(১) আমি তখন ক্লাস সিক্স পড়ি। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলনা। সপ্তাহের একদিনের বাজার দিয়ে মা পুরো সপ্তাহ চালাতেন। মাছ আনা হলে ভালো করে ভেজে রাখতেন। সকাল-বিকাল আবার গরমও করতেন, না হলে গন্ধ হয়ে খাবার অনুপযোগী হয়ে যেত। ভেজে রাখা মাছ দু-এক টুকরা করে তরকারিতে ভেঙে দিয়ে রান্না করতেন। যেদিন মাছ আনা হতো শুধু সেদিন একটা করে আস্ত টুকরা খেতে পারতাম। আমাদের দুইভাই আর বাবাকে দিতেন ঠিকই কিন্তু মা খেতেন না। কোন কোন দিন দেখতাম বাবার প্লেটে থেকে মাছের টুকরা ভেঙে মাকে দিতে।
একদিন ক্লাশ থেকে ফিরে এসে দেখি মায়ের মন খুব খারাপ। জিজ্ঞেস করলে মা জানালেন, বিড়াল নাকি মাছ খেয়ে ফেলেছে। কথাটা শুনে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। যতটা খারাপ মাছের জন্য হয়েছে তার থেকে বেশি হয়েছে মায়ের মন খারাপ দেখে। সপ্তাহ শেষ হতে আরো পাঁচ দিন বাকি। নিরামিস খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কোত্থেকে যে বিড়ালটা এসেছে আমরা কেউই জানি না। বাড়ির ছোট ছোট মুরগির বাচ্চাগুলোও শেষ করে দিচ্ছে বিড়ালটা। অনেকেই ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু পাড়ছে না। এ পাড়ায় ভালো খাবারের সন্ধান পেয়ে বিড়ালটাও যাচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই কারো না কারো ঘর থেকে মাছ চুরি করে খাচ্ছে বিড়ালটা। সবাই অতিষ্ট হয়ে উঠেছে।
একদিন আমাদের ঘরে মাছ খাবার সময় হাতে-নাতে ধরে ফেলি বিড়ালটাকে। হাতে কাপড় পেঁচিয়ে নিয়েছিলাম খামছি খাবার ভয়ে। তারপর একটা বস্তায় ভরে রাখি। মা বলেছিলেন দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসতে। কিন্তু নিয়ে যাবার সময় রাগে বিড়ালটাকে কয়েকটা আছার মারেছিলাম। আর তাতেই মরে যায় বিড়ালটি। বিড়ালটি মারা যাবার পর নিরে মধ্যে একটা অনুশোচনাবোধ কাজ করতে থাকে। পণ করি আর কোনদিন বিড়াল মারা তো দূরের কথা বিড়ালকে কষ্টও দেব না।
(০২) কয়েকদিন ধরে অফিসের ব্রডব্যান্ড লাইনগুলো কেটে সাবার করে ফেলছে কিছু ইঁদুর। ইঁদুরের উৎপাতে আমরা সবাই যখন অতিষ্ঠ তখন কোত্থেকে যেন বিড়ালটি আমাদের অফিসে আসে। সারারাত কষ্টকরে ইঁদুর তাড়িয়ে বিড়ালটি সকাল হবার কিছু আগে ঘুমুতে যায়। ঘুমের মাঝে সকালের সূর্য চলে আসলে নিজের হাতে চোখ ঢেকে আবার ঘুম দেয়। সেই মুহুর্তে ক্যামেরা বন্ধি কিউট বিড়ালটি।
দিনরাত অফিসেই থাকে। বিস্কুট দেই কিন্তু খায় না। যেখানে সেখানে ঘুমায়। কখনো টেবিলের উপর কখনো আলমারির উপর। কখনো বা সোফার উপর আয়েশ করে। সকালের ঘুমে মাঝে একবার ডাক দিয়েছিলাম বলে বিছুটা রাগকরেছিল বিড়ালটি। আমার দিকে না তাকিয়ে কাত হয়ে আবার ঘুম দিল। আমি আর বিরক্ত করলাম না। ঘুমুতে দিলাম।
(৩) একজন ব্যভিচারী মহিলার ও কুকুরের কথা হাদীসে এসেছে। যে মহিলা তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর জন্য জান্নাতী হয়। হাদিসটি হলো:
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (একবার) একটি পতিতা মহিলাকে মাফ করে দেয়া হলো। (কারণ) মহিলাটি একবার একটি কুকুরের কাছ দিয়ে যাবার সময় দেখল সে পিপাসায় কাতর হয়ে একটি কূপের পাশে দাঁড়িয়ে জিহবা বের করে হাঁপাচ্ছে। পিপাসায় সে মরার উপক্রম। মহিলাটি (এ করুণ অবস্থা দেখে) নিজের মোজা খুলে ওড়নার সাথে বেঁধে (কূপ হতে) পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে পান করাল। এ কাজের জন্য তাকে মাফ করে দেয়া হলো। (এ কথা শুনে) সাহাবীগণ আরয করলেন, পশু-পাখির সাথে ভাল ব্যবহার করার মধ্যেও কি আমাদের জন্য সাওয়াব আছে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ। প্রত্যেকটা প্রাণীর সাথে ভাল ব্যবহার করার মধ্যেও সাওয়াব আছে। (বুখারী, মুসলিম)।
আবার একজন ধার্মিক মহিলার কথাও অনেকেও জানেন, যিনি বিড়ালকে কষ্ট দেয়ার জন্য জাহান্নামে যাবে। ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘এক মহিলাকে একটি বিড়ালের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সে তাকে বেঁধে রেখেছিল এবং অবশেষে সে মারা গিয়েছিল, পরিণতিতে মহিলা তারই কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করল। সে যখন তাকে বেঁধে রেখেছিল, তখন তাকে আহার ও পানি দিত না এবং তাকে ছেড়েও দিত না যে, সে কীট-পতঙ্গ ধরে খাবে।’’ [সহীহুল বুখারী ২৩৬৫, ৩৩১৮, ৩৪৮২, মুসলিম ২২৪২ ]
বিড়ালকে ভালোবাসার জন্য এক প্রসিদ্ধ সাহাবীও বিড়াল ছানার পিতা উপাধি পেলেন। আরেকজন ধার্মিক মহিলা বিড়ালকে কষ্ট দেয়ার কারনে যাবেন জান্নাতে। আমাকে কি আল্লাহ ক্ষমা করবেন না?
কিয়ামতের দিন আমাদের জন্য অনেক সারপ্রাইজ থাকবে। আমরা হয়তো দেখব আমাদের অনেক ভালো কাজ মীযানের পাল্লায় তেমন ভারীই হচ্ছে না, কিন্তু ছোট ছোট কিছু ভালো কাজ অনেক ভারী হচ্ছে। আজীবন ধর্মীয় লেবাস পড়ে বড়াই করা লোকটার ভাগ্যে হয়তো জাহান্নাম জুটবে, অথচ সবার চোখে পাপী ও ঘৃণ্য লোকটা তাঁর এক মুহূর্তের 'Sincerity' এর মাধ্যমে আদায় করে নিয়েছে জান্নাত।
তাই ছোট ছোট ভালো কাজ বা ছোট আমলগুলোর প্রতিও বড় আমলের মতই সমান যত্নবান হওয়া উচিৎ । বলা তো যায়না, বিচারের মাঠে কোন কাজের কেমন ওজন হবে? আল্লাহ চাইলে আমাদের পার্থিব জীবনের এক মুহূর্তের ছোট্ট কোনো ভালো কাজের বিনিময়েও জান্নাত দিতে পারেন ।
(৪) সবশেষে একটা সনেট: বিড়ালের সংসার।
বিড়াল সেজেছে বর আজ তার বিয়ে
গহনা কোথায় পাবে কোথা পাবে শাড়ি?
কমদামী গহনায় করে মুখ ভারি
বিড়ালনি বসে তবু বিয়ের পিড়িতে।
সেজেছে টিকলি আর সফেদ শাড়িতে
কারণ সে ভালোবাসে বিড়ালকে খুব,
যতই অভাব থাক তবু রয় চুপ
সাজাবে সংসার সে ভালোবাসা দিয়ে।
না থাকুক দামী ঘর দামী আসবাব
যদি থাকে প্রেম আর কিছু সদভাব
সাজাবে দুজনে মিলে প্রেমময় ঘর।
দুই জনে মিলে সেথা অভাবের 'পর
দূর করে দিবে তার সব কষাঘাতে
ফুটাবে রঙিন ফুল জীবন রাঙাতে।
আরো বিস্তারিত পড়তে চাইলে: একটি বিড়ালের কারনে একটি মহিলা জাহান্নামে চলে যায় এবং ব্যভিচারী নারী কুকুরকে পানি পান করানোর জন্য ক্ষমা পেয়েছিলেন লিংক থেকে ঘুরে আসতে পারেন।