মেলা দিন হয় ঝিঝি পোকার ডাক শোনা হয় না। কোনো পূর্নিমার রাতে, শুনশান কোনো নদীর তীরে বসে ঝিঝি পোকার ডাক শোনার ইচ্ছে। সাথে সাথী ওই চা। মাথায় ঢুকে গেছে ব্যাপারটা। কিন্তু এই কোলাহোলের শহরে ঝিঝি পোকাতো সেই কবেই তার পাট চুকিয়ে চলে গেছে আর চাদের আলো তো অই অট্রালিকায় না হয় ল্যাম্পপোস্টের আলোর কাছে আটকে গেছে। হোসেনের যেন একবুক তৃষ্ণা, তার চাই চাদের আলো আর পোকার ডাক। সন্ধ্যার পর পর ই বেড়িয়ে হাটতে শুরু করেছে। শহর পেড়িয়ে খানিকটা গ্রাম গ্রাম। শহুরে বিদ্যুৎ এখানে পৌছে গেছে। তার ই বদৌলতে টং এর দোকান গুলিতে টিভি শোভা পাচ্ছে। গ্রাম্য মানুষের সেই টিভিতেই চোখ। নিজেদের সাথে কথা পর্যন্ত নেই। চা খাবার পিপাসা থাকলেও ওই টিভির জন্য দোকানে দাড়ালো না। তার চাই নির্জনতা।
নির্জনতা তো কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, সে তার মত। তাকে পেতে চাইলে তার মত করে খুজে নিতে হবে। এখন চাইলাম, এভাবে চাইলাম আর পেয়ে গেলাম তা নয়। তাছাড়া সহজলভ্য জিনিসের গভীরতা কম। ওজনদার প্রকৃতিকে পেতে চাইলে তাকে খুজতে হবে।
পূর্নিমার সময় নয় এখন, হয়ত আরো ২/৩ দিন হোতো। তবে আকাশে যে চাঁদ আছে তাতে মন ভরবে। এলাকাটায় বন জংগল কম। দুপাশে চাষের জমি, মাঝে পুকুর আর বাগান। ঘন বা খানিক জংগলের মত হোলেও চলবে। গাছের সান্যিধ্যে খানিক সময়। তাও অনেকক্ষন হয়েছে হোসেন হাটছে। পিচ ঢালা পথ নয়, গ্রামের মেঠো পথ। এ গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে পূণর্ভবা নদী। তার কাছাকাছি ই থাকতে চাইছে মনে মনে। ক্ষুধা বোধ হচ্ছে। গ্রাম এই সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেছে প্রায় শহরের মাঝরাতের মত আমেজ। এখানে কি আর হোটেল পাওয়া যায়।
কিছু দূরের ছনের চালের একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। হোসেন খানিটা এগিয়ে গেল। মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে আগুন জ্বালান দিচ্ছে এক বধূ। বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়াতে গৃহস্তের পোষা কুকুর তেড়ে আসল।
বউটি হারিকেন নিয়ে বেড়িয়ে আসতেই, জিজ্ঞেস করল
-কে আপনি, কি চান ?
হোসেন খানিক বিব্রত হয়ে পানি চাইল শুধু। বধূটি আপাদমস্তক দেখল হোসেন কে। বলল আপনি তো এ গ্রামের না। কোথায় যাবে? পথ ভূল করেছে কিনা জানতে চাইলে , হোসেন শুধু বলল মিয়া বাড়ির দিকে যাবে। বধূটি রাস্তা দেখিয়ে দিল, তার আগে এক গ্লাস পানি আর একটা বাটি তে খানিক মুড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করে নিল। গ্রামের এই বিষয়টা হোসেন কে খুব টানে। এই অকৃত্রিম আন্তরিকতা। মুড়ি মন না ভরালেও পেট ঠিক ই ভরায়। আবার যাত্রা শুরু।
আকাশের দিকে খানিক মেঘ। চাদের দেখা মাঝে মাঝে যাচ্ছে কি যাচ্ছে না। পথিমধ্যে এক জায়গায় ঝি ঝি পোকার ডাক শুনেছিল। এরপর অনেক সময় পেড়িয়ে গেছে ডাক আর শোনা যায়নি।
পূণর্ভবার সামনে, খানিক ঝোপঝাড়। স্রোতের শব্দ শোনা যায়। চারিদিক নিস্তব্ধ। খানিক বাদে বাদে কিছু ইঞ্জিন নৌকা নীরবতা কে চূড়মার করে চলে যাচ্ছে। স্রোতের পাড় ভাঙ্গার আওয়াজ ভেসে আসে। চাদের আলো মেঘে ঢাকা। বাতাসও যেন আজ অভিমান করে আর বইছে না। নেই কোনো ঝি ঝি পোকার আওয়াজ। নীরবতার মাঝে যেন শীতলতা।
খোকা!
চমকে উঠে হোসেন
বৃদ্ধা!
-কিছু খুজে ফিরছিস কি?
- হ্যা
- যা ভেবেছিলি তা হয়নি
- না
- যেমন করে চেয়েছিলি তেমন করে পাসনি?
- না
- যা পেয়েছিস তাতে খারাপ লাগছে?
- হ্যা
- শোন
- বলো
- দেখ কি সুন্দর জোস্ননা, ওই শোন ঝি ঝি ডাক, অনুভব কর নদীর পাড়ের বাতাস
- কোথায়, পাচ্ছি না তো কিছুই
- পাবার মত করে কি আদৌ চেয়েছিলি?
- চায়নি কি?
- নিজের মত করে চাইলেই কি হয়? প্রকৃতির অংশ তুই। তার কাছ থেকে চাইলে তার মত করে নিজেকে সপে হবে রে বোকা। তোর জীবনের যে বৃত্ত তা থেকে বেরিয়ে এসে অনুভব করতে হবে। সীমাবদ্ধতা কে জানতে শেখ।
- কিভাবে ? তাই ই তো চাই যা ভালোবাসি
- শুধুই ভালোবাসা যথেষ্ঠ নয়। মন কে মুক্ত কর, জঞ্জালভরা ওই হৃদয় নিয়ে, চোখ চাদের আলো দেখবে না, মন মাতাল হাওয়ায় মাতবে না, ঝি ঝি পোকার ডাকে শিহরন জাগবে না রে।
হোসেন চুপ করে থাকে। অনেকক্ষন চুপ করে থাকে। সময় পেড়িয়ে যায়। রাত যত ফুরোয়। প্রভাত তত এগিয়ে আসে। একসময় ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়, আকাশের মেঘ সরে শেষ রাতের চাঁদ খানিক উকি দেয়। হুট করে কোথা থেকে ঝি ঝি ডেকে ওঠে। পূণর্ভবার স্রোতের শব্দে মন জুড়ায়।
হোসেন ঠায় দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২১ রাত ১২:৫১