শেষ অধ্যায় / (প্রথম অংশ)
“খুঁজে দেখো আছে আছে
নির্জনে কি কোনও জনতায়
সেই দুটি প্রতীক্ষার চোখ
যে আকাশ সূর্য্যাতীত
তারই ছায়া পড়া ।”
বসন্তের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে মাত্র । ফাগুনের মাঝামাঝি । লোকে বলে “ভিগি বসন্তী” ভেজা বসন্ত । এতোদিন বসন্তের যে ছবি ধরা ছিলো চোখে, তাতে ছিলো – রংয়ের আভিজাত্য, কৃষ্ণচূড়ার লালে রাঙা সায়াহ্নের আকাশ, টলমলে দিঘীর জল, বিসমিল্লাহ খানের সানাইয়ের মন খালি করে নেয়া সুরের মতো কোকিলের কূহু-কূহু । এ বসন্ত “ভেজা” হয় কি করে ? আজ জেনেছি, ভেজা হয় যে হৃদয়ের ক্ষরনে আদ্র হয়ে । খুব রাতে বেহালার ছড়ে নিষাদের লহরী খেলে গেলে রাত যেমন কান্নায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে আমার এই বসন্ত দিনগুলো যেন তেমন এক কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চাইছে । রংয়ের আভিজাত্য মুছে গেছে আমার বসন্ত থেকে ।
আমার ভেতরে বাইরে ক্ষরন হচ্ছে, আমি বুঝতে দিচ্ছিনে কাউকে । প্রতিদিন সকালে যে রাধাচূঁড়ার রংয়ে আমার আকাশ ভরে উঠতো সে আকাশ এখোন সূর্য্যাতীত । বাতাস কেটে কেটে যে ভালোবাসাটুকু নিরালায় আমার দুপুরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতো তা যেন এক কুহকী স্বপ্নের মতো মনে হয় আজ । যে ফুল-পাখি বন্ধু আমার ছিলো একদিন, তারাও যে আজ হারিয়ে গেছে কোথায় ! এক বৈরী সময় আমার কন্ঠলগ্ন হয়ে আছে এখোন ।
বুঝতে পারি এভাবে আমার চলবেনা । ফিরে যেতে হবে সেই পুরোনো নিরাপদ ঘাটে যেখান থেকে একদিন ভয়ঙ্কর এক আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে গেলেও যে আশ্রয়ের দেখা আমার মেলেনি । তাই কাজের মধ্যে ডুবে থাকাটাকেই বেশী আপন বলে মনে হলো । একটি পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেলে যে আর একটি পৃথিবী স্থির করে নিতে হয় । আমি সেই আর এক পৃথিবীর খোঁজে বেড়িয়েছি । যেতে যেতে যেতে......... যেতে যেতে যেতে... দেখি তারা ভরা আকাশের তলে একটি চাঁদ জেগে আছে । আমারই গায়ে জোৎস্না ঢেলে সে যেন বলে যায় চুপি চুপি – আমি আছি ।
চাঁদের সাথে মানুষের আলাদা এক সখ্যতা আছে । বালূময় গর্তে ভরা, তেষ্টার জলও নেই যেখানে, তেমন কিছুর জন্যে কেন যে মানুষের মনে কারুকার্য্যময় ভালোলাগা জেগে ওঠে ! ধরা দেয়না, ছোঁয়া যায়না বলেই কি !
শীলা কি তাই আমাকে লিখেছিলো, “সাম রিজনস মেক রিলেশানশীপ প্রেশ্যাস, বাট অনলি প্রেশ্যাস রিলেশানশীপ আর মেড উইথ নো রিজনস” ? আমি এই কথাটুকু আগলে বসে থাকি যক্ষের মতো । আর কথা দেয়া কথা রাখতে গিয়ে নিয়মিত ভাবেই অনিয়মিত তাকে লিখি, ছবি পাঠাই । ভুল হয়না । ঢিল ছোড়া জলে একদিন যে আলোড়ন উঠেছিলো তা শান্ত হয়েছে কিন্তু কাঁপনের রেশটুকু রয়ে গেছে যে।
আমার ঘর-সংসার আগলে থাকি আগের মতোই, একটুও টোল খায়না কোথাও । শুধু মাঝে মাঝে একান্ত নির্জনে বসে ফেলে আসা দুদন্ড শান্তির দিন ক’টির কথা ভেবে ভেবে উদাস হয়ে উঠি । আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হয় । রোজকার দিনলিপির একঘেয়েমী ছবির সাথে মিশে যেতে হয় । এর নামই জীবন ।
সে জীবনের আলপথ বেয়ে কেটে যায় দিনগুলো রোজ যেমন যায় । তার দুধারে ছড়িয়ে থাকে সোনালী গমের ক্ষেত, আগাছার জঙ্গল পাশাপাশি । ফুল্লরাকে নিয়ে বের হই , ছেলেমেয়েকে নিয়ে হৈহৈ করি সময় পেলে । ক্ষুন্নিবৃত্তির যোগাড় যন্ত্রের কাজে কামাই দিইনে, আগের মতোই ব্যস্ত হয়ে থাকি । কেবল মাঝে মাঝে মোবাইলে আসা এসএমএস এর মৃদু শব্দে চমকে উঠি । একটা মুখ মনে পড়ে । হৃদয়ের গোপন বাগান থেকে তার উঠে আসা সুবাস ঘিরে রাখে আমাকে । স্ক্রীনে সে মুখটাকে বড় করে তুলি । শুধু দেখি, চোখে চোখ রাখি । সাগরের নীল সেখানে মাখা । জমার খাতায় হারানোর মতো একখানা সম্বল । তাকে মনে রেখে দিনলিপির কিছু সময় তার সাথে ভাগাভাগি করতে মেইল লিখতে বসি, যে মেইলের উত্তর ফিরে আসবেনা কখোনও জানি ।
অফিসের মিটিং শেষ হলো মাত্র । নিজের ঘেরাটোপে ফিরে এলে চা’য়ের তেষ্টা পায় খুব । লাঞ্চের সময় কাছে চলে আসতে থাকে ধীরপায়ে তবুও চা’টা না খেলেই নয় । বদভ্যাস সন্দেহ নেই । সারাদিনে অনেক কাপ চা খা্ই আমি । সাথে সিগ্রেট । শীলা একদিন বলেছিলো, তুমি খুব সিগ্রেট খাও, না ?
বললাম, কি করে বুঝলে ?
-ছবিতে তোমার ঠোট দেখে ।
আমার প্রোফাইলের অনেক ছবির ভেতর থেকে একখানাকে দেখে যে বলে দিতে পারে ছবির মানুষটি সিগ্রেট খায় কি খায়না, সে কেন আসল মানুষটাকে বুঝে উঠতে পারলোনা !
চায়ের কাপে ঠোট ছোঁয়াতে যাবো, মোবাইলটা বেজে উঠলো । অপরিচিত নাম্বার । অপরিচিত নাম্বারে এ মূহুর্তে আমার আগ্রহ নেই । ধরবো কি ধরবোনা ভাবছি । চা সিগ্রেট এর আমেজটা কেটে যাবে । মোবাইলটা বেজেই যাচ্ছে । অনেকক্ষন পরে ধরতে হাত বাড়িয়েছি, চুপ হয়ে গেলো মোবাইল । খানিক পড়েই আবার, একই নম্বর । গরজ বেশী বোঝা যাচ্ছে ।
মোবাইল হাতে তুলি - হ্যালোওওও......
উত্তরে ওপার থেকে যে হ্যালো শব্দটি ভেসে এলো তা যেন নুপুরের রিনিঝিনির মতো বেজে উঠলো কানে ।
-কাকে চাচ্ছেন ? শুধাই ।
আমার নামটি উচ্চারিত হলো আরো টুংঠাং শব্দে - ......... উনি আছেন ?
- জ্বী, বলছি । আপনি কে বলছেন ?
- আমি নভেরা বলছি ।
- জ্বী, বলুন ।
- আপনি শীলা নামের কাউকে চেনেন ?
সরাসরি বুকের ভেতর কোথা্ও হাতুড়ীর ঘা পড়লো যেন । খুব গভীর গোপনে যে নামখানি লেখা আছে হৃদয়ে সে নামখানি নভেরা নামের ফোনের ওপাশের কেউ একজন তুলে আনলো কি করে ! সহসা উত্তর জোগালো না মুখে । আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলাম ।
-কি, বললেন না চেনেন কিনা ?
বাঁচতে চেষ্টা করি – কোন শীলার কথা বলছেন ? অনেক শীলা-ই তো আছে !
-মিথ্যে বলছেন কেন ? আপনি তো একজন শীলাকেই চেনেন পৃথিবীতে।
ধাক্কা লাগে খুব – আপনি কি করে জানলেন আমার পৃথিবীতে একজন শীলাই আছে ? আপনি যে শীলার কথা বলছেন হয়তো তাকে চিনি আমি । তার আগে বলুন, এই নামটি আপনি কোথায় পেলেন ? আর আমার নাম্বারটিই বা জানলেন কি করে ? বলেই বুঝলাম কিছুটা বোকামী করে ফেলেছি । যে আমার নাম্বার জানে, জানে শীলার কথাও সে তো শীলার কাছাকাছি কেউ হবে এমোনটা বুঝে উঠতে পারিনি কেন আগে । ভীষন অপ্রত্যাশিত ভাবে ব্যাপারটি ঘটে গেল বলে হয়তো ।
-নাম্বারটি পেয়েছি শীলাকে পাঠানো আপনার মেসেজ থেকে । আপনার মেইল এ্যাড্রেস ও জানি । মেইল করিনি কারন ব্যাপারটি জরুরী আর ব্যক্তিগত ।
শেষের বাক্যটি মাথায় অনেক প্রশ্নের জট বাঁধিয়ে তুললো । এ অপরিচিতা কে, আমি জানিনে । অথচ সে আমার লুকানো সবকিছু জেনে বসে আছে । কি চায় সে ? এ আবার শীলার কোনও নতুন খেলা নয়তো ? মেলাতে পারছিনে । যে আমাকে আড়ালে আড়ালে রেখেছে এতোদিন, লিখেছে – পৃথিবীর কাউকে জানাবেনা তোমার আমার কথা কারন আমাদের দু’জনারই সামাজিক কিছু বাঁধা আছে ; আজ এতোদিন পরে সে কেন আমাকে উলঙ্গ করে দেবে পৃথিবীর কাছে ! কেন বা নিজেকেই ! উৎসুক হয়ে থাকি ওধার থেকে আর কি কথা ভেসে আসে ভেবে । আমাকে নিশ্চুপ দেখে আবারো একটা ঝর্না যেন হেসে ওঠে – কি চুপ করে আছেন কেন ? খুব ভয় পাইয়ে দিলাম ? ভয় নেই, আমি আপনার শত্রু নই ।
-না, ভয় পাবো কেন ? আপনি হয়তো আমার সম্পর্কে গোপন অনেক কিছু জানেন কিন্তু তাতে আমার ভয় পাবার কিছুই নেই কারন তাতে মিথ্যে কিছুই নেই । জানতে পারি, আপনি শীলার কে হন ?
-আমি শীলার কিছু হইনে । আবার অনেক কিছু ।
ধাঁধায় পড়ে যাই । আগাগোড়া ব্যাপারটাই আমার কাছে প্রচন্ড রকমের অপ্রত্যাশিত, স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে । এ আবার কোন খেলায় জড়াতে যাচ্ছি আমি ! । আসল কথাটি জানতে উৎকন্ঠিত হয়ে উঠি – তা আপনি বলছিলেন ব্যাপারটি আপনার ব্যক্তিগত । জানতে পারি কি সেটি ?
মিষ্টি হাসির একটা তরঙ্গ উঠলো ওধার থেকে – জানতে পারেন তবে এখোন নয় ।
-তবে এখোন ফোন করলেন কেন ?
-আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ... । এবার হাসি নয় ঝর্না যেন শুধু নিঃশব্দে গড়িয়ে গেলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে ।
কথার স্বরে কোথাও যেন একটা অন্য রকম সুর । এতোক্ষনে সাহস বেড়েছে । স্বভাবসুলভ সহজ হয়ে উঠি – হাসালেন । আমাকে দেখে আপনি কি করবেন ? দেখে ভালো লাগবেনা আপনার । আশাহত হবেন । আর আপনি কি খুবই নিঃশ্চিত এ ব্যাপারে ?
-দেখুন, আমি আপনার চেহারা দেখতে চাইনি, আপনাকে দেখতে চাইছি শুধু । ফিরিয়ে দেবেন ?
কঠিন প্রশ্ন । এ ভদ্রমহিলাকে আমি জানিনে, চিনিনে । কাউকে ফিরিয়ে দিতে আমার খুব ভয় । আমার কি করা উচিৎ ? কঠিন হবো ? শীলাকে জানার এই একমাত্র সূত্রটুকু আমার হাতে আচানক এসে পড়েছে । এ সুযোগটি হারিয়ে ফেললে যে শীলার হারিয়ে যাওয়ার রহস্যটুকু আমার আর জানা হবেনা । উচিৎ হবে কি !
-আচ্ছা আমাকে একটু ভেবে দেখতে সময় দিন ।
-বুঝতে পারছি আপনি ভয় পাচ্ছেন । কিন্তু আমার যে সময় নেই । আমি যে এ পৃথিবীতে দুদিনের অতিথি ।
ভয়ঙ্কর ভাবে কেঁপে উঠলো মুঠোফোন ধরা হাতখানি । দুলে উঠলো আমার পৃথিবী । সারা শরীরের রক্ত যেন থমকে গেলো মূহুর্তে । ভুল শুনিনি তো ? আরো একজন বলেছিলো একই কথা । তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বিদ্যুত খেলে গেলো । কান্নার একটা শিরশিরানি বয়ে গেলো শরীরময় । একদিন আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এসেছিলো এমনি একটি কথা শুনে । আজ আবার আর একজনের মুখে আমাকে তা শুনতে হলো । কান্না আমাকে ছাড়ছেনা কেন ।
ওপাশ নিথর হয়ে আছে । খুব ভয় হল, শীলার কিছু হয়নি তো ! যে মুখখানির মায়াময় ভালোবাসায় আটকে গেছি আমি, আজো যে মুখখানির কথা ভেবে ভেবে আমি আনমনে তাকেই লিখি; সেই মুখখানি চিরতরে হারিয়ে ফেলার মতো কিছু শুনবো এমোন আশংকায় উতলা হই !ওধারে শুধু নিঃশব্দ খেলা করে ।
-নভেরা, আপনি আছেন ? শুনুন নভেরা, ফোন ছেড়ে দেবেন না । বলুন কোথায় দেখা করতে চান ?
-ঠিক বলছেন তো ? কবে আপনার সময় হবে ?
-আপনি যে কথাটি বললেন এইমাত্র, তা যদি সত্য হয় তবে এই মূহুর্তে আমি দেখা করতে রাজী যদি সম্ভব হয় এবং আপনার কোনও অসুবিধে না থাকে ।
ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এলো মনে হলো । অপেক্ষা করছি । মনে হলো অনন্তকাল ।
-আগামী শুক্রবারে আপনার সময় হবে কি ?
-আপনার জন্যে আমার সময়ের কোনও অভাব নেই । কোথায় ? কখন ?
-আপনি বলুন কোথায় হলে ভালো হয় । নিরিবিলি হওয়া চাই । সময়টা আপনিই ঠিক করুন ।
দোটানায় পড়ে যাই । শীলার কাছের লোক সন্দেহ নেই, মিষ্টি গলার স্বর সুন্দরী নিশ্চয়ই তার উপরে তার সাথে আমার কথপোকথনের মেজাজ মিলিয়ে অপরিচিত এই জনের যোগ্য সমাদর কোথায় হলে ভালো হয় ঠিক করতে সময় লাগে । সাথে নিরিবিলি শব্দটিও মাথায় রাখতে হয় । কি বলতে চায় কে জানে !
-জ্বী, আমি আসবো । আশা করি আপনি ভুলে যাবেন না ।
-আপনি আমার মেইলের কথা বলেছেন । তাহলে আপনি নিশ্চয়ই জেনে গেছেন আমি কিছুই ভুলিনে ।
গলায় গম্ভীরতা স্পষ্ট করে তুলি । ওপাশ থেকে হাসি ঝড়িয়ে উত্তর আসে – আপনি বেশ মজার লোক তো, সিরিয়াস হচ্ছেন কেন ?
-না, আমি সিরিয়াস নই । যা সত্য তা ই বললাম ।
-বেশ মেনে নিচ্ছি । দেখা হচ্ছে ঠিক তো ? আর শুনুন…. না থাক । বাই…
ওপাশ থেকে লাইনটি কেটে দেয়া হলো যেমনই হঠাৎ করে এসেছিলো তেমনি হঠাৎ করেই । সিগ্রেট নিভে গেছে, টান দিতে ভুলে গেছি । লম্বা ছাইটুকু খসে পড়লো টেবিলে । যা ঘটে গেলো তার বিমূঢ়তায় নিভে যাওয়া সিগ্রেটের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষন । ঘোর কাটলে ফুঁ দিয়ে ছাইটুকু উড়িয়ে দিলাম । ছড়িয়ে পড়লো তা টেবিল জুড়ে । কেবল ঘটনাটি জুড়ে বসে থা্কলো মনের গভীরে ।
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
অষ্টম অধ্যায় / (শেষ অংশ)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১০:০০