ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে তো ধর্ম হীনতা নয়। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আবার কোন কোন সময় ধর্মান্ধও বটে। তাই ধর্ম নিয়ে বাড়বাড়িও বেশী। সংবিধানের ৫ম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে আরো বেশী আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে এ বিষয়টি অনেক ভেবে চিন্তে অগ্রসর হতে হবে। গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সাধারন জনগনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন আছে তেমনি যার যার নিজ ধর্ম পালনের অধিকারও দেওয়া হয়েছে। ৫ম সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট আদি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করেছে। এই বিধান অনুসারে "কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিম্বা ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকিবে না।" আমার মতে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল হওয়া মাত্রই আইনগতভাবে তার বাস্তব প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই সরকারের উচিত ছিল কোর্টের রায়ের বাস্তবায়নের জন্য পরদিনই জামায়াত ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দলগুলোর অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়া। আর নির্বাচন কমিশনের উচিত ছিল এ ধরনের দলগুলোর নিবন্ধন তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করে দেয়া। ধর্মভিত্তিক দল কে নিষিদ্ধ করবে, সরকার না নির্বাচন কমিশন, এ বিতর্ক অবান্তর। কারণ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনঃপ্রবর্তিত হওয়াতে এসব দল স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা (secularism) সম্পর্কে অনেকে বলার চেষ্টা করছেন যে এটি খুবই স্পর্শকতার একটি বিষয়। তাই রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে এটা নিয়ে আবার একটু চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। কিন্তু তারা একথাটি ভুলে যাচ্ছেন যে, "সোনার পাথর বাটি" যেমন একটি অলীক বিষয়, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষতা বিহীন গণতন্ত্রও অবাস্তব একটি ব্যাপার। গণতন্ত্রের অন্যতম মূল কথা হলো, রাষ্ট্রের কাছে ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক সমান মর্যাদাসম্পন্ন এবং একজন "নাগরিক"-এর পরিচয় বহনকারী। 'ধর্ম যার যার, আর রাষ্ট্র হলো সবার'- এটাই হলো গণতন্ত্রের একটি আবশ্যক বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক করে রাখতে না পারলে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা কখনোই সম্ভব হতে পারে না।
মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্র বাদ দেয়ার পক্ষে এসব মহলের কণ্ঠ আরো জোরালো। যুক্তি দেয়া হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর এখন যে বিশ্ব পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে সমাজতন্ত্রকে আর রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে রাখা উচিত না। এই যুক্তি ধোপে টিকে না। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখে আমরা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য গ্রহণ করিনি। দেশের বাস্তবতায় 'শ্রমিক-কৃষক-জনগণের মুখে হাসি ফোটানোর' জন্য দেশবাসীর সামগ্রিক কল্যাণে 'সোনার বাংলা' প্রতিষ্ঠার পথ হিসেবেই সমাজতন্ত্রের পথ গ্রহণ করা হয়েছিল। সংবিধানের প্রস্তাবনায় এবং ৪, ১৩, ১৪, ১৫, ১৯, ২০ প্রভৃতি অনুচ্ছেদে যে সব নীতিমালা ও ব্যবস্থার কথা উল্লেখ আছে, তার দ্বারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদগুলো সবই সমাজতন্ত্রের পথনির্দেশ। তাছাড়া, একথাও ঠিক নয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর সমাজতন্ত্র নিঃশেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীর দেশে-দেশে সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম চলছে, জোরদার হচ্ছে। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, কোরিয়া নিজ-নিজ পথ ও পন্থায় সমাজতন্ত্রের পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছে। ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়াসহ লাতিন আমেরিকার অনেক দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজতন্ত্রের ধারায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে। কয়েক যুগের গণসংগ্রামের ধারায় বিকশিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের দামে সমাজতন্ত্রের যে লক্ষ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিল, তা পরিত্যাগ করার কোনো কারণ বা যুক্তি থাকতে পারে না।
প্রথমের কাজ প্রথমে করতে হবে। আর সেটা হলো, সংবিধান সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবায়ন করা। তারপরে আসতে পারে কাজের কোনো প্রশ্ন। সেটা হলো '৭২-এর আদি সংবিধানের উন্নতি সাধনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী-সংযোজনী সন্নিবেশিত করা। প্রথম কাজের সাথে দ্বিতীয় কাজ মিলিয়ে ফেলাটা হবে কেবল ভ্রান্ত পদক্ষেপই নয়, তা সুচতুরভাবে আদি সংবিধানের মূলভিত্তি ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আপস ও আত্মসমর্পণের পিচ্ছিল পথ রচনার কৌশলও হয়ে উঠতে পারে। সংবিধান নিয়ে কে কি বলছে, করছে, তা গভীর পর্যবেক্ষণে রাখাটা খুবই জরুরি। তাই দেশবাসীকে বলব, খুব সাবধান! কেউ যেন এটাকে পুঁজি করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে।................
দৃস্টি আকর্ষন:
লেখাটি লিখতে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারন সম্পাদক, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সাহেবের লেখার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। তাই তার কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ দুপুর ২:২৫