এ বাড়ির মালিকের নাম, রেজা শেখ। বয়স ৬০ এর কাছাকাছি। পরিবার পরিত্যক্ত একজন মানুষ। কেউ এখন তার সাথে থাকেন না। যে যার মত যার যার রাস্তা মেপে নিয়ে চলে গেছে। এ বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। সাথে ৩ জন কেয়ারটেকার থাকে এই। অন্দর মহলে কারো ঢোকার অনুমতি নেই। রেজা, যেভাবে নিরাপত্তার বেস্টনী দিয়ে রেখেছেন কেউ লুকিয়ে ঢুকলে ধরা পড়ে যেতে বাধ্য। বেশির ভাগ সময়ে কেয়ারটেকার গুলোই এই চেষ্টা করে এবং চাকরিচ্যুত হয় ঘন ঘন। তবে এবারকার লোকগুলি ভালো। পুরো একটা পরিবার। স্বামী ,স্ত্রী আর তাদের ছেলে মিলে পুরো বাড়ি তদারকি করে।
রাতে খাবার দাবার এর জন্য বাড়ির সাথে আলাদা লাগোয়া ডাইনিং আছে। সেখানেই খাওয়াদাওয়া পর্ব চলে। এরপর রেজা ভেতরে চলে যান। কারো সাথে কথা বা দেখাও করেন না। এই সময় টায় রেজা যাবতীয় ইলেকট্রনিকস ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন। ঠিক কি করে সময় কাটান তা নিয়ে বাড়ির কেয়ারটেকার দের মধ্যে রয়েছে ব্যপক কৌতুহল। সারারাত বাড়ির আলো নেভে না। এক এক সময়ে এক এক রুম এর আলো জ্বলে থাকে। ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত। রেজা আদৌও ঘুমান কিনা তাও অজানা।অথচ সকালে নাস্তায় সেই পুরোনো মানুষ। চেহারায় কোনো ক্লান্তি বা না ঘুমানোর কোন চিহ্ন নেই। বাড়ির লোকেরা বাজার সদাইয়ে বাইরে যায়। এই রহস্যময় জীবন যাপন নিয়ে নানামুখি গল্প ও চলে। কিন্তু রেজাকে সরাসরি কেউ কখনো কিছু জিজ্ঞেসা করে না। যেন ভিন্ন এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলেন। ব্যক্তিগত প্রশ্ন করবার জন্য যে পরিবেশ দরকার সেটা কেউ পায় না।
রাতের খাবার শেষ। হাত ধুয়ে বারান্দায় খানিক পায়চারি শেষে চেয়ারে বসলেন। বারান্দাটা বেশ বড়, খোলা আকাশের অনেকটাই দেখা যায়। আকাশে আজ মিট মিট করে তারা জলছে। রেজার প্রথম সন্তান হবার সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে শুকরিয়া আদায় করেছিলেন। তখন রাত। তারা দেখেই প্রথম ছেলের নাম রেখেছিলেন ধ্রুব। আকাশের তারা দেখলেই ধ্রুবর কথা মনে পড়ে। সেই কত বছর আগে মুখখানি দেখেছিলেন। মায়াময় সেই মুখ। সিগারেটে দীর্ঘ এক টান শেষে রেজা বারান্দা থেকে রুমে ঢুকলেন। অন্দর মহলের ভেতর ঢুকতেই মাঝখানে বৃত্তাকার খোলা জায়গা। বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু তে দাড়ালে ব্যাসার্ধ নিয়ে যে পরিধি আকা হয় সেভাবেই অন্দর মহলের কক্ষ গুল পরিধির মত করে সাজানো। এক এক কক্ষের এক এক নাম এবং এক এক আলো।
অন্ধকার ঘরে হঠাৎই এক রুমের দরজার নিচ দিয়ে নীল আলোর আভা বের হয়ে আসতে শুরু করল। ধ্রুবর রুম এটা। রেজা রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। ঘরের নীল আলো যেন রেজার শরীর ভেদ করে ঢুকে যাচ্ছে। রেজা যেন দেখতে পেলেন দেয়াল গুলোতে প্রজেক্টর এর স্ক্রীন এর মত ধ্রুবর স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে। ওই যে, ১ বছর বয়সের বাচ্চা টা হামাগুড়ি দিচ্ছে। ওই যে কোলে ওঠার আবদার করছে। গোসল করছে। ঘুম পাড়ানো, ফিডার এ দুধ খাওয়ানো।
বিকেলে হাত ধরে হাটতে যাওয়া, রাস্তায় কুকুর দেখে ভয়ে শক্ত করে জড়িয়ে গলা ধরে কোলে উঠে পড়া। দেয়ালে অনবরত একের পর এক স্লাইড শো এর মত আসছে যাচ্ছে। রেজা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। আবেগে নীল রঙ আস্তে আস্তে ফ্যাকাশে হয়ে আসে। দেয়ালে স্ক্রীন ঘোলা হয়ে আসে। আবেগে রেজার চোখ ভিজে আসে। সাথে সাথেই নীল রঙ উধাও হয়ে অন্ধকার হয়ে যায়। এখন আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। অশ্রু বড্ড তীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এই আবেগের তীব্রতায় যেকোন স্মৃতি বা আবেগ দাড়াতে পারে না। রেজা রুম বন্ধ করে বেরিয়ে আসলেন। বুকটা বড্ড খালি খালি লাগছে। বের হয়ে এসেই দেখলেন ধ্রুবর রুমের ঠিক উলটো পাশের রুম ধূসর রঙ ধারন করেছে। সেই রুমের দরজা একা একাই খুলে গেল। রেজা প্রবেশ করলেন। রুমটায় যেন কোন শেষ নেই। ধূসর আলোয় কিছু দেখা যাচ্ছে না।
রেজা হাতরে হাতরে দেয়াল ধরার চেস্টা করল কিন্তু কোনো কিছুর স্পর্শ ই পেল না। যেন গভীর এক কূপ। অতল। রেজার মনে পড়ল এই ধূসর রুম টার নাম বিষন্নতা। ধ্রুবর রুম থেকেই বিষন্নতা তৈরী হয়েছে যার কারনেই বিষন্নতাই তাকে টেনে এনেছে এখানে। রেজা খানিক স্থির হয়ে দাড়ালেন। বিষন্নতা কে প্রশ্রয় দিলে তিনি বের হবার দরজা কেবল হাতরেই বেড়াবেন। এখান থেকে বের হতে হবে। ভালো কিছু মনে করা শুরু করতে হবে।
রেজা মনে করতে শুরু করলেন, যুবক বয়সে তার অর্জনগুলোর কথা। আহ কি দিন ছিল সে সময়। প্রচন্ড অর্থাভাব কিন্তু হার না মানা মনোভাব। সামান্য কিছু পুজি নিয়ে ব্যবসায় নামা। তারপর রাত দিন হিসেব না করে ছোট একটা ফ্যাক্টরি। হাতে গোনা কয়েকজন কর্মচারী। রেজার মনে আছে, তখন খুব একটা কামাই হত না কিন্তু মন ভর্তি বিশ্বাস ছিল, ভালো দিন আসছে সামনে।
রেজা হঠাৎ দেখলেন, চিকন একটা সোনালী আলোর লাইন ধূসর রুমের মধ্যে তৈরী হয়েছে। রেজা সেই সোনালী লাইন ধরে এগুতে থাকলেন। এক সময় রুমের বাইরে চলে আসলেন। দরজা আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে গেল।
এখন আবার সেই অন্ধকার। ডুপ্লেক্স বাড়ির ওপরের তলায় সেন্সর লাইট আছে। হাতে তালি বাজালে অটোমেটিক জ্বলে উঠবে। রেজা চাইলে এই নিচ তালা থেকে বেরিয়ে যেখানে আটপৌরে জীবন আছে সেখানে চলে যেতে পারেন। কিন্তু এই ফ্লোরে তার নিজের কাছে নিজেকে স্বাধীন লাগে। মনে হয় ইচ্ছে মত তিনি তার আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারেন, অনূভুতি গুলি নাড়াচাড়া করতে পারেন। এই বয়সে আর কি ই আছে তার এই আবেগ, অনূভুতি ছাড়া। আর আছে একাকিত্ব, অন্ধকার এর মত। ছেয়ে আছে সব সময়। সেই অন্ধকারে আলো পড়লে বহুকাল অন্ধকারে অভ্যস্ত চোখ ঝলসে যায়। আলো ঝলকানিতে দেখা যায় না কিছু। মানুষ যে শুধু অন্ধকারেই দেখে না তা নয়। অভস্ত্য চোখ ভিন্ন আলোতেও ঝলসে দৃস্টিহীন করে দেয়।
হাল্কা গোলাপি একটা আলো ভেসে আসছে একটি কক্ষ থেকে, রেজার স্নায়ু মিস্টি একটা গন্ধও টের পাচ্ছে। মন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। গোলাপি আভার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দুর্দান্ত প্রেম এর স্মৃতি ছড়িয়ে পড়ল কক্ষের দেয়ালে দেয়ালে। আহ, সে সব কি দিন ছিল। প্রিয়তমার সান্নিধ্যে বৃষ্টিতে ভেজার দিন, ওই যে ফাল্গুনে কৃষ্ণচূড়ার আগুনে মনের দেয়া নেয়ার ক্ষন। খুনসুটি, অভিমান, রিকশার হুড তুলে ঘন্টা চুক্তি তে ঘুরে বেড়ানো।
চিঠি লেখার প্রতিযোগিতা, কে কত বড় কত পৃস্টা জুড়ে লিখতে পারে। এভাবেই কেটেছিল। পরিনয় এক সময় পরিনতীর দিকে এগিয়ে যায়, ডিংগি নৌকা থেকে ছই ওয়ালা নৌকায় পাড়ি দেয়া শুরু হয়। সেই চা খেতে খেতে রাত জেগে গল্প, বুকের মাঝে মাথা রেখে সপ্ন, ভোরে হাত হাত রেখে সূর্যদেবের আগমনে কত সংকল্প।
রেজা এই পর্যায়ে এসে হাত তালি দেন, দ্বিতীয় তলার আলো জ্বলে ওঠে। মনে তখন গোলাপি রঙ এর রেশ। এ রেশ নিয়েই তিনি বাকি রাত পার করতে চান। সুখস্মৃতি নিয়ে ঘুমাবার মত আনন্দ আর কিছুতেই নেই। সিড়ি ভেংগে রেজা তার ব্যক্তিগত রুমে চলে আসেন। চোখ বোজেন। গোলাপি স্নিগ্ধতায় নিদ্রার এক স্তর থেকে আরেক স্তরে চলে যেতে থাকেন দ্রুত।
খুব বেশিক্ষন ঘুম হয় না রেজার। বয়স হচ্ছে। শেষ বয়সের দিকে নাকি ঘুম পাতলা হতে থাকে। হঠাত রেজা নিজেকে শ্যাওলা রঙ এর এক কক্ষে আবিস্কার করলেন। রঙ টা কেমন যেন ঘিনঘিনে। এই রুম টা কেন আসলাম? এখানে তো আসবার কথা না। নিজেকে যেন নিজেই জিজ্ঞেস করলেন। এই রুম টাকে খুব আড়ালে অনেক ভেতরে বানানো হয়েছে। যেন বিস্মৃত হয়ে থাকে। অনেক কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখা এই রুমে প্রবেশের জন্য। সহজেই যেন ঢোকা না যায়। রুম থেকে যেন আলোর কোনো আভা বা বিচ্ছুরনও যেন বেরিয়ে আকর্ষন না করতে পারে সে জন্য দরজার নিচেও কোন ফাকা জায়গা রাখা হয় নি। তারপরও আজ কেন এই রুমে আসলেন।
এই রুমটা এক নিষিদ্ধ রুম। এখানে জমা পড়ে আছে রেজার সব অজানা স্মৃতি। মানুষের কিছু কিছু বিষয় থাকে যা তার একান্তই তার। গোপনে লালন করে যায় জীবনভর। যা বলা যায় না কখনোই। সে যতই কাছের মানুষ হোক না কেন।জীবনে এমন কিছু পর্যায় আসে যে পর্যায়ে করা এমন কিছু কাজ যার কোনো জবাবদিহিতা হয় না। যার কোনো মানেও হয় না। দাগ রেখে যায় অন্তরে। ওই দাগই জীবনভর খুব একান্তে যত্নে গোপনে লালন করে যেতে হয়। যেন মুখোশের আড়ালে অন্য মানুষ। রেজা ভাবেন। সব কিছুই কি ব্যাখার যোগ্য হতেই হবে? সব কিছুই কি জানাতে হবে? জীবনে বাচতে হলে। যে স্মৃতি কখনোই কারোর উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না তার কি দরকার আছে কোনো প্রকাশ হবার? থাকুক না তা অন্ধকারে। থাকুক না মুখোশের আড়ালে অন্য মানুষ। এক সময় নিজেই ভুলে যাবে যে নিজের দ্বিতীয় কোন সত্তা আছে।
রুমটার দেয়ালে ফুটে ওঠে একের পর এক লুকানো স্মৃতি। কিছু ভাবনা, কিছু পাপ,কিছু নাম না জানা সম্পর্ক, কিছু চাওয়া, কিছু ব্যাকুলতা, জমিয়ে রাখা ঈর্ষা,কিছু অন্যায় আবদার, কিছু অসম ভালোবাসা, কিছু ঘৃনা, কিছু আক্রোশ, খানিক ভয়াবহতা সব ফুটে ওঠে দেয়াল জুড়ে। রেজা কপালে ঘাম জন্মে। রেজা মনে করতে চান না, চোখ বন্ধ করে ফেলেন।
খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে নিতে জেগে ওঠেন রেজা। খানিক দুঃসপ্ন দেখে ওঠার মত। কিন্তু দুঃসপ্ন নয় যেন একদম জাগ্রত। লুসিড ড্রীম এর মত। যেন ওখানেই ছিলেন, শরীর ছিল এই কক্ষে ।
ভোর হবে হবে। রেজা রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাড়ালেন। ভোরের কিছু পাখি উড়ে যাচ্ছে। আকাশে রাত কেটে নতুন সূর্য ওঠার একরকম লালচে আভা। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যায়।
কি সুন্দর এক দিন শুরু হতে যাচ্ছে। একটু পর ই, সবাই বেড়িয়ে পড়বে এই বাস্তবতা নামের বিষয়টির সাথে লড়তে। হয়ত কেউ জেতে এখানে কেউ হারে, কেউ হারবে না জিতবে তার মাঝামাঝি অবস্থায় দাঁড়িয়ে টিকে থাকার চেস্টা করে। হেরে যাওয়া কেউ পছন্দ করে না। অথচ এক জীবনে কেউই কিন্তু হারে না। হেরে যাবার একটা পর্যায় চলতে থাকে। পূর্নতা একসময় আসেই। শুধু বদলায় পারিপার্শ্বিকতা বদলায় মানুষ। পূর্নতা প্রাপ্তি যখন আসে তখন হয়ত অনেক কিছুই নেই। যাদের জন্য এই প্রাপ্তি তারা হয়ত হেরে যাওয়ার পর্যায়েই বিদায় নিয়ে নিয়েছে। একসময় সব ই হয় কিন্তু সেই সময়টাই আর ফিরে পাওয়া যায় না। কত প্রশ্ন করা হয় সব ই যখন হবে তবে এতো দেরী কেন, সব হারিয়েই বা কেন? পুর্নতা ই বা কেন এত শূন্যতার বিনিময়ে। সবাই ঘুরে বেড়ায় এক একটা অন্দরমহল সাথে নিয়ে। কেউ কথা দিয়ে সেই মহলে আবেগে প্রবেশ করে বড্ড ভিরমি খেয়ে এড়িয়ে যায়। তাই হয়ত দেখা যায়, অন্দরমহলের প্রবেশদার সবসময়ই তালাবদ্ধ থাকে। এ যেন এক নিষিদ্ধ মহল যা মানুষ সবার অগোচরে তত্ত্বাবধান করে চলে জীবনভর।