'প্রবাসে বাংলাদেশের রক্তের উত্তরাধিকারী গুণীগন' পর্ব- ৩৩৭'
হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন,’ . ইতিহাস হচ্ছে বিজয়ীর হাতে লেখা বিজিতের নামে এক রাশ কুৎসা।‘
ইতিহাসে দেখি, প্রত্যেক বিজয়ী সাক্ষাৎ ধর্মের অবতার আর পরাজিত মাত্রই কুকীর্তির খনি, বিজয়ীরা এসেছেন পরাজিত জাতিকে সে কুকীর্তি থেকে ত্রাণ করতে – প্রত্যেক যুদ্ধের শেষে এ প্রচার লাগাতার ভাবেই সাধারণ মানুষের কর্ণগোচর হয়। একেই বলে সার্থক “প্রোপাগাণ্ডা”।
তবে এসব “প্রোপাগাণ্ডা”য় বিশ্বাস না রেখে স্রোতের বিপরীতে চলার মত মানুষও থাকে। সঠিক সময়ে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো, বলার মত মানুষ পৃথিবী থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়না। এরকমই একজন কীর্তিমান বাঙালীকে নিয়ে আজকের আলোচনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি নিজের সুসভ্য জাতি বলে মনে করে।ফলে নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজিতদের মাথা চট করে কেটে ফেলতে বা জাপানের কাছ থেকে মোটা দাগের ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্ত নিতে একটু চক্ষুলজ্জা লাগছিল বৈকী। তাই বেশ যুত করে বারোজন বিচারপতি সদস্যযুক্ত ইন্টার্ন্যাশানাল মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল ফর ফার ইস্ট নামে গাল ভরা এক লম্বা নাম দিয়ে এক সুসজ্জিত বিচারসভার আয়োজন করা হয়েছিল টোকিয়ো শহরে। বিচারের রায়ও মোটামুটি আগে থেকেই নির্ধারণ করাই ছিল।
গোলমালটা পাকিয়ে ফেললেন পূর্বোক্ত এই বাঙ্গালী ভদ্রলোকটি।আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারের পাঠ ভদ্রলোকটির যথেষ্ট জানা। এবং স্বদেশে ন্যায় বিচারক হিসাবে খ্যাতিও যথেষ্ট। ফলে এই একমাত্র রায় বিজয়ী মিত্র শক্তির অসীম বিজয়ানন্দের হাজার মণ দুধে যেন এক ফোঁটা গোচনা হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ভদ্রলোক নিজের মতে একেবারে অবিচল। খাটা খাটুনি করে, নিজের উদ্যমে যতটুকু তিনি জেনেছেন, তাতে তাঁর নির্দ্বিধায় মনে হচ্ছে, জাপানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি একেবারে অসার। অভিযুক্তদের নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়াই এক মাত্র সঠিক কর্ম। স্রোতের বিপরীতে, নিজের বিবেক, বুদ্ধি এবং জ্ঞান কে সম্বল করে একলা চলা এই ভদ্রলোকই বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল।
(হিরোশিমায় একটি শান্ত সম্মেলনে বিচারপতি পাল)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। যুদ্ধশেষে পরাজিত পক্ষের আড়ম্বর করে বিচার করতে হয়।তাই বিজয়ী আমেরিকান অক্ষ জাপানের বিচার করার জন্য ইন্টার্ন্যাশানাল মিলিটারী ট্রাইব্যুনাল ফর ফার ইস্ট (সংক্ষেপে টোকিও ট্রায়াল) নামে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাধাবিনোদ পালকে রয়াল ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট ট্রাইব্যুনালের একজন সদস্য নির্বাচন করে জাপানে প্রেরণ করলেন।
(টোকিও ট্রাইব্যুনালের রায় যে চেয়ারে বসে দিয়েছিলেন)
আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম বিশারদ রাধাবিনোদ যুদ্ধের কার্য কারন সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ছিলেন। যে ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি হিসাবে তাঁকে জাপানে পাঠানো হল, তাঁর প্রথম প্রশ্নই জাগ্রত হল সেই ট্রাইব্যুনালের যৌক্তিকতা নিয়ে। তিনি নির্দ্বিধায় বুঝতে পারছিলেন এই “সাজানো নাটক” বিজয়ী পক্ষের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার, প্রতিহিংসাকে আইনী তকমা দেওয়ার এক হাতিয়ার মাত্র। যে বিচারসভায় বিচারের আগেই বিচারকদের রায় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তা যে শুধুমাত্র শো ট্রায়াল, তা নিয়ে রাধাবিনোদ নিঃসংশয় ছিলেন। দ্বিতীয়ত, রাধাবিনোদ এও বুঝতে পারছিলেন, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে বা তার আগে, জাপান বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে এটা সত্য। কিন্তু একজন নিরপেক্ষ বিচারপতি, ন্যায়ের আসনে বসে নিরপেক্ষ বিচার করবেন, তাইই একান্ত কাম্য। তাই জাপানের যুদ্ধাপরাধ বিচার করতে হলে, একই সাথে মার্কিন ফৌজেরও বিচার করতে হয়, কারন হিরোশিমা – নাগাসাকীর মত দুটি শহরকে শুধুমাত্র পরমাণু বোমার প্রয়োগ সারা দুনিয়াকে দেখাবেন বলে যারা চোখের পলকে বাষ্পে পরিণত করলেন; তাঁরাও একই অপরাধে দোষী। হয়তো বা তাঁদের দোষের পাল্লা বোধ হয় কিঞ্চিত বেশীই ভারী। তিনি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, টোকিও ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে অপারগ – যুদ্ধাপরাধের বিচার করার ক্ষমতাই টোকিও ট্রাইব্যুনালের নেই।
(টোকিও ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী কিয়োসে ইচিরোও (বাঁয়ে), বিচারপতি পাল (মাঝখানে) ও প্রধানমন্ত্রী কিশি নোবুসুকে (ডানে)। ১৯৫২ সালে জাপানে তোলা ছবি। পালের হাতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত নিজের রায়)
রায়দানের সময়ে, রাধাবিনোদ তাঁর দীর্ঘ রায়ে তাঁর দ্বিমত ঘোষণা করলেন।তাঁর রায়ের সাথে একমত পোষণ করেন ট্রাইব্যুনালের আরো দুইজন সদস্য (একজন নেদারল্যান্ডের অধ্যাপক বার্ট রোলিং এবং অপর জন ফ্রান্সের হেনরী বার্নার্ড) শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিজয়ী মিত্রপক্ষের গালে সম্ভবত এর থেকে জোরালো চপেটাঘাত আর কেউ করতে পারেননি। মিত্রপক্ষের চাপ সত্বেও ইন্টারন্যাশনাল যুদ্ধাপরাধ টাইব্যুনালের 'টোকিও ট্রায়াল' ফেজে এই বাঙালি বিচারকের দৃঢ অবস্থানের কারণেই জাপান অনেক কম ক্ষতিপূরণের উপরে বেঁচে গিয়েছিলো। নয়তো যে ক্ষতিপূরণের বোঝা মিত্রপক্ষ ও অন্য বিচারকরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেনন তার দায় এখন পর্যন্ত টানতে হতো জাপানকে। সেক্ষেত্রে ঋণের বোঝা টানতে টানতে জাতি গঠনের সুযোগই আর পাওয়া হতোনা জাপানের। সেসময়ই জাপানী সম্রাট হিরোহিতো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেছিলেন, "যতদিন জাপান থাকবে বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবেনা। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নি:স্বার্থ বন্ধু।" এটি যে শুধু কথার কথা ছিলোনা তার প্রমাণ আমরা এখনো দেখতে পাই। জাপান এখনো বাংলাদেশের সবচে নি:স্বার্থ বন্ধু। এই ঘটনার প্রায় ৬৫ বছর পর ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিসান হামলায় প্রাণ গেলো নয় জাপানিজ বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ারের। জাপান তখনও পাশে ছিলো বাংলাদেশের।
(বিচারপতি পালের নিজ হাতে লেখা কবি চণ্ডিদাসের বাণী)
যদিও আমরা এই মহান বাঙালীকে বিস্মৃত হয়েছি, কিন্তু জাপান তাঁকে মনে রেখেছে। সম্রাট হিরোহিতো ১৯৬৬ সালে তাঁকে The First Class of the Order of Sacred Treasure সম্মানে ভূষিত করেন।এই বাঙালি বিচারকের জীবনী এখোনো জাপানী পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তাঁর নামে জাপানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কিছু মেমোরিয়াল ও মনুমেন্ট।
(ইয়াসুকুনি শিন্তোও মন্দিরে বিচারপতি পালের স্মৃতিফলক।)
১৯৯৭ সালে কিয়োতোতে অবস্থিত শিন্তোও মন্দিরের রিয়োওগোকুজেন জিনজার চত্বরে স্থাপিত তাঁর দর্শনীয় স্মৃতিফলক।এরকম আরেকটি স্মৃতিফলক ২০০৫ সালে টোকিওর শিন্তোও মন্দির ইয়াসুকুনি জিনজার প্রাঙ্গণেও স্থাপিত হয়েছে। এবং এই মন্দিরের অধীন যুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর ইউশুউকান এর ভিতরেও বিচারপতি পালের ছবি সংরক্ষিত আছে। হিরোশিমা জাদুঘরের কাছাকাছি অবস্থিত কোমাচি হোনশোওজি বৌদ্ধ মন্দিরের প্রাঙ্গণেও রয়েছে তাঁর স্বহস্তে বাংলা ও সংস্কৃতিতে লিখিত একটি শান্তির বাণী একটি পাথুরে ফলকে।১৯৭৪ সালে কানাগাওয়া-প্রিফেকচারের হাকোনে শহরের এক পাহাড়ে স্থাপিত হয়েছে পাল-শিমোনাকা* স্মৃতিজাদুঘর।
রাধাবিনোদ পাল বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার তারাগুনিয়া ইউনিয়ন, দৌলতপুর উপজেলার সালিমপুর গ্রামের এক অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি। শৈশব থেকেই প্রচণ্ড পরিশ্রম ও মেধার বলে মানুষ হয়েছেন তিনি। ১৯০৭ সালে কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে বিএ অনার্স উত্তীর্ণ হয়ে পরের বছর একই বিষয়ে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। মেধাবী রাধাবিনোদ প্রথম চাকরিতে নিযুক্ত হন ১৯১১ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপক হিসেবে। এখানে ১৯২০ সাল পর্যন্ত থাকা অবস্থায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মাস্টার্স অব ল’ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ১৯২০ সালে। ১৯২১ সালে কলিকাতা উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলডি ডিগ্রি লাভ করেন ‘মনুসংহিতা : পূর্ব বৈদিক ও উত্তর বৈদিক যুগে হিন্দু আইন-দর্শন’ বিষয়ে। একমাত্র তিনিই তিন-তিনবার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্লভ ‘টেগোর ল প্রফেসর’-এর আসনে নির্বাচিত হন যথাক্রমে ১৯২৫, ১৯৩০ ও ১৯৪৮ সালে। তার আগে এই আসনে ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. বিজনকুমার মুখোপাধ্যায় এবং হার্ভার্ড ল স্কুলের অধ্যাপক রোসকো পাউন্ড).
(জাপানে প্রতিষ্ঠিত বিচারপতি পালের একটি আবক্ষ মুর্তি)
এই বিরল সম্মানের কারণে ভারত সরকার ১৯২৭-৪১ সাল পর্যন্ত তাকে জাতীয় আয়কর দফতরের আইন উপদেষ্টা করেন। ১৯৪১ সালে কলিকাতা উচ্চ আদালতের বিচারপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৩ সালে অবসর নিয়ে পুনরায় ওকালতিতে ফিরে যান। কিন্তু পরের বছর আবার ডাক পড়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের। টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি হিসেবে যোগদানের পূর্বে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন। এই বিচারে তিনি যে ৭০০ পৃষ্ঠার রায় দিয়েছিলেন তা আজ বিশ্বইতিহাস। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে এক অপরিসীম অবদান। ১৯৫৭ সালে জাতীয় অধ্যাপক এবং ১৯৬০ সালে ভূষিত হন ‘পদ্মভূষণ’ পদকে। বিচারপতি পাল জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শেষ জীবনে শান্তিবাদী কর্মী হিসেবে ১৯৬৭ সালে কলকাতায় নিজগৃহে মৃত্যুবরণ করেন।
*পাল এর বিশিষ্ট বন্ধু শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও (১৮৭৮-১৯৬১) জাপানের শীর্ষস্থানীয় মর্যাদাসম্পন্ন প্রকাশনা সংস্থা হেইবোনশা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বনামধন্য একজন শিক্ষাবিদ।
(বিশিষ্ট বন্ধু শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও এর সাথে)
প্রবাসে বাংলাদেশের রক্তের উত্তরাধিকারী গুণীগন - পর্ব ১ হইতে ৩৩৬ এখানে।
তথ্য সুত্র-
উইকিপিডিয়া
http://www.manchitro.com/Itihas.html
www.shimonaka.or.jp/activity/shimonaka.html
http://www.prothomalo.com/durporobash/article/378694/বাà¦à¦¾à¦²à¦¿-পাল-à¦à¦¾à¦ªà¦¾à¦¨à¦¿-শিমà§à¦¨à¦¾à¦à¦¾-দà§à¦
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৪