আমি একজন মুজিববাদে ঈমান রাখা মানুষ।
তাই আজ লিখতে বসছি একটা তাত্ত্বিক বিতর্কের উপর, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র।
এইটা কেবল পছন্দ অপছন্দের বিষয় না, এইটা হইলো, রাষ্ট্র গঠনের দর্শনের ভিত্তি। যেইখানে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, রাষ্ট্রটা কাদের জন্য? ধর্মের জন্য, না মানুষের জন্য?- এই প্রশ্নের উপর।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র:
দুনিয়ায় কী ফল দিছে?
দেখেন, দুনিয়ায় ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কম না। তাদের অভিজ্ঞতা, ব্যর্থতা, হিংসা, গৃহযুদ্ধ, সংখ্যালঘু নিপীড়ন, সব মিলায়ে একটা ভয়াবহ ইতিহাস। কিছু নমুনা দিই।
১. পাকিস্তান:
১৯৪৭ সালে ইসলামের নামে দেশ হইল,
কিন্তু ওই রাষ্ট্রে কী হইল। আহমদিয়া মুসলমানদের ‘অমুসলিম’ ঘোষণা। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বে রক্তে ভিজে গেলো মসজিদ, মাদ্রাসা।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান তো বরাবরই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ধর্মের নামে শোষণ করলো পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিদের। ইনসাফ ছাড়া ভুখন্ড দৃশ্যমান হইলো। যা মোটেও কাম্য ছিলোনা।
ধর্মের নামে দেশ বানাইল, কিন্তু সেই দেশেই মানুষ মরতেছে ধর্মের কারণে। এইটাই কি রাষ্ট্র? এইটাই কি ইসলাম?
২. ইরান:
ইসলামি প্রজাতন্ত্র — হ্যাঁ, কাগজে কলমে। কিন্তু বাস্তবে? নারী বাইরে গেলে হিজাব না পরলে পুলিশ পেটায়, সংখ্যালঘু বাহাই সম্প্রদায় রাষ্ট্রে ঠাঁই পায় না, রাজনৈতিক মত প্রকাশ করলেই ফাঁসি। এইটা কি রাষ্ট্র, না তেহরানের নামধারী কারাগার?
৩. ইসরায়েল: ইহুদি রাষ্ট্র।
-প্যালেস্টাইনের মুসলমানদের ঘরবাড়ি দখল কইরা, দেয়াল তুইলা, রাষ্ট্র বানাইল। এই রাষ্ট্রে কেউ ইহুদি না হইলে সে "পুরা নাগরিক" না।
মুসলমানরে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাইছে।
একটা রাষ্ট্র যদি ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে, তাহলে রাষ্ট্র হয় না; হয় ধর্মীয় বন্দোবস্ত।
৪. সৌদি আরব:
কাবা শরিফের পবিত্র ভূমি; কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে একনায়ক শাসন। নারীর গায়ে জোর কইরা হিজাব চাপায়, গান বাজানোর দায়ে মানুষকে শাস্তি দেয়, আর রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত চলে উলামা পরিষদের ফতোয়ার উপর। এইখানে রাষ্ট্র না, এখানে মসজিদের ভিতরে গাদাগাদি কইরা সরকার বসে।
ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র মানেই কী?
➤ মানবাধিকারের খণ্ড খণ্ড অবস্থা?
➤ সংখ্যালঘুর নিপীড়ন?
➤ মত প্রকাশের সীমাবদ্ধতা হরণ?
➤ নারীর অধিকার হরণ?
➤ রাষ্ট্রচিন্তার জায়গা দখল করে ফতোয়া বা পুরোহিততন্ত্র?
রাষ্ট্র যেখানে ধর্ম চালায়, সেখানে মানুষ দ্বিতীয়।
আর যেখানে মানুষ চালায়, সেখানে ধর্ম নিরাপদ।
মুজিববাদ কী কয়?
শেখ মুজিব স্পষ্ট কইয়া দিছে...
> "ধর্ম তোমার, রাষ্ট্র সবার।"
মুজিববাদ কয়...
রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ।
এর মানে কী?
✦ হিন্দু হইলে তুমি বাঙলাদেশি
✦ মুসলমান হইলেও বাঙলাদেশি
✦ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নাস্তিক হইলেও তুমি বাঙলাদেশি এবং এই দেশ তোমার।
রাষ্ট্র কাউরে জিজ্ঞাস করবে না, "তোমার ধর্ম কী?" রাষ্ট্র জিজ্ঞাস করবে, "তুমি নাগরিক কিনা?"
এইটাই হইলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এইটাই হইলো মুজিববাদী দর্শনের দ্বিতীয় স্তম্ভ।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি ধর্মবিরোধিতা?-
না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র না।
বরং সব ধর্মরে সমান চোখে দেখার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত। একটা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হইলে,
অন্য ধর্মগুলারে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার সেপারের ভিত্রে যাইতে হয় চলতে হয়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সব ধর্মে সমান অধিকার থাকে। এখানে কেউ কারও উপরে সওয়ার হয় না। এখানে রাষ্ট্র কারও নাম কইরা চলে না।
কেন বাঙলাদেশ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হইতে পারে না?
আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি পাকিস্তান নামের এক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আমরা যুদ্ধ করছি এই কারণেই যে, পাকিস্তান কইছে "তুমি মুসলমান, তাই তুমি পাকিস্তানি" আর শেখ মুজিব কইছে, "আমি বাঙালি, এইটাই আমার পরিচয়। আর তাই আমি বাঙালি।"
রাষ্ট্র যদি আবার ধর্মের উপর দাঁড়ায়, তাহলে তো যুদ্ধটাই বৃথা গেলো! তাহলে তো আমরা আবার সেই পাকিস্তানেই ফিরলাম নাম পাল্টায়া।
মার্ক্স কইছে ধর্ম আফিম। মাও কইছে, ধর্ম রাষ্ট্রের শত্রু। লেনিন কইছে, ধর্ম সমাজকে ভাঙে। কিন্তু শেখ মুজিব কইছে, ধর্ম মানুষের অধিকার,
আর রাষ্ট্র হবে সেই অধিকার রক্ষা করার জায়গা।
এই জন্যই আমি বলি, মুজিববাদ কেবল একটা দর্শন না, এইটা মানবিক রাষ্ট্রের রূপরেখা।
যদি আমরা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র চাই, তাহলে কার ধর্ম রাষ্ট্র হবে? আর যদি আমরা মানুষভিত্তিক রাষ্ট্র চাই, তাহলে ধর্ম আলাদা, রাষ্ট্র এক। এইটাই হবে।
আমি ধর্মে বিশ্বাস করি, কিন্তু আমি চাই না
আমার রাষ্ট্র কোনো ধর্মের নামে চলে। আমি চাই রাষ্ট্র চলুক মানুষের নামে, মানুষের অধিকারে।
এইটাই মুজিববাদ।
এইটাই বাঙলাদেশ।
এইটাই ভবিষ্যৎ।
জয় বাঙলা।
জয় বঙ্গবন্ধু।
জয় ধর্মনিরপেক্ষ বাঙলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৮:৪৫