আগস্ট মাসের শেষ। শীতপ্রধান দেশগুলোতে এখন চলছে রমরমা গ্রীষ্মকাল। ক্যানাডার মন্ট্রিয়েল আর টরন্টোয় যেন চলছে গ্রীষ্ম উৎসব। ২৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা আর ৮২% আদ্রতা যুক্ত আবহাওয়ায় এসে নামলাম টরন্টো এয়ারপোর্টে। সকাল দশটা, কড়া উজ্জ্বল রোদে তাকানো যায়না। সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে এজেন্টের সাথে গাড়িতে উঠে বসলাম। একটা জাহাজ পরিদর্শনে এসেছি। জাহাজ সেন্ট লরেন্স নদী দিয়ে এসে ঢুকবে ওন্টারিও হ্রদে, তারপর টরন্টোতে ভিড়তে পারে বেলা বারোটার দিকে। জেটিতে পৌঁছে খবর পেলাম জাহাজ আসতে কিছুটা বিলম্ব হবে। এদিকে ক্ষুধায় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে। এজেন্ট আমাকে গার্ডরুমে বসিয়ে দিয়ে গার্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পালিয়েছে। তাদের ধান্দাই হল একসাথে যত বেশী জাহাজ ম্যানেজ করতে পারা যায়। হয়ত ছুটেছে অন্য এক জাহাজের কাজ করতে। আমি গার্ডের সাথে খানিকক্ষণ এটা সেটা গল্প করে এবার তুললাম খাবারের কথা। গার্ড বলল রেস্টুরেন্ট আছে একটা, তবে সেটা দু কিলোমিটারের কম দূরে নয়। রেস্টুরেন্টের দুরত্ব শুনে এমনিতেই মাথায় হাত তার উপর নেই কোন যানবাহন। এরি মধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত হাজির সুগন্ধি লাঞ্চের প্যাকেট। মরার উপর খাঁড়ার ঘা বলছি এ জন্য যে লাঞ্চের প্যাকেট তো আমার জন্য আসেনি। সেগুলো গার্ড আর কর্মীদের প্রতিদিনের নির্ধারিত লাঞ্চের সরবরাহ। একজন ক্ষুধার্ত মানুষের সামনে যদি এমন সুগন্ধি খাদ্য এসে হাজির হয় আর সে তা খাওয়ার অধিকার না রাখে তাহলে মেজাজটা কেমন হয়? লোভে মুখে লালা এসে যাচ্ছে। আর সইতে না পেরে হাঁটা দিলাম রেস্টুরেন্টের দিকে। প্রখর রোদে ঘেমে অস্থির। নাকের উপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। যতদূর চোখ যায় রাস্তায় এক এই আমি বান্দা ছাড়া আর কোন মানুষ তো দূরের কথা, একটা কুকুরও দেখা যাচ্ছেনা। খানিকক্ষণ হাঁটার পর দেখতে পেলাম এক বিশাল নার্সারী, সামনে বিশাল এক কারপার্ক, সারি সারি নানান ধরণের গাড়ি পার্ক করা। বিভিন্ন প্রকারের গাছ গাছালি, বীজ, টব, সার আরও অনেক বাগান করার জিনিস বিক্রি হচ্ছে এই ফুটবল মাঠের সমান বিশাল নার্সারীতে।
এই ধরণের নার্সারীর ভেতরে সাধারণতঃ একটা ক্যান্টিন থাকে যেখানে খরিদ্দাররা খাওয়া দাওয়া সারতে পারেন। ক্যান্টিনের সন্ধানে নার্সারীর দিকেই হাঁটা দিলাম। প্রধান গেটের বাইরেই পেয়ে গেলাম নার্সারীর এক কর্মীকে। ইউনিফর্ম পরা স্মার্ট কর্মী।
তাকে বললাম, “ তোমাদের নার্সারীতে ক্যান্টিন আছে”?
সে একটু অবাক হয়ে বলল, “ ক্যান্টিন দিয়ে কি করবে”?
আমি ততোধিক অবাক হয়ে বলি, “লাঞ্চ করব, লাঞ্চ”।
লাঞ্চ করবে?
হ্যাঁ, এই ধর, ভেজিটেবল, টমেটো সালাদ ইত্যাদি হলেই আমার চলবে।
এসো আমার সাথে, এই বলে সে নার্সারীর ভিতর দিকে যেতে লাগলো। আমিও তার পিছু পিছু হাঁটছি আর ভাবছি, যাক বাবা বাঁচা গেল, খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল তাহলে। কিন্তু না, উপরওয়ালা যে আমার খাদ্যের ব্যবস্থা এত সহজে করেন নি সেটা বুঝলাম একটু পরেই।
সে একটা তাকের সামনে এসে আমাকে বলল, এই দেখ, এখানে নানা ধরণের ক্যান এবং টিন আছে। তুমি কোনটা কিনবে, ক্যান না টিন? এই প্লাস্টিকের ক্যানগুলোর ভিতরে কম্পোস্ট এবং টমেটোর বীজ সাজানো আছে বাসায় নিয়ে পানি ঢাললেই কয়েকদিনের ভিতর সালাদ টমেটোর গাছ গজাবে। আর ঐযে টিনগুলো দেখছ ------।
আমি তাড়াতাড়ি ওকে ওকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে সেখান থেকে কেটে পড়লাম। আবার রাস্তায় নেমে হাঁটছি আর ভাবছি এই শালার ধনী দেশ? আরে, আমার গরীব বাংলাদেশে দু কিলোমিটারের মধ্যে কমসে কম কুড়িটা না হলেও দশটা খাবারের দোকান তো থাকতোই। এই ধনী দেশে এসে এখন দেখছি অনাহারে মরতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ল ক্যানাডার এই অঞ্চলে তো ইংরেজির চাইতে ফ্রেঞ্চ বেশী চলে, তাহলে বোকার মত ক্যান্টিন না খুঁজে রেস্টুরেন্ট খুঁজছি না কেন? ও হ্যাঁ, রেস্টুরেন্ট নয়, ফরাসী স্টাইলে বলতে হবে রেঁস্তঁর্যাঁ – তবেই না ক্যানাডিয়ান মহাশয়েরা বুঝবেন আমি কি চাচ্ছি।
ঐ যে একটা মেয়ে এদিকেই আসছে, যাই, ওকেই জিজ্ঞাসা করে দেখি, মাদমোয়াজেল রেঁস্তঁর্যাঁটা যেন কোনদিকে?
মিসিসাগা
২৫শে আগস্ট ২০১২