somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রি-ইউনিয়ন আর পুরানো সার্কাস

১৫ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার স্কুলের রি-ইউনিয়ন ডিসেম্বর মাসে। খুব ভালো কথা, ৫৪/৫৫ বছরে এই প্রথম রি-ইউনিয়ন হচ্ছে।
স্কুলে সাধারণত ছোট ভাই- বড় ভাই বিষয়গুলা থাকে না!! অন্তত আমার ক্ষেত্রে স্কুলের দুনিয়া ছিল ক্লাসের বন্ধু আর টিচার দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তো রি-ইউনিয়ন মানে এদের সাথে বহুদিন পর দেখা, কিছু স্মৃতিচারণ, একসাথে লাঞ্চ করা, কুশলাদি বিনিময় আর সবশেষে যার যার শুভকামনা জানিয়ে ভারি বুক নিয়ে ঘরে ফেরা!!
ঠিক এই কারণেই আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই রি- ইউনিয়ন নামক এই সার্কাসে যাবার!!
প্রিয়- অপ্রিয় অনেক টিচার স্কুল ছেড়ে বা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। :( বাকি যে ২/১ জন প্রিয় টিচার আছেন; বাসার খুব কাছেই স্কুল হওয়াতে তাদের সাথে প্রায়ই রাস্তায় দেখা হয়, কথা হয়!! যত দূরেই থাকি আর যতই তাদের ভুলে থাকি না কেন, তাঁরা সবসময়ই আমার শুভকামনা করেন। :)
ছোট কাউকেই চিনতাম না, হাতে গোনা কিছু প্রতিবেশী ছেলে ছাড়া। বড় অনেককেই চিনতাম, কিন্তু সেগুলো ছিল মুখচেনা পর্যন্তই; ভয়ের সেই সম্পর্কগুলো কখনোই হৃদ্যতা বা ভালোবাসায় রূপ নেয়নি! সায়মন, জিতু, নয়ন, সবুজ ইত্যাদি বড় ভাইদের এখনো মনে আছে, কিন্তু রাস্তায় কখনো দেখলে তারা একবার ডাকেও না, আমিও ছ্যবলার মত গিয়ে বলি না, "ভাইয়া আমাকে চিনছেন? আমি অমুক, আপনি যখন তমুকের বেতন জোর করে নিয়ে গিয়ে সিগারেট খেতেন-- আমি আপনাদের দেখতাম। কিংবা আমরা আপনাদের আগে গিয়েও মাঠে ক্রিকেট খেলতে পারতাম না আপনারা চলে আসলে। আমি তখন সেই ছোটদের দলে ছিলাম। চিনতে পারছেন?"
বাকি থাকলো ক্লাস বন্ধুদের কথা। তাদের অসাধারণ বন্ধুত্বের অনেক ঘটনায় আমার জীবন ভরপুর। আমি সবসময় স্বীকার করি, আমার স্কুল বন্ধুরা না থাকলে আজ হয়তো আমি এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না!! I always need a push!!

তেমনি একটা ঘটনা বলি।
ক্লাস নাইনের ক্লাস পার্টি। পোলাপান খুব এক্সাইটেড ছিল কারণ ক্লাস টেনে তো স্কুল থেকেই বিদায় অনুষ্ঠান দিবে, সুতরাং নিজেদের আয়োজনে এটাই শেষ (যদিও ক্লাস টেনেও করা হয়েছিল) । ক্লাস ফাইভ থেকেই ক্লাস পার্টিগুলোয় আমার নাঁকি গলায় বেসুরো গান অবধারিত আইটেম ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেবারও ক্লাস পার্টির আইটেমগুলোর মাঝে আমার গান ছিল।
সমস্যা বাধলো, যখন টাকা দেয়ার ব্যাপার আসলো। তখন আমার বাবা'র চাকরি ছিলনা, খুব খারাপ অবস্থা ছিল আমাদের। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে আমি আগে থেকেই নানু বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতাম।
অবস্থা তখন এতোই খারাপ ছিল যে আমার মা-বাবা- ছোট বোন একটা ছোট্ট খুপরি অন্ধকার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো!! একবেলা রান্না হত, আমার ছোট বোন কোনদিন পান্তা খেয়ে, কোনদিন কিছু না খেয়েই স্কুলে যেত।
আমি বুঝ হওয়ার পর থেকেই বাসায় সব ধরনের অযথা আবদার করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আর অই অবস্থায় বাসায় ১০০ টাকা'র কথা বলবো-- এটা চিন্তা করতেই আমার কেমন জানি লাগছিল। তাই আমি বাসায় কিছু বলার আগেই ক্লাসের ঘনিষ্ঠ (!!) কিছু বন্ধুকে বললাম। তারা আয়োজন কমিটিতে ছিল বলেই তাদের কাছে বিষয়টা শেয়ার করলাম।
তারা অভয় দিল আর ব্যাপারটা গোপন রাখার আশ্বাস দিল। :) আজ থেকে ১০ বছর আগে আমি মানসিক- আর্থিক ভাবে খুব দৈন্য ছিলাম। এখনকার মত আমার দারিদ্র্য নিয়ে আমার গর্ব ছিলনা, বরং কেউ জেনে যাবে এই ভয়টাই বেশি ছিল!
তো আমি আমার ঘনিষ্ঠ (!!) বন্ধুদের আশ্বাস পেয়ে মহা উৎসাহে রিহারসেল করতে লাগলাম।
দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো।
ক্লাস পার্টির দুইদিন আগে আম্মু আমাকে ৫০ টাকা দিয়ে বললেন, ক্লাস পার্টির চাঁদা দিতে। আম্মু ক্লাস পার্টির তারিখ, চাঁদা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না!! আমি খুব ভালো করে জানতাম, আম্মু এই টাকাটাও খুব কষ্টে দু' সপ্তাহ ধরে বাজার খরচ থেকে বাঁচিয়ে জমা করেছেন!!
আমি আম্মুকে গর্ব করে বললাম, "এইবার চাঁদা ১০০ টাকা আর আমাকে দেয়া লাগবে না। অমুক আর তমুক বলছে ওরা ম্যানেজ করে নিবে, কিন্তু আমি যেন যে করেই হোক ক্লাস পার্টি অ্যাটেন্ড করি।" আম্মু নীরবে টাকা ফেরত নিলেন। আসলে তখন ইগো প্রবলেম থেকেও ৫০ টাকার অই লালচে নোটের শক্তি অনেক বেশি ছিল!!
ক্লাস পার্টির দিন। গান হল, অভিনয় হল, কৌতুক হল, অনেক মজা হল। :)
খাবার দেয়ার ঠিক আগে আগে টাকা নিয়া হিসাব শুরু হল। আমি তখন পারলে পালিয়ে বাঁচি। সবাই জেনে গেলো, আমিই সেই অধম যার টাকা বাকি!! একসময় আয়োজন কমিটিতে থাকা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু "অমুক" এসে বললো, "দোস্ত টাকাটা যে দেয়া লাগতেসে!"
ছোট্ট সেই আমার অহমে, ইগোতে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগলো! তাইতো? কেন আমি অন্য কারো করুণা নেব?? দৌড়ে বাসায় গেলাম। আমার মা বাসার দরজায় আমাকে দেখেই বুঝে গিয়েছিলেন সব। আমার ছোট্ট বোনের মাটির ব্যাংক ভেঙে কোনরকম মিলিয়ে দিয়েছিলেন ১০০ টাকা। পাড়ার দোকান থেকে খুচরো সব টাকা দিয়ে একটা একশ' টাকার নোট নিলাম।
কেউ জানল না, অই ১০০ টাকা কোথা থেকে আসলো।
কেউ জানল না, অই ১০০ টাকায় আমার ক্লাস টু পড়ুয়া ছোট্ট বোনের কত্ত দিনের শখ মিশে ছিল।
কেউ জানল না, অই ১০০ টাকা নিতে গিয়ে আমি আমার মায়ের সামনে কত ছোট হয়ে গেছিলাম।

জীবনে হয়তো অনেক ১০০ টাকা কামিয়েছি এবং কামাবো। আমার সেই অমুক, তমুক বন্ধুরাও অলরেডি অনেক টাকা কামচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও কামাবে। কিন্তু এই ১০০ টাকা এবং তার পিছনের ঘটনার প্রভাব থাকবে আজীবন!!
আজ সেই ঘটনার ১০ বছর পর আবার সেই স্কুল বন্ধুদের সাথে আরেকটা পার্টির (অথবা রি-ইউনিয়ন) সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু ভেতর থেকে কিছুতেই আমার সেই ঘনিষ্ঠ (!!) বন্ধুদের সাথে রি- ইউনিয়ন করার সায় পাচ্ছিনা!!

বিঃ দ্রঃ আমি আমার পরিবার, আমার তৎকালীন আর্থিক অসঙ্গতি নিয়ে ভীষণ গর্বিত। এই ব্যাপারগুলোই আমার আজকের ভিত রচনা করে দিয়েছে। আমি আজকে যাই আছি, যেমনি আছি; তা নিয়ে আমি নিজে খুব সন্তুষ্ট আর গর্বিত। আমার এই গর্ব, আমার এই অর্জন কেউ কেড়ে নিতে পারবে না!!!
তা আমার সেই ঘনিষ্ঠ (!!) বন্ধুরা যতই সফল হোক না কেন ...... আমার মত করে কেউ কখনোই প্রতিদিন লড়াই করেনি!!
আজকাল আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না!! মানুষ যেটা দুর্বলতা ভেবে টিটকারি মারার সুযোগ খুঁজে, সেটা যখন আপনি শক্তি হিসেবে নিবেন --- আশপাশের অই সুযোগ সন্ধানী মানুসগুলার হা-হুতাশ দেখার চেয়ে মজা আর কিছুতে নাই!!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১:১৯
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×