কায়জার প্লাৎস। একটু করে মানুষের ভিড় বাড়ছে। কেউ পেশাগত কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছে। কেউ আয়েশ করে ঘুরতে বেরিয়েছে। কেউ হয়তো কর্মময় দিনের ক্লান্তি কাটাতেও এসে বসেছে এই ফাঁকা সবুজ চত্বরে। কারো জন্য বিকেলে বেড়াতে বের হওয়াটা আবার বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে সারাদিন বাসায় থাকা ছোট্ট শিশুটি কিংবা কুকুরটিকে একটু হাওয়া খাওয়াতেও বিকেলে বের হওয়াটা বাধ্যতামূলক অনেকের জন্যেই। তবে অ্যালিস এবং তমালের জন্য এমন কোন বাধ্যতামূলক বিষয় নেই। বাসায় কেউ প্রতীক্ষা করে নেই। রান্না কিংবা বাজার করারও প্রয়োজন নেই আজ। ফলে এখনই বাসায় ফেরার তাড়া নেই।
অ্যালিস ফরাসি। বেশ লম্বা। চুল পুরোপুরি সোনালি না হলেও কালোও নয়। হাল্কা কালচে ভাব রয়েছে মাত্র। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙের সাথে এমন হাল্কা সোনালি-কালচে চুল আরো মোহনীয় করে তুলেছে তাকে। পোশাকে সবসময় একটা আভিজাত্যের ছাপ। পেশায় উন্নয়ন কর্মী। কাজ করে জার্মান উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রে। দেখতে দেখতে চার-চারটি বছর কেটে গেছে ছায়াঘেরা মায়াময় বনে। কাজ থেকে ফেরার সময় এরকমই এক বিকেলে বাসের মধ্যে কথা হয় তমালের সাথে। নাম-ধাম পরিচয় জানা হয়ে যায় প্রথম দিনেই। ফরাসি আর বাঙালি। জাতিগত, সংস্কৃতিগত বহু অমিল থাকলেও মানুষ হিসেবে যেন আকর্ষণীয় কিছু বলেই মনে হয় অ্যালিসের কাছে। দু'দিন পর আবারও দেখা একই বাসে। এরপর থেকেই সখ্যতা গড়ে ওঠে দু'জনের মধ্যে। প্রায় দু'বছর ধরে তারা একে অপরকে চেনে। সময় পেলে মাঝে মাঝে ঘুরতে বেরোয় এখানে ওখানে। হয়তো কোনদিন ড্রাকেনফলস। আবার কোনদিন গোডেসবুর্গ। আজ কোলন ডোম। তো অন্যদিন রাইন-মোজেলের মোহনায়।
অ্যালিস আর তমাল এসে কায়জার প্লাৎস এর ঝর্ণার কাছে বসে। দু একটা কাজের কথা বলার পরই অ্যালিসের ইচ্ছা হয় বরফ খাওয়ার।
: তমাল, চলো বরফ খাই।
: চলো, তুমি খাও। আমি বরং অন্য কিছু খাই। আমি আজ পেঁপের জুস খাবো। ঠিক আছে?
কথা বলতে বলতেই জামার সামনের পকেট থেকে টাকা বের করে তমাল। এমন সময় অ্যালিস বলে ওঠে,
: না, ঠিক নেই। আমি বরফ এতো পছন্দ করি, অথচ তুমি কেন কখনও বরফ খাওনা বলতো?
: কেন বরফ খাই না আমি, সেই গল্প শুনলে হয়তো তুমিও আর বরফ খাবে না। তাই সেই গল্প শোনার কোন কাজ নেই তোমার। তুমি বরফ খাও। কেমন?
: না, আজ আর তোমাকে ছাড় দিচ্ছিনা তমাল। এমন কী ঘটেছে যে, তুমি কোনদিন বরফ খাবে না। আবার আরেকটি ব্যাপার আমার খুব ভালোভাবে চোখে পড়েছে। সেটা হলো তুমি কখনো মানিব্যাগ ব্যবহার করো না। এটার রহস্য কী, বাবা?
: আচ্ছা বাবা, তোমাকে গল্প না শুনিয়ে যেহেতু রেহায় নেই। শোনাবো, তার আগে চলো বরফ নাও। তারপর আবার ঝর্ণার কাছে বসে আয়েশ করে তোমাকে সেই গল্প শোনাবো।
: আচ্ছা, কথা দিলে তো, নাকি এটাও আবার আমাকে ভোলানোর ফন্দি।
: না, না। একদম কোন ফন্দি নয়। সম্পূর্ণ সত্যি কথা এটা।
সামনের দোকান থেকে অ্যালিস নিল একটা দারুণ বরফ আর তমাল নিল পেঁপের জুস। দু'জনেই ঘুরে এসে বসলো ঝর্ণার ধারে।
তমাল নিজেই শুরু করলো, 'অ্যালিস, শোন গল্প। তবে আমার গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিন্তু প্রশ্ন করতে পাবে না। তুমি কি রাজি?'
অ্যালিস সম্মতি দেয়, এতে সে পুরোপুরি রাজি কিন্তু গল্প শোনা চাই।
তমাল আবার শুরু করে। 'টানেনবুশ গিয়েছো নিশ্চয়ই অনেকবার। সুপার মার্কেট হিট যাওয়ার ঠিক পাঁচটা দোকান আগেই একটা রেস্তোরা। তখনও শীত শুরু হয়নি। আবহাওয়া ছিল বেশ গরম। আমার সেদিন অফিস ছিল না। তাই ঠিক দুপুর ১ টার সময় হিট থেকে বাজার করে বের হলাম। বাস ধরার জন্য বেশ দ্রুতই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো বরফ খেলে কেমন হয়? কারণ ইটালীয় সেই রেস্তোরায় এমন সুন্দর করে সাজানো থাকে নানা রং আর স্বাদের বরফের উপকরণ, যে সেটার সামনে দিয়ে হেটে গেলেই যেন জিভে জল চলে আসে। আমি কলা এবং আনারসের স্বাদের উপকরণ মেশানো একটি কোন আইসক্রিম নিলাম। দাম বেশি নয়। সম্ভবত এক ইউরো চল্লিশ সেন্ট।
মানিব্যাগ টা বের করলাম দাম দেওয়ার জন্য। কিন্তু তারপরই স্মরণ হলো যে, আমার প্যান্টের পকেটেই তো কয়েন আছে। তাই মানিব্যাগটা দোকানের সামনে বেড়ে থাকা পাটাতনের উপর রেখে প্যান্টের পকেট থেকে কয়েন বের করে দাম দিলাম। বরফ নিলাম। এতো মজার স্বাদ যে, হাতে নিয়েই খেতে শুরু করেছি। তারপর দুই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাটা শুরু করি। বাস ধরতে হবে। তাই দ্রুত গিয়ে হাজির হই বাস ছাউনিতে। বাসে ওঠার সময় এখানে ভ্রমণের জন্য সাথে থাকা বিশেষ পাস অর্থাৎ জবটিকেট দেখানোর জন্য মানিব্যাগে হাত দিয়েছি। দেখি মানিব্যাগ নেই। আঁৎকে উঠলাম।
বুঝলাম মানিব্যাগ নিশ্চয়ই কোথাও ফেলে এসেছি। তবে জার্মানি বলে ভরসা হলো যে কেউ সেটি পেলে নিশ্চয়ই ফেরত দেবে। তারপরও এতোগুলো কার্ড এবং টাকাসহ মানিব্যাগ হারানোর কষ্ট এবং আতঙ্কে একেবারে ভেঙে পড়লাম আমি। খুব বেশি উৎকণ্ঠা নিয়েই দৌড়ে হাজির হলাম হিটে। ঠিক যে মেয়েটির কাছে জিনিস পত্রের দাম দিয়েছি সোজা তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি সেখানে মানিব্যাগ ফেলে গিয়েছি কিনা। কিংবা সে এব্যাপারে কিছু জানে কিনা? সে একটু হকচকিয়ে জবাব দিল, ''না এখানে তুমি কিছু ফেলে যাওনি। কারণ ফেলে গেলে সেটা আমার চোখে পড়তো এবং আমি তা তুলে রাখতাম।''
কী আর করার? কাউন্টার থেকে এবার গেলাম হিটের তথ্য কেন্দ্রে। আমার কেনা-কাটার রশিদ দেখালাম। জানালাম আমি ঠিক ১.৩০ এসব সয়দা কিনেছি এবং দাম দিয়ে এখান থেকে গিয়েছি কিন্তু মানিব্যাগটা কাউন্টারে ফেলে গিয়েছি বলেই আমার মনে হচ্ছে। সুতরাং তোমাদের কাছে কেউ সেটা ফেরত দিলে দয়া করে আমাকে জানিও। তথ্য কেন্দ্রে থাকা মেয়েটি মিষ্টি হাসি দিয়ে জানিয়ে দিল তার আন্তরিকতার কথা। বললো, তারা সেটা পেলেই আমাকে ফোন দেবে।
একটু পর নিজেরই মনে হলো যে, আমি তো হিট থেকে বেরিয়ে পাশের দোকান থেকে বরফ কিনেছি। আর বরফ কেনার সময় দাম দেওয়ার জন্য পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করি। ব্যস, সর্বনাশ তাহলে সেখানেই হয়েছে। মানে সেখান থেকে আর মানিব্যাগটা নিয়ে আসিনি। এমন ভাবনা মনে আসতেই ছুটে গেলাম সেই বরফের দোকানে। ভাঙা ভাঙা জার্মান ভাষায় বুঝালাম ব্যাপারটা। কিন্তু দোকানির উত্তর, ''তুমি তো ঘুরে এসে মানিব্যাগটা নিয়ে গেছো।'' আমি তো হতবাক। এ কেমন কথা? কিন্তু দোকানি আবারও একই কথাই জোর দিয়ে বললে বুঝলাম, আমার মতোই বা প্রায় একই বয়সের কোন চোর ব্যাটা এসে নিজের মানিব্যাগ বলেই সেটা নিয়ে গেছে। ভীষণ আশ্চর্য হলাম। কারণ কোন জার্মান তরুণ এমন কাজ করবে না বলেই বিশ্বাস। বরং তারা সেটা পেলে দোকানির কাছে কিংবা হারানো জিনিস জমা দেওয়ার দপ্তরে পৌঁছে দেবে। ফলে হিসাব যা মিলল, তা হচ্ছে টানেনবুশ অঞ্চলে প্রচুর বিদেশি বাস করে তাদেরই কেউ সেটি হাতিয়েছে।
কী আর করা? পুলিশের কাছে গেলাম। পুলিশ বলল, জার্মান ভাষায় ফুন্ড ব্যুরো অর্থাৎ হারান জিনিস খুঁজে পাওয়ার দপ্তরে যেতে। সেখানে গিয়ে খোঁজ করলাম। তারা এক সপ্তাহ পর এসে খোঁজ নিতে বলল। কিন্তু পরের সপ্তাহে এসেও কোন হদিস মিলল না। এমনকি এরপরের সপ্তাহগুলোতেও গিয়ে খোঁজ করেছি আমার সেই প্রিয় কালো মানিব্যাগটির। কিন্তু কোন খবর নেই আজ পর্যন্ত। আমার সেই প্রিয় মানিব্যাগ হারানোর ব্যথা এখনও ভুলতে পারি না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি - আর কখনও মানিব্যাগ ব্যবহার করবো না।'
এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শোনার পর এবার অ্যালিস সুর মেলালো, 'আর কোনদিন বরফ খাবো না।' তমালও ঠিক একইসুরে বলল, 'হুম, তা-ই। আর কোনদিন বরফ খাবো না। তবে আমিও জানি না, আসলে এতো প্রিয় দু'টি জিনিস থেকে কতদিন দূরে থাকতে পারবো।'
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১১ ভোর ৬:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




