নৈঃস্বর্গের মৃত্যু উপত্যকা ....
( ডিজিটাল ভ্রমন..... ছবি আর লেখায় / শেষ পর্ব )
গনগনে আগুনের মতো হল্কা গায়ে মেখে এতোক্ষন ডেথভ্যালীর পথে চলতে চলতে ক্লান্ত ? শুধু বালু আর লবন দেখে দেখে হাপিয়ে উঠেছেন ? একটু বিশ্রামের জন্যে রাতের আঁধার নেমে আসার প্রতীক্ষায় ?
তবে দিনের শেষে রাতের আঁধার যখন নেমে আসবে গুটিগুটি পায়ে, তখন সেই প্রশান্ত নিরবতার মাঝে খানিকটা বিশ্রাম খুঁজতে গিয়ে যদি মন কেমন করে তবে তাকান আকাশের দিকে । দেখবেন, এ হলো সেই আকাশ যেখানে ঝর্নার মতো উল্কাপাত অন্ধকার চিরে আপনার চোখে মাখিয়ে দেবে মুগ্ধতা । পৃথিবীর তৃতীয় সর্ববৃহৎ গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশটা এখানেই, যার নীচে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি । তাই ডেথভ্যালীতে রাতের জনপদে আলোর রোশনাই চোখে পড়বেনা আপনার । রাত যেন এখানে অন্ধকারে মুখ ঢেকেপড়ে থাকে সারা রাত । একখানা চাদর আর একটি চেয়ার টেনে এনে বসে পড়ুন খোলা আকাশের নীচে । খসে খসে পড়া উল্কার ঝর্নার দিকে তাকিয়ে সশ্রদ্ধ সম্ভ্রমের সাথে অনুভব করুন , এই আকাশের তলে কতো ক্ষুদ্র আপনি !
কোন খসে পড়া তারা
মোর প্রানে এসে খুলে দিলো আজ
সুরের অশ্রুধারা । (রবীন্দ্রনাথ )
ছবি --------- ডেথভ্যালীর ইউরেকা ডিউনস এর আকাশে উল্কার মেলা ( মিটিওর শাওয়ার ) ।
সব রাতেই উল্কার মেলা দেখতে না পেলেও আপনার মাথার উপর ডেথভ্যালীর রাতের আকাশের গায়ে লেগে থাকা ছায়াপথ আপনাকে সঙ্গ দেবেই । হাযার কোটি নক্ষত্র দিয়ে পুঁতির মালার মতো আকাশের কন্ঠলগ্ন হয়ে আছে যেন । আর তা আপনাকে করে তুলতে পারে আনমনা । মনের ভেতরে গুনগুন করে বেজে উঠতে পারে সেই চেনা সুর –
নিদ নাহি আঁখিপাতে …. তুমিও একাকী আমিও একাকী, আজি এই মাধবী রাতে …..।
ছবি -------- ডেথভ্যালীর রেসট্রাক প্লায়ার আকাশে ছায়াপথ ( মিল্কিওয়ে )।
ছবি - -------ব্যাডওয়াটার বেসিনের আকাশে রাত সাড়ে তিনটের ছায়াপথ । নিঃসীম একাকী ।
মকর’ক্রান্তির রাত অন্তহীন তারায় নবীন
- তবুও তা পৃথিবীর নয়:
এখন গভীর রাত, হে কালপুরুষ,
তবু পৃথিবীর মনে হয় । ( জীবনানন্দ দাশ )
ছবি ------- ব্যাডওয়াটার বেসিনে গোধুলি বেলায় ওরিয়ন বা কালপুরুষ ।
প্রতি শীত আর বসন্তের মৌসুমে এই মৃত্যু উপত্যকায় জমে ওঠে “নিশীথ রাতের আকাশ” প্রোগ্রাম । ডেথভ্যালী এ্যাষ্ট্রোনমি অর্গানাইজেশানের তত্ত্বাবধানে আপনিও দেখতে পারেন মৃত্যু উপত্যকার শ্বাসরূদ্ধকর রাতের আকাশ ।
একাকী নিঃসাড় পড়ে থাকা ক্লান্ত মৃত্যু উপত্যকায় যখন গোধুলির আমেজ নেমে আসে তার সাথে নেমে আসে ওরিয়ন কনষ্টিলেশান যাকে আপনি চেনেন “কালপুরুষ” বলে । সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনার মনে হবে পায়ের কাছে নেমে এসেছে যেন সে আকাশ । জীবনান্দের মতো আপনারও মনে হবে – এ আকাশ পৃথিবীর নয় তবুও যেন পৃথিবীর ..........
ছবি - ------- সন্ধ্যার ডেথভ্যালী ।
পৃথিবী যখন ক্রমে ক্রমে নিঝুম হয়ে আসবে , শ্রান্তি যখন ধীরে পায়ে হেটে আসবে কাছে তখন আকাশ সিন্ধুর এই রক্তিম উল্লাস আপনার মনের গহীন কোনে বাজাবে করুন অন্তরাগের বাঁশি । মনে পড়বে কি কারো কথা ?
তাই যদি মন কেমন করে তবে পরের দিন সিয়েরা নেভাদা পর্বতশ্রেনীর ঢাল বেয়ে ঘুরে আসুন । যে সিয়েরা নেভাদার ঢাল একদিন মুখরিত ছিলো সোনা সন্ধানী মানুষের ভীড়ে আজ তা পড়ে আছে শুনশান। আপনার পায়ের শব্দে তা আবার মুখরিত হয়ে উঠুক ।
ছবি -------- নেভাদা পর্বতশ্রেনীর ঢাল ।
সন্ধ্যা আসে , ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল । না, কোনও চিল বা পাখির দেখা আপনি পাবেন না এখানের আকাশে । কোনও পাখি, অসীম আকাশ ছেড়ে ধরা দিয়ে যাবেনা আপনার সোনার খাঁচায় । পাবেন শুধু দিগন্তের করুন নিঃশ্বাস । উত্তপ্ত বালুর আঁচল উড়িয়ে দিনান্তের বাতাস বয়ে যাবে শুধু ।
যে পাখি ডেথভ্যালীর অন্য কোথাও আপনার চোখে ধরা দিয়ে যাবে তা শুধু রোড রানার । সারা বছর ধরে আপনি এদেরই দেখতে পাবেন ।
ছবি------- রোড রানার ।
ছবি -------দিনান্তের শেষে পড়ে থাকা মেসক্যুইট ডিউন ।
হাইওয়ে ১৯০ ধরে ষ্টোভপাইপ ওয়েল এর কাছাকাছি গেলেই আপনি দেখবেন মেসক্যুইট ভ্যালীর আর এক রূপ । ঢেউ খেলানো বালির সাগর । যেন -
বায়ুর ঘোড়ার পায়ে কে যে পড়িয়ে গেছে নাল ........ তাই স্তব্ধ বাতসে শুধু থমকে আছে কাল !
ছবি - ----- “চাক হ্যানে” মেসক্যুইট ফ্লাট ডিউনস
গানের সুরের মতো বিকালের দিকের বাতাসে
পৃথিবীর পথ ছেড়ে - সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে
হৃদয় ভাসিয়া যায়, সেখানে সে কারে ভালোবাসে ! ( জীবনানন্দ দাশ )
ছবি - ------ ফার্নেস ক্রীক ডিউন .... সন্ধ্যার মেঘের রঙ খুঁজে ফেরা বালিয়ারী ।
সেদিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যা
আর এমনি মায়াবী রাত মিলে .....
ছবি - ----- নিঃসর্গের দিকে দিকে ডুবে গেলে সব কোলাহল -------
অতি দুর আকাশের মুখ হতে আসি
নবীন চাঁদ তার কনক আলোয় ভাসি
পোড়াইল মোরে ।
একাকী বিজন দেশে কবেকার
নিশীথ রাত করে হাহাকার
শুধু জড়ায়ে ধরে ।( নিজস্ব )
সুদুর্গম দূরদেশ –
পথশুন্য তরুশুন্য প্রান্তর অশেষ
মহাপিপাসার রঙভূমি ; রৌদ্রালোকে
জ্বলন্ত বালুকারাশি সূচি বিঁধে চোখে;
দিগন্তবিস্তৃত যেন ধূলিশয্যা পরে
জরাতুরা বসুন্ধরা লুটাইছে পড়ে ........ (রবীন্দ্রনাথ )
ছবি ------- ভাঙা দেউলের দেবতা ... মনুমেন্ট ভ্যালী ।
দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার ........
নীলিমার থেকে কিছু নীচে ...... মানুষীর ঘুমের মতোন শুয়ে আছে জাবিরিস্কি পয়েন্ট । এখানের মাটিতে , পাথরে পাথরে রঙের খেলা । মনে হবে কোন চিত্রকর তার রঙের প্যালেট যেন এইমাত্র ফেলে রেখে হারিয়ে গেছে কোথাও । আপনারও এখানে হারিয়ে যেতে নেই মানা । এখানে যদি এসেই পড়েন তবে এর ডানদিক দিয়ে যে ট্রেইলটি গেছে গোল্ডেন ক্যানিয়নের দিকে সেদিকে একঘন্টার পথে হাইকিং করে ঘুরে আসতে পারেন । হাইকিং করতে করতে দেখে নিতে পারবেন নীচে পড়ে থাকা আদিগন্ত নৈঃস্বর্গের রূপ ।
ছবি-------- শুয়ে থাকা অনুপম জাবিরিস্কি পয়েন্ট ।
ছবি ---- পাথরে রঙের মেলা ......... জাবিরিস্কি পয়েন্ট ।
ছবি - ------ গোল্ডেন ক্যানিয়ন । হারিয়ে যেতে নেই মানা .......
পাথরেও ফোঁটে ফুল .......
বছরের বারোটা মাসই যেখানে তীব্র দাবদাহ বিরাজিত সেখানে খানিকটা জল-ই ভালোবাসার পরশে জাগিয়ে দিতে পারে প্রানের স্পন্দন । ডেথভ্যালী যে শুধু মৃত্যুই ছড়ায় তা নয়, এখানেও যে আছে জীবনের রঙ ছড়ানোর গল্প। খানিকটা বৃষ্টির জল পেলেই এখানে যে পাপড়ি মেলে চোখ ধাঁধানো লক্ষকোটি ফুল । ঘুরে ঘুরে মরে প্রজাপতি । প্রকৃতির বৈরী আহাওয়া, আর পাথুরে মাটির ভেতরেও তাই আপনি এখানে পাবেন ১০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ । পথে যেতে যেতে নয়ন ভরে দেখুন প্রকৃতির এমন লীলাখেলা ..........
ছবি - -------- নৈঃস্বর্গের মৃত্যু উপত্যকা ....
ডেথভ্যালীতে এতোক্ষন যে ডিজিটাল ভ্রমন করে এলেন তা পূর্ণ হবেনা যদি, প্রকৃতির অদ্ভুত এই লীলাটিকে দেখে না আসেন । চলন্ত পাথর । কেউ কোথাও নেই হঠাৎ চলতে শুরু করে দিয়েছে একখন্ড পাথর । ভুত দেখার মতো চমকে উঠবেন হয়তো । ভুরুউউউউউউউউম ..............ভুরু্উউউউউউম পাথর ছুটছে জনমানবহীন এক প্রান্তরের বুকে । রেসট্রাক প্লায়াতে ( মরুময় বেসিনের সমতল মেঝে যার তলদেশে পানি অনিষ্কাশিত রয়ে গেছে ) আপনি দেখতে পাবেন এই উদ্ভুতুরে কান্ড ।
ছবি - ------ ভুতুড়ে পাথর .......
ডেথভ্যালীর একপ্রান্তে কটনউড আর লাষ্ট চান্স রেঞ্জের মাঝখানে পড়ে আছে চোখ ধাঁধানো রুপ নিয়ে এই রহস্যময় রেসট্রাক প্লায়া । ভাগ্য ভালো না হলে আর আপনার পেছনে ভুত না পড়লে এমন সৃষ্টিছাড়া কান্ড আপনি দেখতে পাবেন না । তবে আপনি ডেথভ্যালীতে অনেক “সেইলিং ষ্টোন” উপরের ছবির মতোই পড়ে থাকতে দেখবেন ।
বেশ কয়েক পাউন্ড ওজনের পাথর কি করে অদৃশ্য কারো টানে হঠাৎ হঠাৎ সাই করে ছুটে যায় মিটার খানেক পথ তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই সেই ১৯৪০ সাল থেকে যখন থেকে ভাগ্যান্বেষী মানুষ আসতে শুরু করে এখানে । তাহলে কি ভুতেদের খেলা ? অশরীরি কিছু ? জবাব মেলেনি দীর্ঘদিন । মানুষ শুধু অবাক হয়ে তাকিয় তাকিয়ে দেখে গেছে এমন আজব কান্ড ।
এই ভুতুড়ে পাথর গুলোর পেছনে লেগে রইলো একদল লোক । বছরের পর বছর ধরে এই তথ্য সেই তথ্যের জন্ম হলো । ধোঁপে টিকলো না একটাও । অনেক দিন ধরে বিশেষ কিছু নাছোড়বান্দা লোকেরা রিমোট ওয়েদার মনিটর , উন্নত মানের টাইম ল্যাপস ক্যামেরা , আর পাথরের গায়ে সেঁটে দেয়া GPS ডিভাইস নিয়ে বসে থেকেছে পাথর ঠেলা ভুতেদের ধরতে । ভুতেরা আর আসেনা । দিনগুলো যায় দিনের মতো । পাথর তো আর নড়েনা ! মাত্র এই সেদিন ২০১৪ সালের অগাষ্ট মাসে প্রকাশিত PLOS One ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলো ভুতেদের আসল চেহারা । ঐ নাছোড়বান্দা লোকেরা যাদের আপনি বলবেন সায়েন্টিষ্ট, রিসার্চার তারা একদিন দেখলেন পাথর নড়ছে । ২০১৩ সালের ডিসেম্ভরের ২০ তারিখে ৬০টির ও বেশী পাথর ছুটে গেলো কয়েক মিটার । কিছু GPS ডিভাইস লাগানো পাথরও ছুটে গেলো তাদের সাথে । ২০১৪ সালের জানুয়ারীর মধ্যে ২২৪ মিটার পথ ভৌতিক ভাবে পেড়িয়ে গেলো পাথরগুলো ।
ব্যস, শুরু হয়ে গেলো অংক কষা ।
ছবি -------- নাছোড়বান্দা একজন টাইম ল্যাপস ক্যামেরা নিয়ে .......
আগের থিয়রী, বাতাসের ধাক্কায় চলছে পাথরগুলো অথবা পুরু বরফের ভাসমান চাঁইয়ের উপর থাকা পাথরগুলোই চলছে তা বাতিল হয়ে গেলো । রিসার্চাররা বললেন, ভৌতিক কিছু নেই এখানে । প্লায়ার ( মনে আছে তো প্লায়া কাকে বলে ? ) উপরের স্তরে জমে থাকা বরফের ৩ থেকে ৬ মিলিমিটার মাত্র পুরু , কাঁচের মতো স্বচ্ছ বরফের কয়েক মিটার লম্বা এক একটা ফালি মধ্য সকালের রোদে গলতে শুরু করে দেয় । আর সেকেন্ডে ৪ থেকে ৫ মিটার বেগে চলা বাতাসের হাল্কা ধাক্কাতেই প্লায়ার মেঝে থেকে সে বরফের ফালি খসে যায় । প্লায়ার মেঝেতে থাকা অনিষ্কাশিত পানির ধারার উপর দিয়ে চলতে থাকে তা । সারফেস টেনশানের কারনেই এই ফালিগুলোর উপরে থাকা পাথর খন্ডও চলতে থাকে ধীরে ধীরে । বাতাসের বেগ আর গতিপথের সাথে সাথে চলতে থাকা পাথরগুলোকে তখন ভুতুড়ে মনে হয় সাধারন লোকের চোখে । মনে হবে আপনার চোখেও ।
ভুতের ভয় নেই কার ? কখন ঘাড় মটকে দেয় ! অনেক ঘোরা হলো তাই এখন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়াই ভালো।
এখন যাবার আগে আপনিও কি শুরুর কাহিনীর “বেনেট আরকান” পরিবারের কারো মতো বলে যেতে চান -
“গুডবাই ডেথভ্যালী” ?
ছবি, তথ্য ও সূত্র – ইন্টারনেট ।
প্রথম পর্ব দেখুন - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:১২