আমি তখন সেভেনে পড়ি। আমাদের স্কুলে সেভেন এ সেকশনের তখন দোর্দণ্ড প্রতাপ! টিচারদের কমন রুম, সিনিয়রদের আড্ডা থেকে শুরু করে গার্জিয়ানদের চাদর বিছিয়ে তুমুল গল্পের খোরাক আমরা ছিলাম!!
তো একদিন আমরা এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসের সামান্য ৫ মিনিটের বিরতির তুমুল সদ্ব্যবহার করছিলাম। আমাদের নেক্সট ক্লাস ছিল এমন এক ম্যাডামের যিনি কখনই সময়মত ক্লাসে আসতেন না!
হঠাৎ দেখলাম, ছোটখাট একটা ছেলে পিছনে হাত রেখে করিডরে দিয়ে আসছে। ইন করা শার্ট-প্যান্ট পরা দেখে আমরা ভাবলাম নিশ্চয়ই হেডমাস্তানের তলব পেয়ে কারো বড় ভাই/মামা/চাচা দেখা করতে আসছে!!
তারপরের ৫ মিনিটে আমাদের উপর রীতিমত ঝড় বয়ে গেল। যারা যারা একটু হুটোপুটি করছিলাম, সবাই নিজেকে আবিষ্কার করলাম বেঞ্চে চুপ করে বসে আছি আর ফোঁপাচ্ছি।
৪ ফিট ১১ বা বড়জোর ৫ ফুটি এই ছেলে যে আমাদের নতুন অংক টিচার হিসেবে আসছে, এই তথ্য জানার পর আমরা রীতিমত আতংকিত হয়ে পড়লাম!! ক্লাস এইটে উঠার পর দেখলাম তিনিই আমাদের অংক টিচার সাথে বোনাস হিসেবে বৃত্তি ক্লাসেও তিনি অংক করাবেন!! ক্লাস এইটে আমার রোল ছিল বিশ। তারপরো আমাকে বৃত্তি পরিক্ষার জন্য সিলেক্ট করায় আমার দুঃখের সীমা রইল না! :-<
স্কুলে আগে থেকেই একজন মোস্তফা স্যার থাকায় খুব দ্রুত এই স্যারের নাম হয়ে গেল "বাট্টু মোস্তফা"।
প্রথম প্রথম স্যার খুব মারতেন সবাইকে। তাই আমি একটা নাম দিসিলাম "ক্লুসনার", কিন্তু সেই নাম হালে পানি পায় নাই।
বৃত্তি পরিক্ষার জন্য আমার নাম আসার পর আম্মু একদিন আমাকে এই বাট্টু মোস্তফার কাছে অংক কোচিং এর জন্য দিয়ে আসলেন!!! আমার এবং স্যারের বাসা স্কুলের খুব কাছে হওয়াতেই আমার কপাল পুড়ল! প্রথম প্রথম খুব ভয়ে থাকতাম। কিন্তু কিছুদিন পরই ভয়টা কেটে গেল।
আমি চূড়ান্ত অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম, উপরে উপরে খুব কঠিন মানুষ হলেও ভেতরে ভেতরে স্যার পুরা ল্যাটকা খিচুড়ির মত নরম!! তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। তার মাঝে ধুম করে আব্বুর চাকরি চলে যাওয়াতে আমাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়!! সদ্য কিশোর এই আমি অনাগত কঠিন ভবিষ্যতের কথা ভেবে খুব মন খারাপ করে থাকতাম। স্যার একদিন স্কুলে আমাকে ধরলেন। অনেক জেরা করলেন। আমি কিছুতেই কিছু বলবো না! কিন্তু সেদিন বিকালেই স্যারের বাসায় যাওয়ার পর স্যার আমাকে আবার ধরলেন। সবাই কোচিং করে চলে যাওয়ার পর স্যার আমার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে সত্য বের করে আনলেন!!
আমার এখনো চোখে ভাসে স্যার সেদিন কিভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি মুছেছিলেন!!!
আমাকে স্যার অনেক আদর করে বোঝালেন। স্যার নিজের গল্প বললেন। উল্লেখ্য, ক্লাসে সবার মধ্যে আমি সাইজে সবার ছোট ছিলাম!! ক্লাসে সবার বিভিন্ন রকম অত্যাচার আমাকে সইতে হত। আমি প্রতিদিন কাঁদতাম। স্কুলে, ক্লাসে, বাসায় বালিশে মুখ লুকিয়ে, গোসলের নামে বাথরুমে ঘণ্টা কাটিয়ে আমি কাঁদতাম!!
সেই মোস্তফা স্যার আমাকে শিখালেন, কিভাবে শারীরিক সব অসুবিধা ঠেলে, সামান্য বর্গা কৃষকের ছেলে হয়ে কিভাবে ঢাকা শহরের সেরা একটি সরকারি স্কুলের আজ তিনি অংক শিক্ষক!!! আমি অবাক হয়ে দেখলাম স্যারের জীবনের সাথে আমার অদ্ভুত মিল!! জেদ চেপে গেল .....
এরপর থেকে শুধু অংক না, জীবনে যা সমস্যা মনে হয়েছে স্যারের কাছে দৌড়ে গিয়েছি পরামর্শের জন্য!! আম্মুর নিরন্তন সংগ্রাম আর ছোট বোনের টিফিন না খেয়ে স্কুল করার সেইসব দিনে মোস্তফা স্যারের সব কথা মাথায় বাজত। সকল বাধা বিপত্তি ঠেলে আমি পড়াশোনা করতে থাকলাম।
আমাদের স্কুলে বার্ষিক পরিক্ষার রেজাল্ট দিত এসেম্বলি করে। এসেম্বলিতে টপ টেনের রেজাল্ট কার্ড দিত, তারপর যার যার ক্লাসরুমে গিয়ে বাকিদের রেজাল্ট কার্ড সাথে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট!!
ক্লাস এইটে আমার রোল ছিল বিশ। এসেম্বলিতে যখন মর্নিং-ডে শিফট মিলিয়ে চারটা সেকশনের প্রায় আড়াইশ' ছাত্রের রেজাল্ট দিচ্ছিল, আমার আম্মু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। যখন আমি টের পেলাম আম্মু চিৎকার করছে, তখন হঠাৎ শুনি মাইকে আমার নাম ডাকছে!!! ক্লাস সেভেনে অংকে ফেল করা এই আমি, বৃত্তি পরিক্ষার জন্য সবার শেষে সিলেক্টেড হওয়া এই আমি; আড়াইশ' ছাত্রের মধ্যে প্লেস করেছি!!!
অনেকটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে স্টেজে উঠেই কি মনে করে সেই "বাট্টু মোস্তফা" স্যারকে কদমবুসি করে ফেললাম!!
আমার এখনো চোখে ভাসে স্যার সেদিন কিভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি মুছেছিলেন!!!