্যাম্পপোস্টের বিহ্বল নিয়ন আমার মরচে পড়া জানালা দিয়ে গলে অগোছালো বিছানায় মাকড়সা এর মত ছড়িয়ে পড়লে নিজেকে বড্ড বেশি ছারপোকা মনে হয়। বিদঘুটে, কুৎসিত, দুর্গন্ধবিশিষ্ট এবং সর্বোপরি ঘৃণা ও জিঘাংসা উদ্রেককারী। ক্লান্ত দিন শেষে আমার বিছানার চাদরে লেপ্টে থাকে নিষুপ্ততা, বালিশে হামাগুড়ি খায় দুঃস্বপ্নের দল। আমারই কেবল ঘুম আসে না, আমি দেয়ালঘড়ির গান শুনি, টিকটিক, টিকটিক। পোড়ে সিগারেট, মশকীর কয়েল, দেয়ালে ঝোলে ঝুল, ওড়ে ধোঁয়া আর ধূলো। আর এইসব রাতে, এইসব ধূসরতার মাঝে আমি এক স্থবির সময়ের মাঝে আটকা পড়ে থাকি নিয়নের আলো দিয়ে বোনা মাকড়সার জালের মাঝে। ভূতুড়ে নিঃসঙ্গতার জ্বরে হাবুডুবু খাই, আমার ঠোঁট আর চোখ যুগপৎ বুঝে ফেলে – আমি বন্দী হয়ে গেছি আপন আঁধারের অলৌকিক কারাগারে। হঠাত জানালার পাশে ছাতিমে শিশিরের ঘ্রাণ পেলে আমার মনে পড়ে মল্লিকার কথা। আহ, মল্লিকা... চন্দ্রমল্লিকা, মল্লিকা আমার ক্লওডিয়া, অতন্দ্রিলা, তার হাস্যে - লাস্যে ঝরে পড়ে কাঠগোলাপের ছায়া। চোখের দীঘিতে পানকৌড়ির স্না্ন। ওড়নার ঢেউয়ে নাচে শীতল হাওয়া, ওড়ে আসমানী মেঘ। আমার ঘুম আসে না, আমার ছয় দেয়াল ক্রমশ সংকোচিত হতে থাকে, ছোট হতে থাকে পরিসর। মল্লিকার গ্রীবার নিশানা নিরূপণ করতে করতে আমি বালিশে সমর্পণ করি আমার বিষাক্ত অভীক চিবুক। কবে কোথাও পরাগরেণুর ঢেউয়ে শুনেছিলাম– জীবন একটা সাইকেলের মত, চলতে না থাকলে ভারসাম্য থাকে না। আমি বুঝি, আমার জীবন চলছে না, অথচ প্যাডেলে পা রেখেই ছয় দেয়ালের মাঝে আমি এক সুনিপুণ ভারসাম্য তৈরি করে চলেছি, অরুন্তুদ, নোংরা, ভ্যাপসা, শ্যাওলা ধরা ছারপোকার মত জঘন্য জীবনের ভারসাম্য ।
পোড়ে সিগারেট, ওড়ে ধোঁয়া আর ধূলো।




সেই যে সুনীলের ‘মনীষার দুই প্রেমিক’ ! শুরুটা ছিল এইরকম “আমি মনীষাকে ভালোবাসি। মনীষা আমাকে ভালোবাসে না। মনীষা অমলকে ভালোবাসে। ব্যাপারটা এরকমই সরল”।

আমার ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকম হলেও আমি টের পাই-আর যাই হোক, ব্যাপারটা সরল না। আমি মল্লিকাকে ভালোবাসি, আমার আঙ্গুল ছিড়ে যেতে চায় মল্লিকার আঙ্গুলের কাছে। মল্লিকার নখের মাঝে আমার নখর, গোলাপী ও ধূসর। বড্ড বেমানান, কিন্তু আমি মল্লিকাকে ভালোবাসি, আমার মত করে ভালোবাসি। মল্লিকা ভালোবাসে ইশতিয়াককে, মল্লিকার মত করে ভালোবাসে। ইশতিয়াক ভালোবাসে মল্লিকাকে, ইশতিয়াকের মত করে ভালোবাসে। ব্যাপারটা সরলতা থেকে সরে আসে ঠিক তখনই, যখন আমার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ইশতিয়াকের কথা চিন্তা করলে। নিশীথে আমার চোখে জ্বলে নিশিত খুনের নিষঙ্গ। আমার লোহিত রক্তকণিকারা আমাকে জানিয়ে দেয়, সুনীলের মত আমার হৃদয় মাহাত্ন্য বোঝে না। সুনীল অমলের হিতাকাংক্ষী ছিলেন। আমার স্যাতস্যাতে ছয়দেয়ালের মত আমার হৃদয়ও সংকীর্ণ। আমি ইশতিয়াকের হিতাকাংক্ষী নই। ইশতিয়াকের কথা আমার প্রশ্নে কিংবা উত্তরে, কানে কিংবা চিন্তায় এলেই আমি ইশতিয়াকের আঙ্গুলের কথা চিন্তা করি, ঐ আঙ্গুলকে আমি মল্লিকার আঙ্গুলের মাঝে লেপ্টে থাকতে দেখেছি। কোন একদিন আমি আঙ্গুলগুলিকে আমার এসট্রের শোপিস বানাবো। আমি জানি, আমার এত ক্ষমতা নেই, আমার সাহস কম, ইশতিয়াকের ব্যক্তিত্ত্বের চাবুকের কাছে আমার চাকু অসহায়। কিন্তু, স্বপ্ন দেখতে আমার ভাল লাগে। গভীর রাতে দীর্ঘশ্বাসের মাঝে আমি ইশতিয়াকের আঙ্গুল ভেসে বেড়াতে দেখি; ছিন্ন। আমার ভাল লাগে।

ব্যাপারটা তাহলে ঐ পর্যন্ত সরল। বসন্তের বিষণ্ণ বাতাস, সবুজ পাতাদের গান, মল্লিকার হাতে রক্তজবা-ইশতিয়াকের দেয়া। নায়ক এবং নায়িকা। ঠোঁটে সিগারেট, হাতে বারুদ হাতে আমি বুঝে যাই, আমি হচ্ছি খলনায়ক। আমি শাল গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে নায়ক ও নায়িকার আঙ্গুল দেখি, রক্তজবার আনন্দ দেখি, তাদের হাসি দেখি, আমার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। একটা হলুদ পাতা আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে, ওর আয়ু ফুরিয়ে গেছে, আমি শ্লেষাত্নক হাসি দেই একটা।
ওড়ে ধোঁয়া আর ধূলো, ধূসর।



ফাল্গুনী বিকেল- মল্লিকাকে একাকী হেঁটে যেতে দেখি সেই রক্তজবার রক্তে স্নাত আসনের পাশ দিয়ে, সেখানে ফুলের সমাধি, কৃষ্ণ বর্ণের, পাংশুটে। মল্লিকার প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে বিকীর্ণ হয় নিরংকুশ অহংকারের দীপ্তি, গ্রীবার মতই স্বাপ্নিক। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে সুড়কি ও পায়ের তালুর মাঝে আমার ভালোবাসা পিষ্ট হচ্ছে কিনা। আমি মল্লিকার চুলের ঘ্রাণ পর্যন্ত পৌঁছে একবার খুব আলতো করে ডাকি – “এই মল্লিকা!!” মল্লিকা পেছনে ফেরে, একটু অবাক হয় – “আরে আজহার যে, কি খবর ??” আমি বুঝতে পারি না, চোখের কোণে আরোপিত কৃত্রিম কাজলের মত বিস্ময়টাও আরোপিত কিনা।

আমার অতন্দ্রিলা, আমার ক্লওডিয়া, আমার ইচ্ছা করে চিৎকার করে উঠতে “একদিন আমি তোমার কাছে পৌঁছব বলে আজও বেঁচে আছি, যেখানে কাল দাঁড়িয়ে পড়ে যেন শকট, তুমি একটু থামো, তোমার দু পায় আমি নুপূর পরাই...অন্ধের মত আঙ্গুল বাড়িয়ে একবার ছুঁয়ে দাও দেখি আমার শরীর, দেখি গা থেকে জমানো ছাই ওড়ে কিনা, নেভে কিনা আগুন...চতুর্দিকে দেববালকের হাতে অনিবার্য বেজে উঠুক হাজার মাদল, তোমার রক্তের মাঝে দশেরার চাঁদ হয়ে খেলা করে যাই...তোমাকে দূর থেকে হাঁটতে দেখলে আমার ইচ্ছে হয় রাস্তায় বুক পেতে দিই, ধূলোয় কেন হাঁটবে, আমার বুকে দাঁড়াও। “

আমি মল্লিকার ঠোঁট শুনতে পাই – “আরে, কি বলবি বল। চুপ হয়ে গেলি কেন ??”

ঠিক সেই সময়ে আমি আকাশের দিকে তাকাই, একটা ভুবনচিলকে উড়ে যেতে দেখি- নির্লিপ্ত, নির্বিকার, নিস্পৃহ, নিশ্চঞ্চল। তার ডানায় পিছলে পড়ে এক পশলা রোদ, ঈষৎ খয়েরী। হঠাৎ ভুবনচিলটাকে আমার কাছে অজস্র ছারপোকা এর সমষ্টি বুঝে বিভ্রান্ত হলে মনে পড়ে, প্রায়শই রাতে বিহ্বল নিয়নের মাঝে আমি নিজেকে ছারপোকা মনে করি। সেইসব নিশীথে আমার চোখে জ্বলে নিশিত খুনের নিষঙ্গ ।
অরুন্তুদ, স্যাতস্যাতে জীবন আমার; ধূসর।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:৪৫
২৯টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×