আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠি তখন কিভাবে যেন ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে যাই। অতটা ভালো ছাত্র ছিলাম না সে সময়। যোগ-বিয়োগে প্রচুর ভুল করতাম। মুখে বলতাম ৬ কিন্তু লেখার সময় খাতায় ৯ লিখে দিতাম এমন অবস্থা। দুই সংখ্যার ভাগ অংক পারলেও তিন সংখ্যাতে গিয়েই কুপোকাত! কোন ভাবেই মিলাতে পারতাম না। দাগটানা খাতায় বাংলা লেখা বেশ ভালোই ছিলো কিন্তু পরিক্ষার খাতায় লিখতে গেলেই কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং হয়ে যেতো। লাইনগুলোকে টেনে কিছুতেই উপরের দিকে রাখতে পারতাম না। বাম দিকে খাতার অর্ধেকটা থাকতেই ডান দিকের অংশ শেষ। নিজের লেখা খাতা নিজেরই ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করতো।
২য় শ্রেণির বার্ষিক পরিক্ষা শেষ করেই বেড়াতে যায় নানার বাড়ি। নানা বাড়ি বেড়িয়ে বাড়িতে এসে সহপাঠি আমার চাচাতো ভাইয়ের কাছে শুনি আমি নাকি প্রথম হয়েছি! বাবা-মা লেখাপড়া না জানলে কি হবে, আমার প্রথম হওয়ার খবরে আমার চেয়ে যেন তাদেরই বেশি আনন্দ। পরের জুমা'বারে বাবা মসজিদে "বাতাসা" দিলো ভালো রেজাল্টের খুশিতে। আর চারিদিকে প্রশংসার বন্যা তো আছেই। বাড়ির সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তখন আমি। চাচা-চাচিরা তাদের ছেলে-মেয়েদেরকেও বলে, "তোরা কি খাস আর হাবিবুর কি খায়! তোদের নামই থাকে না খাতায়, আর দ্যাখগা হাবিবুর! মায়ের লগে সারাদিন কাম কইরাও ফাস্ট অয়।" আমার সামনে যখন এমন প্রশংসা করা হতো, কি যে লজ্জা লাগতো! চাচিদের কথা আর কি বলবো, আমার মাই বেশি প্রশংসা করতো আমার।
তৃতীয় শ্রেণিতে সে বার কয়েকজন নতুন ছাত্র এসে ভর্তি হলো আমাদের ক্লাসে। তাদের সাথে কিছুতেই পেরে উঠছি না। ক্লাসে ইংরেজি আর গনিত স্যারের বকা নিয়মিতই খাওয়া লাগতো। ক্লাস থ্রির বিজ্ঞানের তখনকার টার্ম আমার কাছে "বোঝা" মনে হতো। "বিজ্ঞান করে অজ্ঞান" টাইপের কথা শুধু মাথায় ঘুরতো। সব মিলিয়ে ক্লাসের পড়াশোনা যাও একটু পাড়বো স্যারদের কটুক্তি আর আমাকে নিয়ে "কি ফাস্টবাবা", "তরে ফাস্ট বানাইছে ক্যারা রে" টাইপের কথাবার্তায় পড়াশোনা আমার কাছে ভীতিকর হয়ে উঠেছিলো। খুব একটা পিটুনি দেয়া হতো না ঠিকই তবে কটু কথাগুলো আমার খুব লাগতো। বিশেষ করে সহপাঠিদের কাছে, আমি তখন "ফাস্টবাবা" হিসেবে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠলাম।
ক্লাস ফোরে আমার রোল নাম্বার হয়ে গেল আট! অবশ্য আমার বাড়ির অন্য চাচাতো ভাই-বোনদের রোল নম্বর তখনো আমার পরে। সে জন্যই রক্ষা। তারা অনেকে একটা-দুইটা বিষয়ে ফেলও করেছে। বাড়িতে এই নিয়ে সমস্যা হয়নি ঠিকই কিন্তু স্কুলে সেই আগের মতো আমাকে নিয়ে কৌতুক চলতোই। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে যখন উঠি তখন আমার রোল নম্বর প্রথম পনের জনের মধ্যে ছিলো না। স্কুল থেকে কোনমতে ফাইভ পাশের সনদ নিয়েছিলাম।
ছোট চাচা সে বার দাখিল পরিক্ষার্থী। আমার সহপাঠিরা যারা আমার সাথে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করেছে তারা সবাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে। আমাকে নিয়ে গ্রামের মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলো ক্লাস ফোরে! কিছুটা মন খারাপ হলো আমার, কিন্তু চাচাকে কিছু বললাম না। শুধু মা বললো, "দুই বছর পিছে?" আমি যে "ফাস্টবাবা" তা যদি মা জানতো তাহলে হয়তো এ কথাও বলতো না। আমার মতোই চুপ থাকতো।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৪:৫২