somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শেখ রেহানার অনুভূতি কেমন ছিলেন আমার আইভী চাচী!

০২ রা অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২১ আগস্ট আমাদের কাছে আরও একটি ভয়াবহ দিন। বিকালে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরুর আগে হঠাৎ করে গ্রেনেড হামলা এবং গুলিবর্ষণ করা হয়। ঘাতকদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই শেখ হাসিনাকে হত্যা করা।

১৫ আগস্টের শোক বুকে নিয়ে আমরা দেশের মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে আছি। তারপর আবার এই আঘাত কেন? কেন এই রক্তাক্ত সংঘর্ষময় হামলা? আইভী রহমানসহ ২৪ জনকে প্রাণ দিতে হলো। অসংখ্য আহত হয়েছে। কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন সারাজীবনের জন্য। শরীরে স্প্রিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন এখনও অনেকে। এই হামলা যারা পরিকল্পনা করেছে তারা বাংলার মানুষের শত্রু। তারা শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেনি। তারা আবার একটি ১৫ আগস্ট ঘটাতে চেয়েছিল। তাদের মধ্যে মানবতার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ পর্যন্ত নেই। রাজনীতিকে তারা অস্ত্র ও শক্তি দ্বারা দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে। কেননা রাজনীতির মূল্যবোধ তাদের কাছে প্রতিহিংসাপরায়ণতা হিসেবে বিবেচিত। ২১ আগস্ট আমার কাছে এক অভিশপ্ত দিন। ১৫ আগস্ট সবাইকে হারিয়ে আমরা দুবোন বেঁচে আছি। সেদিন যদি আমার হাসু আপার কিছু হয়ে যেত আমি সে শোক কেমন করে সামলাতাম, ভাবতে আজও দিশাহারা হয়ে যাই।

কিন্তু তারপরও আমার প্রিয় আইভী চাচীকে হারিয়েছি। দেখতেও সুন্দর ছিলেন, মনটাও সুন্দর ছিল। আবার রুচি বোধেও ছিলেন উন্নত। কে কি বললো বা ভাবল এসব নিয়ে ভাবতেন না। নিজে যেটা ভালো মনে করতেন, সেটাই করতেন গভীর আগ্রহের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে ছিল তার পারিবারিক সম্পর্ক। আব্বা তাদের বিয়ের উকিল বাবা ছিলেন। মায়ের খুব স্নেহের পাত্রী ছিলেন তিনি। মায়ের কাছে শুনেছি, খুব ছোট্ট বেলায় আমাকে তার কাছ থেকে কেউ সরাতে পারতো না। আমি তাকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম। এমনই ছিল তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক।

তার তিন ছেলেমেয়ে পাপন, তানিয়া ও ময়নার সঙ্গে আমিও ছিলাম সন্তানের মত। আমাকে কখনও আলাদা করে ভাবতেন না। আমি তাদের কাছে এখনও বড় বোন। ভালো কিছু চোখে পড়লে চাচী আমার জন্য কিনতে ভুল করতেন না। এমনকি তার সম্পত্তি থেকেও আমাকে ভাগ দিতে চেয়েছেন। এমন ভালোবাসার মানুষ কেউ কখনও পায়? আমি তো পেয়েছিলাম, এটাই আমার কাছে বড় গর্বের বিষয়। নেতা হিসেবে জিল্লুর কাকা ও আইভী চাচী তাদের ব্যবহার, সহমর্মীতা ও কর্মকাণ্ডের জন্য নেতাকর্মীদের কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মান পেয়েছেন, এটাই হলো বড় কথা।

আজ যখন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কাছে যাই, আমার সেই প্রিয় আইভী চাচীকে দেখি না। সব কিছু মনে হয় ঠিকঠাক আছে, সব ফুল আছে। শুধু আমার আইভী লতা নেই। এ দুঃখ আমাকে কষ্ট দেয়। তিনি বেঁচে থাকলে আজ বঙ্গভবনে একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতেন যেখানে সবাই গিয়ে সবার সাথে মিলতে পারতো, সমৃদ্ধ হতো।

কত কথা মনে পড়ে যায়। একবার তার সঙ্গে বাজি ধরে আমি জিতে চাই। শর্ত অনুযায়ী তিনি আমাকে ও রাসেলকে চায়নিজ খাওয়ালেন। এদিকে দেরি করে ঘরে ফেরাতে মা আমাদের খোঁজ করলেন। আইভী চাচীকে আমাদের আগে ঘরে ঢুকতে দেখে মা আমাদের আর বকাঝকা করলেন না। আর একবার একটি অনুষ্ঠানে আমরা দুজন বসে আছি। হঠাৎ কী কথায় চাচী খুব হাসতে থাকলেন। হাসি যেন থামতেই চায় না আমাদের আব্বা মঞ্চে বসে আমাদের দেখে ফেলেন। অনুষ্ঠান শেষে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা দু’জনে কী নিয়ে এতো হাসাহাসি করলে?’ সামান্য কথাতেই চাচী খুব হাসতে পারতেন। খুব সৌখিন ও আমুদে মানুষ ছিলেন বলেই এটা সম্ভব ছিল।

২০০৪ সালের ৮ আগস্ট মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তিনি আমাকে খুব আদর করে বললেন, “কিরে তুই এবার এসে আমার খোঁজ নিলি না। দেখবি আমি খুব শীঘ্রি মরে যাবো, তখন তুই সবচেয়ে বেশি কাঁদবি!” এ কথা তিনি কেন আমায় সেদিন বলেছিলেন, আমি জানি না। ১৫ আগস্ট শোক দিবসের মিলাদের পরও তার সঙ্গে দেখা হয়েছে।

মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে মস্কোতে যখন আব্বার সঙ্গে তার চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম, তখনও তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জিল্লুর কাকার চিকিৎসার জন্য তিনি সঙ্গে গিয়েছিলেন। ডাক্তাররা যখন তারও চেকআপ করে গলার টনসিলের অপারেশন করে দেয় তিনি খুব ভয় পেয়েছিলেন। বলেছিলেন, কী ব্যাথা করে! অথচ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তার দুই পা ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে যায়। তিনি উঠে বসেছেন, কথাও বলেছেন। একটু ব্যাথা পেলে খুব কষ্ট পেতেন। অথচ সেদিন তিনি এত বড় আঘাত কী করে সহ্য করলেন। নিজের সেই রক্তাক্ত শরীর দেখে কী মনে হয়েছিল তার তখন। জানি না। জানাও যাবে না। তিনি তো আর নেই। শুধু তার সেই সজীব মুখখানা তেমনি ছিল। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে ২৪ আগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আগস্ট মাস এলেই আমাদের শোকটার সঙ্গে জিল্লুর কাকার শোকটা উপলব্ধি করতে পারি। পাপন, তানিয়া ও ময়নাকে বড়বোন হিসেবে সান্তনা দিতে হয় আমাকেই। ওদের কষ্টের সঙ্গে নিজের সব হারানোর বেদনাকেও আজ আমি একাত্ম করে নিয়েছি।

আইভী চাচী আমার বন্ধু ছিলেন, সহমর্মী ছিলেন। তার কাছে সব কথা বলা যেত। সব দুঃখ শোনাতে পারতাম। আমার এই প্রিয় মানুষটির প্রতি জানাই আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মধুর চেয়েও মধুরতম হয়ে থাকবে তার স্মৃতি। দুঃখ ও দুঃসময়ে তিনি ছিলেন আমার কাছে মায়ের মতন। একথা যতদিন বাঁচব নিশ্চয় মনে থাকবে আমার।

শেখ রেহানা, ২৩ শে আগষ্ট, ২০১০
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আকাশে তাকিয়ে ডাকি আল্লাহকে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:০১


জীবনে দুঃখ... আসলে নেমে
শান্তি গেলে থেমে;
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে হই উর্ধ্বমুখী,
আল্লাহকে বলি সব খুলে, কমে যায় কষ্টের ঝুঁকি।

আমি আল্লাহকে বলি আকাশে চেয়ে,
জীবন নাজেহাল প্রভু দুনিয়ায় কিঞ্চিত কষ্ট পেয়ে;
দূর করে দাও সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

"ছাত্র-জনতার বেপ্লবের" ১৮ মাস পরে, আপনার ভাবনাচিন্তা ঠিক আগের মতোই আছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৭



২০২৪ সালের পহেলা জুলাই "ছাত্র-জনতার বেপ্লব শুরু হয়, "৩৬শে জুলাই" উহা বাংলাদেশে "নতুন বাংলাদেশ" আনে; তখন আপনি ইহাকে ব্যাখ্যা করেছেন, ইহার উপর পোষ্ট লিখেছেন, কমেন্ট করেছেন; আপনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

×