২০০১ সালের ঘটনা। শিক্ষা জীবনের শুরুতেই দুই বছর পেছনে পরে গেলাম। সহপাঠি ভাইবোন যারা আমার সাথে প্রাইমারি শেষ করেছে তাদের দেখে খুব ইচ্ছা করতো বড় ক্লাসে পড়ার। সকল ইচ্ছাকে পেছনে ফেলে তবুও ক্লাসের পাঠে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু লাভ কি তাতে? একে তো পরিবেশটা নতুন, তার উপরে আরবি বুঝিনা। প্রথম কয়েকদিন ক্লাসে বোরিং লাগলেও আস্তে আস্তে সবার সাথে একটা সখ্যতা গড়ে উঠলো। অবশ্য মেয়েদের সাথে কখনো কথা বলা হয়ে উঠেনি। মেয়েদের চাইতে বেশি লাজুক ছিলাম সে সময়। আমাদের ক্লাসে শেফালি নামে এক ছাত্রী ছিলো। বয়সের তুলনায় বেশ লম্বাটে। দেখে মনে হতো ক্লাস নাইনে পড়ে। বড় মনে হওয়ার আরেকটা কারন ছিলো অবশ্য। অন্য মেয়েরা সবাই সেলোয়ার-কামিজ পড়লেও শেফালি একাই আসতো বোরকা পড়ে। কিন্তু হিজাব পড়তো না। আমাদের মাদাসায় দশম শ্রেণির মেয়েরাও হিজাব পড়তো না। বড় মেয়েরা সবাই বোরকা পড়েই আসতো কিন্তু হিজাবের ব্যাপারে অতটা কড়াকড়ি ছিলো না। হিজাবের ব্যাপারে স্যারেরা কঠোর ছিলেন না ঠিকই তবে পাঞ্জাবি পরিধানের প্রতি শিক্ষকদের নজর একটু বেশিই ছিলো। যদিও যে যার ইচ্ছা মতো পাঞ্জাবি পড়তে পারতো। আমাদের ক্লাসে শেফালির সাথে একটা ছেলে খুব দুষ্টুমি করতো। শেফালিকে দেখলেই পাঞ্জাবির কলার ধরে একটা ঝাঁকি মারতো আর মুচকি একটা হাসি দিতো। ছেলেটার নাম ছিলো আরিফ। শেফালি তো আরিফকে দেখতেই পারতো না। শেফালি অবশ্য বেশি দিন ক্লাশ করার সুযোগ পায়নি। সবে মাত্র ক্লাস ফোরের ফাইনাল এক্সাম দিয়েছিলো। তখনই তার বিয়ের সানাই বেজে উঠেছিলো! এখন সে তিন সন্তানের মা!
আমাদের ক্লাসের আরবি শিক্ষক ছিলেন খুবই আন্তরিক। ক্লাসের বাইরে তার কাছে যেতে বলতেন। পড়া বুঝিয়ে দিতেন। সেই স্যারের কল্যানেই আরবিতে হয়ে উঠেছিলাম ক্লাসের সেরা। যে স্যার গনিত আর বিজ্ঞান পড়াতেন, সেই স্যারের ক্লাস করতে একদমই ভালো লাগতো না। তিনি খারাপ পড়াতেন বলে নয়। কারনটা হচ্ছে, তার মুখে ছিলো প্রচন্ড দূর্গন্ধ। ক্লাসে এসে যখন কথা বলতেন তখন ক্লাসরুম গন্ধে আলোকিত হয়ে যেতো। নাক দিয়ে নি:শ্বাস নেয়ার কোন উপায়ই ছিলো না। কইতেও পারতাম না আবার সইতেও কষ্ট হতো। এভাবে কি ক্লাসে মনযোগ দেয়া যায়?
দেখতে দেখতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলে এলো। পরীক্ষা দিলাম কিন্তু খুব একটা ভালো হলো না। ভালো না হলে কি হবে, ক্লাসে যার রোল নম্বর এক ছিলো রেজাল্ট প্রায়ই তার কাছাকাছি। শুধু গনিত আর বিজ্ঞান বাদে। গনিত আর বিজ্ঞানে সমস্যা রয়েই গেলো। সেই সমস্যা সমাধানে আমার ছোট চাচার ভূমিকা ছিলো সবচেয়ে বেশি।
ছোট চাচা সে বার মাদ্রাসা থেকে সবচাইতে ভালো রেজাল্ট করে। এ গ্রেড, ৪.২৫ ছিলো রেজাল্ট। সে বারই প্রথম গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়। দাখিল পাশ করে কলেজে ভর্তি হয় ছোট চাচা। বাড়িতে যখন থাকতেন তখন আমার পড়াশুনার খবর নিতেন। গুণ আর ভাগ অংক চাচার কাছ থেকেই প্রথম শিখি। কিন্তু শিখতে গিয়ে নাকের পানি আর চোখের জল এক করে ফেলেছিলাম। চাচাকে দেখে খুবই ভয় পেতাম। অবশ্য আমাকে মারতো না। কিন্তু ধমকাতো খুব। আর আমি তো একটু ধমকেই ভয়ে কাতর!
২য় সাময়িক পরিক্ষা দিলাম। রেজাল্ট দেখে তো সবাই অবাক। ক্লাসে যার রোল নম্বর এক, সব বিষয়েই তার থেকে বেশি! রোল এক ছেলেটা তো পুরাই থ! অবশ্য তার থেকে খুব বেশি নাম্বারের ব্যবধান না। সব বিষয় মিলে ১০ কি ২০ হবে। বার্ষিক পরিক্ষায় ক্লাসের সবাইকে টপকে প্রথম হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করলাম দ্বিতীয় বারের মতো! কিন্তু মাথায় সেই আগের চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। আবার কি "ফাস্ট বাবা" হতে হবে......?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৫৭